২০১৭ সালের ঘটনার পর থেকেই এ ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে; ফলে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ ঘটনা বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কাড়ে। বাংলাদেশ শুরু থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য একটি ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাসহ জীবন-যাপনের যথাসাধ্য ব্যবস্থা করার পাশাপাশি কীভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়, তার জন্য আন্তরিক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে একটি ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার শর্ত অনুযায়ী মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি মিয়ানমার গ্রহণ করবে এবং প্রত্যাবাসন শুরুর দিন থেকে দুই বছরের মধ্যেই এ প্রত্যাবাসন পক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ বহুল আলোচিত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মিয়ানমারের পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব, মিয়ানমারে ফেরত যেতে রোহিঙ্গাদের প্রবল অনাগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোর আপত্তির কারণে প্রথম দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তেমন কোনও দৃশ্যমান, গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য উন্নতি, প্রতিশ্রুতি এবং প্রস্তুতি ছাড়াই দ্বিতীয়বার গত ২২ আগস্ট, ২০১৯ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবং শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত বোধগম্য কারণে সেটাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ হচ্ছে রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকে বিগত দুই বছরের একটা চিত্র। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কী?
দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, সার্বিক পরিবেশ এবং বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে, এ রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত কোনও সমাধান হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে বিবেচনা করছে এবং সেখানেই সব মনোযোগ বিনিয়োগ করছে। এবং আমিও মনে করি, স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনই বাংলাদেশ এবং রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই সম্মানজনক এবং স্বস্তিকর। কিন্তু ‘স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন’ কীভাবে হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। দ্বিতীয় দফা উদ্যোগ নেওয়ার পরও কেন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়েছে, তার জন্য অনেকেই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, এনজিওগুলোর প্রত্যাবাসনবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহকে দায়ী করছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা ভুল জায়গায় মনোযোগ দিচ্ছি। আমার মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতায় নিজের কাছে মনে হয়েছে, ত্রাণ, শরণার্থী এবং প্রত্যাবাসন কমিশনারের নেতৃত্বে এবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল এবং তাদের চেষ্টা-আন্তরিকতা-প্রস্তুতির কোনও কমতি ছিল না। সুতরাং মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা না জেনে সরকারকে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের দায়ী করার কোনও মানে হয় না। আর একথাও অনস্বীকার্য, কিছু কিছু এনজিও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করছে, তবে যারা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে, তাদের কাছে রোহিঙ্গাদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে, এটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাছাড়া, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জীবন এখনও অনিরাপদ এবং ঝুঁকিপূর্ণ, এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। আর প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের বিষয়টিও একেবারে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা, মিয়ানমার গত দুই বছরে এমন কোনও আস্থা এবং বিশ্বাস রোহিঙ্গাদের মনে তৈরি করতে পারেনি, যে কারণে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তাই, আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে, এবারের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার পেছনে মোটা দাগে দায়ী হচ্ছে মিয়ানমার। কেননা, তারা এখনও পর্যন্ত নানান ছল-চাতুরি করে প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চেয়েছে মূলত বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের ‘সদিচ্ছা সেল’ করার জন্য, কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।
গত জুলাই মাসে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে একটা প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করে এবং রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া, তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া এবং তাদের ভিটামাটি ও জমি-জিরাত ফেরত দেওয়া নিয়ে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি রোহিঙ্গাদের দিতে পারেনি। ফলে, কোনও ধরনের বিশ্বাসযোগ্য এবং আস্থাশীল সমঝোতা ছাড়া হঠাৎ করে আগস্টের ২২ তারিখ একটা দিন ধার্য করে এ ধরনের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কেন শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাও নিয়ে নানান প্রশ্ন আছে। এখানে মিয়ানমারের একটা বড় রাজনীতি আছে, সেটা সহজেই অনুমেয় যা নিয়ে আমি অন্যত্র বিস্তারিত লিখেছি। প্রত্যাবাসন করে রোহিঙ্গাদের কোথায় নিয়ে যাবে, কোথায় রাখা হবে, কীভাবে রাখা হবে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কিনা, তাদের জীবনের নিরাপত্তা কীভাবে দেওয়া হবে, তাদের নিজের বসত-ভিটা ফিরিয়ে দেওয়া হবে কিনা এবং তাদের একটি মুক্ত জীবন দেওয়া হবে কিনা…এসব বিষয়ে কোনও পরিষ্কার ধারণা এবং প্রতিশ্রুতি ছাড়া ‘উই উয়ান্ট রিপাট্রিয়েশান’ বললেই প্রত্যাবাসন হয় না। সুতরাং আমি মনে করি, আজকে এ রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ সরকারের কাজ হবে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানানো এবং বোঝানো, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার ‘ক্রিয়েটর নয়, ভিকটিম’। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার কোনও ধরনের সহযোগিতা করছে না। মিয়ানমার কোন ধরনের বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য এবং দৃশ্যমান প্রস্তুতি ছাড়া একের পর এক প্রত্যাবাসনের ‘নাটক’ করছে। যার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা ক্রমান্বয়ে আরো জটিল হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের কাজ হচ্ছে আজ রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা তথ্যবহুল শ্বেতপত্র প্রকাশ করা, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝানো, এতো বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে এদেশের থাকতে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের কী কী ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রতিবেশগত, নিরাপত্তাজনিত এবং রাজনৈতিক সমস্যা হচ্ছে এবং আরও জটিলতর সমস্যার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। কেবল, এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য, মিয়ানমারের আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। কেননা, আমাদের মনে রাখা জরুরি, অপরাধীর সঙ্গে সমঝোতা করে অপরাধের বিচার হয় না।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।