জয়শঙ্করের সফর

আনিস আলমগীরভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর তিন দিন বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। জয়শঙ্কর প্রবীণ আইসিএস অফিসার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন। সচিব হিসেবে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছেন। এবারের সফরের কথাবার্তায় বুঝা গেলো তিনি সেই সম্পর্ক অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন। ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশী কারও সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয়। শুধু বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে ভারত নিয়ে একটা আতঙ্ক সব সময় বিরাজ করে। বড় দেশ, কোন সময় কোন ফাঁকে কোন কাজ করানোর বায়না ধরে যাতে বাংলাদেশের স্বার্থের ক্ষতি হয়, এই চিন্তায়।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত দশ বছরের বেশি দেশের প্রধানমন্ত্রী আছেন। তিনি সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছেন যেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো থাকে। আর বাংলাদেশের স্বার্থ কোনোভাবেই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমরা আশা করবো যে জয়শঙ্কর সম্পর্কটাকে উভয় দেশের সর্বস্তরে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করবেন। সন্দেহ, সংশয় কোনোভাবেই যেন আমাদের চলমান সুসম্পর্কটাকে ব্যাঘাত না ঘটায়।

আসামে বোড়ো উপজাতি, বাঙালি আর অসমীয়াদের মাঝে বহুদিন জাতিগত দাঙ্গা লেগেছিল। তখন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আসামের নাগরিকপঞ্জি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স-এনআরসি) তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নাগরিকপঞ্জি তৈরি করতে গিয়ে ঝামেলা বাড়বে না কমবে, তা চূড়ান্ত রূপ নেওয়ার আগেই এখন খসড়া তালিকায় ৪০ লাখ বাঙালিকে নাগরিকত্বহীন করে রাখা হয়েছে। এই ৪০ লাখ নাগরিকত্বহীন বাঙালিদের মাঝে ২৭ লাখ হিন্দু এবং ১৩ লাখ মুসলমান। উভয় বাংলার মানুষ এই নিয়ে মানসিক পেরেশানিতে রয়েছে। আগামী ৩১ আগস্ট নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে সরকার।

বাংলাদেশের কোনোভাবেই এই ধরনের অন্যায় সিদ্ধান্ত মানার প্রশ্নই আসে না। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যেসব বাঙালি সীমান্তবর্তী তিনটি রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা প্রত্যেকে শতাংশে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে এবং এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারগুলো সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল, সে রেকর্ডও আছে।

অমিত শাহসহ বিজেপি নেতারা এই ৪০ লাখ লোককে নিয়ে বহু কথাবার্তা বলেছেন, যাতে উগ্রবাবাদী মনোভাবের পরিচয় মেলে। আমাদের সাংবাদিকরা এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে তিনি কোনও রাখঢাক না রেখে সহজ সরল ভাষায় বলেছেন, এটা সম্পূর্ণ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে দুর্ভোগে রয়েছে। আবার আসামের পক্ষ থেকে বাঙালি বিতাড়নের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ তো আর একটা দুর্যোগে পড়বে।

রোহিঙ্গারা সম্পূর্ণভাবে মিয়ানমারের নাগরিক। অথচ জোর করে তাদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য আমেরিকার মতো দেশ বলছে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা দিতে হলে রাখাইনসহ দিতে হবে। গত চারশ’ বছরব্যাপী রোহিঙ্গারা আকিয়াব ডিভিশনের রাখাইন অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। আকিয়াব ডিভিশন কখনও মিয়ানমারের অংশ ছিল না। সেখানে বাংলাদেশের চট্টগ্রামসহ একটা স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। ১৯৩৬ সালে বার্মাকে ভারত থেকে পৃথক করার সময় মনগড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিটিশরা আকিয়াবকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

সমগ্র উপমহাদেশ ব্রিটেনের অধীনে ছিল। বিরাটত্বের কথা বলে তারা শাসনকার্যের সুবিধার্থে ভাঙা-গড়া করেছে। তাতে কেউ কিছু বলেনি। রোহিঙ্গারা এই অঞ্চলের আদিবাসী বলে তাদের ব্রিটিশ তার গড়া তালিকায় নৃগোষ্ঠী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেনি অথচ তারা বার্মার (মিয়ানমারের) নৃগোষ্ঠীর যে তালিকা প্রস্তুত করেছিল, সেখানে ১৩৫টি নৃগোষ্ঠী রয়েছে।

যাক, জয়শঙ্কর নাগরিকপঞ্জি বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আমাদের কিছুটা চিন্তামুক্ত করেছেন। আবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে ভারত সাহায্য করার কথা বলেছেন। তার উভয় আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়েছি।

ভারতে বাংলাদেশের ৫৪টি নদীর উৎসস্থল। এখন ভারত তার পানির প্রয়োজনে প্রত্যেকটি নদীতে বাঁধ নির্মাণ করছে, যার ফলে ভাটির দেশ হিসেবে আমরা পানি প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের শুধু গঙ্গা চুক্তি হয়েছিল। তার মেয়াদ ২৩ বছর উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, আর মাত্র ৭ বছর অবশিষ্ট আছে। উজানে বাঁধ দিলে চুক্তির পরও ভাটির দেশ উপকৃত হয় না, কারণ পানির নিয়ন্ত্রণ থাকে উজানের দেশের হাতে। তবু চুক্তির দায় দায়িত্ব পালন করতে গেলে তো কিছু পানি পাওয়া যায়। গজলডোবা বাঁধের কারণে আমরা তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একটা চুক্তি করতে সম্মত হলেও পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রীর অসম্মতির কারণে তিস্তার পানি পাচ্ছি না। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়।

পররাষ্ট্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে। অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তি করা পররাষ্ট্রীয় বিষয়। কেন্দ্র চুক্তি করতে পারছে না প্রাদেশিক সরকারের অসম্মতির কারণে। ভারতের শাসনতন্ত্র থেকে এ জাতীয় অনুচ্ছেদ তুলে নেওয়া উচিত। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুসারে আমরা বেরুবাড়ি দিয়েছিলাম ১৯৭৩ সালে। অথচ সাংবিধানিক বাধার কারণে আমরা সীমান্ত চিহ্নিতকরণ ও ছিটমহলগুলো পেতে ৪৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা মুজিব চুক্তিটি বাস্তবায়ন করতে ভারতের শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে হয়েছে। আমরা ৪৪ বছর ঘুরেছি বিজেপির বাধার কারণে। কারণ শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার। বিজেপি তখন বিরোধী দলে ছিল। সায় দেয়নি। কিন্তু তারা সরকারে গেলে সবাই সায় দিয়েছে।

জয় শঙ্কর বলেছেন, সব নদীর পানি বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে একটা উদ্যোগ নেওয়া হবে। বাংলাদেশ আশা করে বিষয়টা যত দ্রুত সম্ভব তত দ্রুত করা উচিত। কারণ ভাটিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিধায় সব নদীর প্রবাহের মন্থর গতির ফলে আমাদের নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কিছু নদী উভয় রাষ্ট্র ড্রেজিং করতে সম্মত হয়েছে। ড্রেজিং তো খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার। নদীর নাব্য থাকলে আসাম পর্যন্ত বাংলাদেশ হয়ে ভারতীয় জাহাজ যাওয়া সম্ভব। পূর্বে জাহাজ যেতো।

ভারত আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ভারতকে ভয় পায়। কারণ অনেক সময় ভারত প্রতিবেশী সম্পর্কে নির্মম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্থলভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত দেশ নেপালকে দুই দুইবার মালামাল যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছিল ভারত। এসব কাজ না করলে ভারতের ক্ষতি হয় না। ভারতে বিশ্বের বেশি সংখ্যক বিলিয়নেয়ার আছে সত্য, তবে কোটি কোটি দরিদ্র কৃষক রয়েছে। আর বেকারত্বের সীমা-পরিসীমা নেই। মুখ তরতাজা হলে আর দেহটা কঙ্কালসার হলে তাকে যেমন স্বাস্থ্যবান বলা যায় না, তেমনি ভারতীয় অর্থনীতিকেও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নত অর্থনীতি বলা মুশকিল। সুতরাং অভ্যন্তরীণভাবে অর্থনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে সত্য, কিন্তু এমপ্লয়মেন্ট সৃষ্টি করতে পারেনি। সেই প্রবৃদ্ধি প্রতিবন্ধী প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ এর থেকে উন্নত কিছু নয়। সেই কারণেই অর্থনৈতিকভাবে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া দরকার।

যাক, আলাপ করছিলাম জয়শঙ্করের বাংলাদেশ সফর নিয়ে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আগামী অক্টোবরে ভারত সফরে যাবেন। হয়তো জয়শঙ্কর আলাপ-আলোচনা করে এজেন্ডা প্রস্তুতির কাজ করে গেছেন। একটা কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আগেরবার ভারত সফরের পূর্বেও লিখেছি, এখনও বলছি—উভয়ের মাঝে যেন কোনও সামরিক চুক্তি না হয়। আমাদের আরেক প্রতিবেশী চীন। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ভারতের বিরোধ রয়েছে। ভারতের সঙ্গে যে কোনও সামরিক চুক্তি হলে চীনের সঙ্গে তা ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ সৃষ্টি হবে। আমরা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, সুতরাং বাংলাদেশকে সংঘাত থেকে দূরে রাখা দরকার।

সবশেষে বলবো, জয়শঙ্কর তার সফরকালে কাশ্মির নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার মিশন সাকসেসফুল হয়েছে। তার প্রতিফলনে দেখা যায় তার সফরকালেই বাংলাদেশ কাশ্মির নিয়ে একটি অফিসিয়াল বিবৃতি দিয়েছে। তাতে বাংলাদেশ কাশ্মিরকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিমত দিয়েছে। কাশ্মির নিয়ে এর থেকে বেশি কিছু বলা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোনও পর্যায়ে যেন কাশ্মিরে মানবতার বিপর্যয় না ঘটে, এই নিশ্চয়তা ভারতেরই বিশ্ববাসীকে দেওয়া উচিত।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com