চার্লস ডারউইন তার বিবর্তনতত্ত্বে যেখানে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির টিকে থাকার বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, ক্রপোৎকিন সেখানে বলেছেন ‘পারস্পরিক সহায়তা’র মধ্য দিয়ে টিকে থাকার কথা। ‘মিউচ্যুয়াল এইড: অ্যা ফ্যাক্টর অব ইভ্যুলুশন’ নামের এক বইতে তিনি বলছেন, সাধারণ অবস্থায় মানুষ ও সমাজ জীবন বিবর্তনের স্বাভাবিক ও মসৃণ পথে এগোয়। তার মতে, পারস্পরিক সংঘাত নয় সহযোগিতাই প্রজাতিগুলোর প্রধান প্রবণতা। ইতিহাসের উদাহরণ টেনে ক্রপোৎকিন দেখান, যে প্রাণী যত উন্নত, তাদের মাঝে সহায়তার বোধ তত গভীর। এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কারও পক্ষেই অস্বীকার করার উপায় নেই, এই সহযোগিতাপ্রবণ মনোভাবই কেবল পৃথিবীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। অন্যকে মেরে নিজে টিকে থাকার পথে পৃথিবীর ধ্বংসকেই কেবল অনিবার্য করা সম্ভব। অন্যসব প্রজাতিকে ধ্বংস করে এককভাবে মানুষ কি টিকে থাকতে পারবে এই পৃথিবীতে?
বাস্তুসংস্থান সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণাও আছে, তারাই জানেন, অন্যসব প্রজাতি আর প্রতিবেশকে ধ্বংস করে মানুষ পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে না। আমাদের এই পৃথিবী হলো এমন এক স্থান, যেখানে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়েই জৈব, অজৈব পদার্থ ও বিভিন্ন জীবসমন্বিত এমন প্রাকৃতিক একক যেখানে বিভিন্ন জীবসমষ্টি পরস্পরের সঙ্গে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জীবনধারা গড়ে তোলে। তাই জল-জঙ্গলকে দখলে নিয়ে বাস্তু প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে টিকে থাকার প্রচেষ্টা একটা উন্মাদনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে অন্ধ বাজার এসব বোঝে না। বোঝে না মুনাফাবাজ করপোরেশন আর ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা। সে কারণেই ট্রাম্পের কাছে জলবায়ু পরিবর্তন একটা ভুয়া ব্যাপার। সে কারণেই ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো অ্যামাজনকে বাণিজ্যের ক্ষেত্র বানাতে তৎপর।
লক্ষ-কোটি প্রাণের আধার অ্যামাজনের বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে একে কৃষি ও খনি সেক্টরের কাছে হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেছিলেন ক্ষমতাসীন উগ্র ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো। ক্ষমতায় আসীন হয়ে সেই প্রক্রিয়াই বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ ভয়াবহভাবে জ্বলছে মানুষ-সৃষ্ট কারণেই। পরিবেশবাদীদের মতে, এই আগুন নেভাতে সরকারের কোনও উৎসাহ নেই। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী দখলদার বনখেকো মানুষ আর খনি ব্যবসায়ীদের আধিপত্যই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে অ্যামাজনের ভবিষ্যৎকে। আর অ্যামাজনের ভবিষ্যতে হুমকি মানে কিন্তু বহু বহু প্রজাতি ধ্বংসের হুমকি, সঙ্গত কারণেই তা মানুষের ভবিষ্যতের জন্যও হুমকি। আমরা ইতোমধ্যে জানি, গোটা পৃথিবীর জন্য ২০ ভাগ অক্সিজেন সরবরাহ আর ২৫ ভাগ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণের কাজটি করে পৃথিবীর এই ফুসফুস। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রচণ্ডতা ইতোমধ্যে যেখানে পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে হুমকিতে ঠেলে দিয়েছে, সেখানে অ্যামাজন বিপন্ন হলে আমাদের ধ্বংস যে আরও ত্বরান্বিত হবে, সেটা বুঝতে কোনও তত্ত্ব-তথ্য-গবেষণাও লাগে না।
বলসোনারো দায়িত্ব নেওয়ার পরপর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে অ্যামাজন সোশিও-এনভায়রনমেন্টাল জানিয়েছিল, অ্যামাজনের অরণ্য বিনাশে বৈধ ও অবৈধ খনি বাণিজ্যেরও বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। ছয়টি দেশে বিস্তৃত অ্যামাজনের ২৪৫টি এলাকায় ২ হাজার ৩১২টি অবৈধ খনি রয়েছে। বলসোনারো নিজেও জানিয়েছেন, তিনি নিজেই ১৯৮০-র দশকে একটি অবৈধ সোনার খনিতে কাজ করেছেন এবং অবৈধ খনি ব্যবসায়ীদের সমর্থন পেয়েছেন। তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সম্মান ও নিরাপত্তার। এছাড়া সংরক্ষিত আদিবাসীদের এলাকায় খনন কাজকে বৈধ করার কথাও জানিয়েছিলেন। গবেষকরা বলছেন, কৃষি, খনন ও অনুসন্ধানের কারণে এখন পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক অবস্থার দিকে যাচ্ছে। গত অর্ধশতকে অ্যামাজনের যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের সমান বনাঞ্চল হারিয়ে গেছে। গত মাসে বনাঞ্চল হারিয়ে যাওয়ার হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতি মিনিটে তিনটি ফুটবল মাঠের সমান এলাকার বন হারিয়ে যাচ্ছে।
ক্লার্ক ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অ্যামাজন খনি ও তেল, গ্যাস উত্তোলনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এছাড়া আগামী দুই দশকে এখানে বড় ধরনের অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যামাজন সংশ্লিষ্ট দেশগুলো জাতীয় ও আন্তঃসীমান্ত অবকাঠামো গড়ে তোলার নীতিগত ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির এই কৌশল নেওয়া হয়েছে। অ্যামাজনের আদিবাসী মানুষের বাড়িঘর ধ্বংস নতুন কিছু নয়। ১৬ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা তাদের জমি লুট করার পর থেকে এই দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতার সঙ্গে থাকতে হচ্ছে তাদের। বলসোনারোর অধীনে তাদের ভাগ্য আরও বিপন্নতায় পর্যবসিত হয়েছে। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বলসোনারোর কর্মকাণ্ডে শুরু থেকেই স্পষ্ট হয়েছে, তারা কাছে আদিবাসীদের অস্তিত্বের প্রশ্ন প্রাধান্যের তলায় অবস্থান করছে। জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার কয়েক দিন পর থেকে বলসোনারো ব্রাজিলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য আদিবাসী বিষয়ক ব্যুরো-এফইউএনএআই বাতিলসহ আনুষ্ঠানিক ফেডারেল সুরক্ষা ভেঙে ফেলতে শুরু করেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রেসিডেন্টের কথা ও কর্মকাণ্ডের পরিণতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে এসে পৌঁছেছে।
গবেষকরাও অ্যামাজনের সাম্প্রতিক আগুনের মধ্যে আদিবাসীদের অস্তিত্বের হুমকির নিশানা খুঁজে পেয়েছেন। আগুনে পুড়ে যাওয়া বনের বৃক্ষরাজি আর হুমকিতে পড়া লক্ষ-কোটি প্রাণ রক্ষার জন্য প্রাণপণ লড়ছেন বন-সংলগ্ন ওইসব মানুষ। এক খোলা চিঠিতে তারা পরিস্থিতিকে মানবিক ও পরিবেশগত দুর্যোগ আখ্যা দিয়েছেন। তাদের বোঝাপড়ায়, বৃক্ষসহ সব প্রাণীই মানুষের মতো। সে কারণেই অ্যামাজনের আগুনে লক্ষ-কোটি প্রাণ ঝরে পড়ার ঘটনায় গণহত্যার আলামত খুঁজে পেয়েছে তারা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অ্যাকটিভিস্ট ওয়েবসাইট ওপেন ডেমোক্র্যাসি সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক সরকারি গোপন নথির ভিত্তিতে দেখিয়েছে, বলসোনারোর ঘৃণাবাদী বক্তব্যকে উপজীব্য করে ব্রাজিল সরকার অ্যামাজানকে কী করে বিপন্ন করে তুলছে। সেখানকার বনসংলগ্ন আদিবাসীদের কী করে সেখান থেকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু আদিবাসীরা না বাঁচলে অ্যামাজনও বাঁচবে না। গবেষণার জন্য অ্যামাজনের আদিবাসীদের সঙ্গে কাজ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়ামের সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী লেসলি ডে সৌজা পবিবেশবিষয়ক মার্কিন ওয়েবসাইট আর্থারকে বলেছেন, ‘বাস্তুতন্ত্রের কার্যক্রম পরিবর্তন করে, যেকোনও সময় আপনি একটি অঞ্চলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটাতে পারেন, যেভাবে সমস্ত জীববৈচিত্র্য সেই বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। আপনি যখন ওই পরিবেশে বাস করছেন, আপনি সম্পূর্ণরূপে এই উপাদানগুলোর ওপর নির্ভরশীল। আপনিও এই নিয়মের অংশ।’
অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপকতার পর অ্যামাজনের মধ্য দিয়ে হেঁটেছেন ডে সৌজা। তিনি সাপ, গিরগিটি, করালসহ আরও ছোট প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন, যারা আগুন থেকে পালাতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘মারাত্মক ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম। যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র।’ এই ধ্বংসের প্রভাব আদিবাসীদের বেঁচে থাকার সক্ষমতাকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। লন্ডন ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানী রাফায়েলা ফ্রায়ের মোরেইলা আর্থারকে বলেন, ‘অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী গাছ ও অপরাপর প্রাণকে মানুষের থেকে আলাদা করে দেখে না। ওটা তাদের সাংস্কৃতিক বোধ।’ তারা মানবাধিকার ও পরিবেশগত অধিকারের মধ্যে পার্থক্য করে না। তিনি এক ইমেইল বার্তায় আর্থারকে বলেন, ‘আজকে আমরা বনে যে ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি; অনেক সম্প্রদায় এটাকে কেবল বাস্তু হত্যা হিসেবে নয়, গণহত্যা হিসেবে অনুধাবন করছে।’
যুদ্ধসহিংসতায় বছরে যতো মানুষ প্রাণ হারায়, তার চেয়ে কিন্তু বেশি মানুষ প্রাণ হারায় পরিবেশ সুরক্ষায় লড়তে গিয়ে। ব্রাজিলে অ্যামাজন আর আদিবাসী সম্প্রদায়কে রক্ষা করতেও প্রচুর মানুষকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। কেবল আদিবাসীরা বনকে উপজীব্য করে বাঁচে তা কিন্তু নয়, বনও বাঁচে আদিবাসীদের যত্নে লালিত হয়ে। বনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক মিথস্ত্রিয়ার। আর্থারের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই আগুনেও আদিবাসী সম্প্রদায় বন রক্ষায় তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। বন ধ্বংস করা খনিজীবী ও দখলদারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ছে তারা। এবারের আগুনের ঘটনাগুলো পুঁজিবাদী উন্নয়ন বনাম প্রকৃতির লড়াইকে জোরদার করেছে। এগুলো আদিবাসী গ্রুপগুলোর অস্তিত্ব বনাম সংস্কৃতির লড়াইয়ের সর্বশেষ অভিপ্রকাশ আকারে হাজির হয়েছে।
এমন বাস্তবতায় সার্বভৌমত্বের অজুহাত তুলে ব্রাজিলের উগ্র ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট বলসোনারো বলছেন, অ্যামাজনের ঘটনায় বিশ্বের অন্য কোনও দেশ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কিন্তু আমরা কি প্রশ্ন তুলব না, অ্যামাজনে যে মানুষের বাইরেও শত শত কোটি প্রাণ আছে, ব্রাজিল কি তাদেরও নাগরিকতা দিয়ে রেখেছে? তাদের সঙ্গে কি ব্রাজিলের কোনও সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট আছে? কীসের বলে তবে অ্যামাজানের প্রশ্নে সার্বভৌম ক্ষমতার দম্ভ? অখণ্ড আকাশে সীমারেখা টেনে ‘আকাশসীমা’ নির্ধারণের লিগ্যাসি মানুষ কোথায় পায়? আকাশসীমা অতিক্রম করে অ্যামাজন দুনিয়াব্যপী ২০ শতাংশ মানুষকে অক্সিজেন দিলে ব্রাজিলের সার্বভৌম ক্ষমতার জাতিরাষ্ট্রের কাঁটাতার আর আকাশসীমা তা আটকাতে পারে না কেন? সেটা যখন পারে না, তখন সেই বনভূমি নিয়ে বিশ্বমানুষের উদ্বিগ্নতাকে কেন তারা আটকাতে চায়, সার্বভৌমত্বের উছিলায়? আমরা কি প্রশ্ন তুলব না, জঙ্গল-বনভূমি-নদীনালা-অসংখ্য অগণন প্রাণ রক্ষার অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতিগুলোর পাশাপাশি এসবের সঙ্গে সংলগ্ন আদিবাসী মানুষদের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতার দাপটে সামরিক বলপ্রয়োগ ও সম্মতি উৎপাদনমূলক কর্তৃত্ব কায়েম করা, আর এরই বিপরীতে সার্বভৌম সীমা অতিক্রমকারী বহুজাতিক খনিজ কোম্পানির জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার লিগ্যাসি কি?
লেখক: সহ-বার্তা সম্পাদক, বাংলা ট্রিবিউন