সৌদি থেকে নারী কর্মীদের ফিরে আসার খবর ইদানীং নিত্যদিনের খবরে পরিণত হয়েছে। খেতে না দেওয়া, স্বাভাবিক কর্মঘণ্টার অনেক বেশি সময় কাজ করানো, যে কাজের কথা বলে নেওয়া হয় তার বাইরে নানা ধরনের কাজ করানো ছাড়াও আরও বীভৎস যে অত্যাচারের মাঝে তারা পড়ে তা হলো ভয়ংকর শারীরিক, মানসিক আর যৌন নির্যাতন। সৌদি থেকে নিঃস্ব হয়ে আসা মানুষগুলোর কথাতেই উঠে আসে এই বীভৎসতা।
কিছুদিন আগে বিবিসি’র রিপোর্টে উঠে এসেছে হতভাগ্য এক নারীর কথা। যে বলছিল “যাবার পর এক সপ্তাহ ভালো ছিল। এর পরে দিয়া তারা নির্যাতন করছে। তারা আমাকে বলছে আমি এই ধরনের কাজকাম করবো। আমি কইছি, ‘না, আমি আপনার বাসায় আসছি কাজ করতে। আমি এইগুলো করতে আসি নাই।”
কিন্তু তাতে কপালে জুটেছে নির্যাতন। তার বর্ণনা দিতে গিয়ে এই নারী বলছিল, ‘না দিলে তারা আমাকে মারতো, মুখ বাইন্ধা রাখতো, হাত বাইন্ধা রাখতো। ছেলেও আসতো, ছেলের বাবাও আসতো।’
ডয়েচে ভেলে বলছে, গত বছরের আগস্ট মাসে সৌদি আরবে বসবাসকারী এক বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওটিকে নিয়ে তখন অনেক সংবাদমাধ্যম খবর পরিবেশন করে এবং শেষ পর্যন্ত নির্যাতনের সত্যতাও পাওয়া যায়। নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার পথে রিয়াদ বিমানবন্দরে উড়োজাহাজে বসে এক আরবকে ওই নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিলেন সেই নারী, যা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেন সেই ব্যক্তি। ভিডিওতে ওই নারীর এক হাতে ক্ষতচিহ্ন, আরেক হাতে গোটা গোটা ফোস্কা দেখা যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘সৌদি আরবে কাজে আসার পর প্রতিদিন আমাকে ছয় থেকে সাতবার গরম কিছু দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো। সেই থেকেই হাতে ফোস্কা হয়ে গেছে।’
গত বছরের ১৯ মে বাংলাদেশে ফিরে আসা ৬৬ জন নারীর একজন বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের জানান, ‘সৌদি আরবে প্রতিনিয়ত নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সেখানে তাদের আটকে রেখে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার পাশাপাশি রড গরম করে ছ্যাঁকা পর্যন্ত দেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট রেখে দিয়েছে মালিক। আমি সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আসি। দূতাবাস থেকে আমাকে আউটপাস দিয়ে দেশে পাঠায়। আমি এক বছর কাজ করেছি। কিন্তু বেতন দিয়েছে তিন মাসের। তার ওপর আমাকে ওরা গালাগালি করতো, খেতেও দিতো না ঠিকমতো।’
আরেকজন ভুক্তভোগী জানান, ‘সৌদি আরব যাওয়ার জন্য মিরাজ নামের এক দালালকে ৬০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। সে আমাকে বলেছিল, সৌদি আরব অনেক ভালো জায়গা। কিন্তু যাওয়ার পর প্রথমে আমাকে এক মালিকের কাছে বিক্রি করা হয়। মালিকের অত্যাচারে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। তখন আমারে ধরে একটা কোম্পানির মাধ্যমে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়। আমার মতো আরও কয়েকশ’ মেয়ে আছে সেখানে। তাদের দিয়ে জোর করে দেহ ব্যবসা করানো হয়। আমি একবার সুযোগ বুঝে আমার স্বামীকে ফোন করে সব বলি। তারপর আমাকে সৌদি আরবে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়।’
এই বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে বিবিসি আবার তাদের রিপোর্টে বলে—উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম বলছে—গত বছর ১৩শ’র বেশি নারী শ্রমিক পালিয়ে দেশে চলে এসেছেন, যাদের মধ্যে অন্তত ৫ জন ধর্ষণের কারণে গর্ভবতী ছিলেন। কিন্তু এই সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে, কেননা বেশিরভাগই এই তথ্য চেপে রাখেন। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামে সাইকো-সোশাল কাউন্সিলর মাহমুদা আক্তার বলছেন, মাঝে মাঝে খুব ভয়ংকর সব পরিস্থিতির শিকার নারীরা কেউ মানসিক বিকারগ্রস্ত অবস্থায়, কেউবা বাক-শক্তিহীন অবস্থায় ঢাকায় পৌঁছান।
অনুমিতভাবেই এসব অভিযোগ স্বীকার করে না বেসরকারি খাতে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রা। এর মহাসচিব নির্যাতনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি পত্রিকাকে বলেন, ফিরে আসা নারী কর্মীদের সব অভিযোগ সত্য নয়। তার দাবি, বিদেশে গিয়ে আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেকে ফিরে আসছেন।
এই দেশের ব্যবসায়ীরা নাগরিকদের স্বার্থের কথা খেয়াল রাখবেন সেটা এক রকম দুরাশা, তাই সেটা করছিও না। কিন্তু গত বছরই এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীও এই হতভাগাদের ব্যাপারে একইরকম নির্লিপ্ততা দেখিয়েছিলেন। তৎকালীন মন্ত্রী নূরুল ইসলাম এই প্রত্যাগতদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘নারী শ্রমিক দেশে ফিরে আসার মূল কারণ হলো তাদের খাদ্য সমস্যা ও ভাষা সমস্যা।’
অথচ নাগরিকদের প্রতি ন্যূনতম সংবেদনশীলতা থাকলে কোনও দেশ কী করতে পারে, সেটার উদাহরণ হতে পারে ফিলিপাইন, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া কিংবা শ্রীলংকার মতো দেশগুলো। ফিলিপাইন বেশ কয়েকবার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। নেপাল ২০১৬ সালে নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া অবৈধ ঘোষণা করেছে। বেশ কয়েকবার শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলংকা।
নারী শ্রমিক পাঠাতে বাংলাদেশকে আগ্রহী করতে বলা হয়েছিল—একজন নারী কর্মী গেলে দু’জন পুরুষ কর্মী যেতে পারবে। ফোন ব্যবহার করতে দেবে, ঠিকমতো বেতন দেবে, কোনোরকম অত্যাচার হবে না, এমন নানা আশ্বাস দিয়ে ২০১৫ সালে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এই ব্যাপারে। বলা ভালো এই চুক্তিও তেমন কার্যকর ছিল না। উল্লেখ্য, এর আগে বেশ কিছুদিন সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রেখেছিল।
কিছুদিন পর পরই পত্রিকার হেডলাইন হয় সৌদি ফেরত হতভাগ্য নারী শ্রমিকরা। তাদের নিয়ে টকশো হয়, লেখা হয়, রিপোর্ট হয়, মানবাধিকার কর্মীরা সোচ্চার হয়, হয় না কেবল তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন। কারণ তারা সমাজের সেই জায়গা থেকে আসে, যেখানে আগুনে পোড়া, বন্যায় ভাসা, না খেতে পাওয়া, সবকিছুই খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তার ওপর তারা নারী। সরকার সৌদি আরবের সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, খাসোগির হত্যাকাণ্ডের পর সৌদির অলিখিত বাদশা মোহাম্মদ বিন সালমান যখন ভীষণ আন্তর্জাতিক চাপে প্রায় একঘরে হয়ে পড়েছিলেন, তখন সেই দেশ সফরে গিয়ে তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে একমাত্র বাংলাদেশ। অথচ এতো কিছুর পরও সৌদিকে ন্যূনতম চাপ দেওয়া দূরেই থাকুক, আলোচনার মাধ্যমেও পরিস্থিতি পাল্টাতে পারেনি সরকার। ঠিক যেমন পারেনি কথিত অতি ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ ভারত, চীন বা রাশিয়া থাকার পরও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠাতে।
সৌদি আরবে নারী কর্মীদের পাঠালে তার ফল কী হতে পারে, সেটা নিজেদের নারীদের পাঠিয়ে হাতে কলমে বোঝার তো দরকার ছিল না। সৌদিতে নারী কর্মী পাঠানো একাধিক রাষ্ট্র নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে প্রমাণ করেছে ওই দেশটি নারীদের জন্য ন্যূনতম নিরাপদ হওয়া দূরেই থাকুক, ভয়ংকর বিপদসংকুল। এটা ইতোমধ্যে প্রমাণিত, এরকম একটা দেশের আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা যাবে না কোনোভাবেই। সত্য গোপন করে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে নারীদের সৌদিতে পাঠানোর সব চেষ্টা এখনই বন্ধ করা উচিত। নানা মানদণ্ডে আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা নেপালের মতো দেশও এটা পেরেছে, আমাদের এটা না পারাটা ভীষণ লজ্জার।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিমকোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য