মদ, জুয়া এবং ক্লাব কালচার

আনিস আলমগীরক্লাব বিষয়টিকে নাগরিক সভ্যতার অঙ্গ হিসেবে ধরে নেওয়াটা দেশে-বিদেশে প্রথমে শুরু করেছিল ব্রিটিশরা। কেননা ব্রিটেনই প্রথম ক্লাবের মাধ্যমে সমমানের ভদ্রলোকদের একত্র করে সময় কাটানোর আড্ডা শুরু করেছিল। দুনিয়ার প্রথম বিখ্যাত ক্লাবটির নাম ছিল হোয়াইটস (white’s)। এটার জন্ম লন্ডনে, ১৬৯৩ সালে। এখনও বিশ্বের সবচেয়ে দামি এবং প্রাচীন জেন্টলম্যান’স ক্লাব হিসেবে ব্রিটেনের হোয়াইটসের স্থান শীর্ষে।
ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পত্তন হয়েছে বহু আগে। সুতরাং সেই হিসেবে ব্রিটেনের সমাজে রাজনীতির প্রভাব রয়েছে। ক্লাবগুলোর ওপরও রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করতো। ‘হোয়াইটস ক্লাব’ ছিল রক্ষণশীলদের দ্বারা পরিবৃত্ত আর ‘ন্যাশনাল ক্লাব’ ছিল উদারনৈতিকদের ক্লাব। প্রবীণ পণ্ডিতরাও একটা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার নাম ছিল ‘অ্যাথেনিয়াম’ (Athenaeum Club)। এই ক্লাবটি এখনও আছে। এটার সদস্য হওয়া ‘ফ্রান্স একাডেমি’র সদস্য হওয়ার মতোই গৌরবের মনে করা হয়।
ব্রিটেনের এসব ক্লাবে মেয়েরা যেতে পারত না। সে কারণে ব্রিটেনের রমণীকুলও সেই সময়ে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সপ্তম এডওয়ার্ডের স্ত্রীর নামে প্রথম লেডিস ক্লাব ‘আলেক্সান্দ্রা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখানে পুরুষের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। সপ্তম এডওয়ার্ড রাজা হওয়ার পূর্বে তিনি যখন প্রিন্স অব ওয়েলস ছিলেন, তখন একবার ক্লাবে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে ক্লাবে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসেও ছিল ক্লাব কালচার। ফরাসি বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল দুটি ক্লাব থেকে।

ব্রিটেনে মফস্বলের পানশালাগুলো ছিল গ্রামের ক্লাব। আগেই বলেছি ক্লাব সংস্কৃতির পত্তন করেছিল ইংরেজরা। একটা কথা প্রচলিত আছে, ১০ জন ইংরেজ একত্র হলে ক্লাবের পত্তন ঘটায়। ব্রিটিশরা এদেশে শাসনক্ষমতা কব্জা করে ১৭৫৭ সালে। একশ বছরের মাঝে সমগ্র উপমহাদেশে তারা ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সঙ্গে সঙ্গে এই উপমহাদেশে ক্লাব সংস্কৃতিও ছড়িয়ে পড়ে।

ঢাকা ক্লাব, চট্টগ্রাম ক্লাব, কলকাতার বেঙ্গল ক্লাব খুবই প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত ক্লাব। ব্রিটিশরা এসব প্রতিষ্ঠা করে। স্বদেশিরা ক্লাব আক্রমণ করতো কারণ রাতের বেলা ইংরেজদের ক্লাবে পাওয়া যেত। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামের রেলওয়ে ক্লাব আক্রমণ করেছিলেন। সেই আক্রমণের সময় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মৃত্যু হয়েছিল। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন আত্মত্যাগী শহীদ বীরাঙ্গনা। তারা চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে ‘সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন’ করেছিলেন, স্বাধীনতা লাভের কামনায়। মাস্টারদা সফল হতে পারেননি। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে তারা ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসি হয়েছিল।

বর্তমান সময়ের আলোচিত ক্যাসিনো ক্লাব হচ্ছে সম্পদশালী লোকদের আড্ডার ছলে জুয়া খেলার স্থান। অনেকেই ক্যাসিনোকে ব্যবসা হিসেবেও চালু করেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন সফল ব্যবসায়ী। তার প্রধান ব্যবসা হচ্ছে ক্যাসিনো আর ভূমি বেচাকেনা। আমি নিজেও আমেরিকা সফরে গিয়ে দুইবার নিউইয়র্ক থেকে আটলান্টিক সিটিতে গিয়ে ট্রাম্পের ‘তাজমহল’ নামক ক্যাসিনোতে খেলতে গিয়েছিলাম প্রবাসী বন্ধুদের সঙ্গে। এখন সেটার নাম বোধহয় চেঞ্জ হয়েছে। আমার জুয়া ভাগ্য খুব খারাপ, দু’বারই তা প্রমাণিত হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগম্যাধমে দেখেছি বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিদেশে ক্যাসিনো ব্যবসা আছে। লন্ডনে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে তার আয়ের উৎসের কথা বলতে গিয়ে নাকি ক্যাসিনোর কথা বলেছেন। অবশ্য এটা কেউ নিশ্চিত করেননি, তিনি ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে আয় করেন, নাকি ক্যাসিনোর ব্যবসা থেকে আয় করেন।

বাংলাদেশ অঞ্চল দখলের মধ্য দিয়ে ভারতে ইংরেজ রাজত্বের সূচনা। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষও দীর্ঘ দিনব্যাপী ক্লাব সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত। ঢাকা ক্লাব এবং চট্টগ্রাম ক্লাবের মতো অভিজাত ক্লাবের সদস্য পদ এখন লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। ঢাকা ক্লাব ছাড়াও ঢাকায় গুলশান, বনানী, উত্তরাসহ অনেক সোশ্যাল ক্লাব রয়েছে। সেখানে মদ বিক্রি অতি সাধারণ ঘটনা, তাস খেলাও সাধারণ বিষয়। হয়তো তাসের আসরে জুয়াও চলে। দেশের আইনে সেটাও অপরাধ। তবে জুয়া চললেও সেটা অন্যায় চোখে দেখে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা, যেহেতু এটা বাণিজ্যিকভাবে হচ্ছে না এবং অন্যদের খেলার সুযোগ নেই, শুধু ক্লাব সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

ঢাকায় সাম্প্রতিক আলোচিত ক্লাবগুলো হচ্ছে স্পোর্টস ক্লাব। বেশ কয়েকটি স্পোর্টস ক্লাবে হামলা দিয়ে র‌্যাব-পুলিশ সেখানে স্থাপিত ক্যাসিনো বন্ধ করেছে, অনেক জুয়াড়িকে আটক করেছে, যারা ক্যাসিনো চালায় তাদের সবাইকে না পেলেও কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। এক সময় ঢাকা শহরের গুলিস্তান সিনেমার পূর্ব দিকে এবং বঙ্গভবনের সামনে, যেখানে এখন মহানগর নাট্যমঞ্চ তৈরি হয়েছে সেখানে, মোহামেডান ক্লাব, ভিক্টোরিয়া ক্লাব এবং ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ইত্যাদি ক্লাব ছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখান থেকে ক্লাবগুলো সরিয়ে ফকিরাপুল এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং আরও বহু নতুন নতুন ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে আবাহনী ক্লাব অন্যতম। আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। সাম্প্রতিক অভিযানে এই ক্লাবে হানা দেওয়া হয়নি এবং তারা জুয়ার আসর বসায় তাও কখনও শোনা যায়নি। বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সুনামের সঙ্গে যুক্ত শেখ রাসেল ক্লাব, শেখ জামাল ক্লাব বা আবাহনী ক্লাব সম্পর্কে জুয়া-ক্যাসিনো চালানোর কোনও অভিযোগ কেউ তুলতে পারেনি এখন পর্যন্ত।

পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে কলকাতা মোহামেডান ক্লাবের অবদান ছিল। মোহামেডান ক্লাব আর মোহনবাগানের মাঝে ফুটবল খেলা হলে নাকি কলকাতা শহর কেঁপে উঠতো। সাধারণত কলকাতার মুসলমানরা মোহামেডান ক্লাবের পেছনে থাকতো, হিন্দুরা থাকতো মোহনবাগানের পেছনে। আমাদের স্পোর্টস ক্লাবগুলো পাকিস্তান আমলে ফুটবল প্রতিযোগিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। স্বাধীনতার পরেও ফুটবল নিয়ে ছিল ক্লাবগুলোর ব্যস্ততা। সবটির ছিল রমরমা অবস্থা।

ঢাকা-কলকাতার ক্লাবগুলোতে পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমলেও হাউজি খেলা প্রচলিত আছে। হাউজিকেও এক প্রকার জুয়া খেলা বলা চলে। তবে আইনের চোখে একে জুয়া বলা কঠিন। যারা এটি খেলার অনুমতি দেন, তারা এটার নাম রেখেছেন ‘ম্যাথমেটিক্যাল গেম’। আর খেলার উদ্দেশ্যে জমায়েতকে এরা আইনের ভাষায় নাম রেখেছেন ‘সামাজিক সমাবেশ’।

ক্লাবগুলো তাদের আয়ের উৎস হিসেবে এটাকে বেছে নিয়েছে সরকারের অনুমতি নিয়ে। বছর কয়েক আগে হাইকোর্ট মতিঝিল পাড়ার এসব ক্লাবের হাউজিকে জুয়া আখ্যায়িত করে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু জুয়াড়িদের হয়ে কেউ একজন আপিল করার ফলে সেই আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। তারপরই মূলত হাউজির সঙ্গে কয়েকটি স্পোর্টস ক্লাবে ক্যাসিনো চালু হয় বিদেশি এক্সপার্টদের তত্ত্বাবধানে। এই জুয়া জোরেশোরে বিস্তৃত হয় দেশের অন্যান্য জেলার ক্লাবগুলোতেও। ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবেও সপ্তাহে একদিন শুধু হাউজি খেলা হয়, প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে। মূলত বাইরের লোকেরা এতে অংশ নেয়। সদস্যরা খেলেন না বললেই চলে।

সম্প্রতি ঢাকার ক্লাবগুলোতে পুলিশ-র‌্যাবের অভিযানে যেটা বেরিয়ে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ক্যাসিনো ব্যবসাটা করছে সরকারি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। পুলিশ সেটা ওয়াকিবহাল এবং ক্যাসিনোর গডফাদারদের সঙ্গে পুলিশও তার ‘ফেয়ার শেয়ার’ পেয়ে আসছে। উন্নত দেশে ক্যাসিনো একটা সাধারণ বিষয় হলেও আমাদের দেশে ক্যাসিনোর কোনও অনুমোদন এখন পর্যন্ত সরকার দেয়নি। আমাদের অনেক টাকাওয়ালা লোক শুধু ক্যাসিনোতে খেলতে যাওয়ার জন্য সিঙ্গাপুর-নেপাল যাচ্ছেন। টাকা উড়িয়ে আসছেন। এসব বিবেচনায় হয়তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সরকার খুব তাড়াতাড়ি ক্যাসিনোর অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে।

অবশ্য অনেকে মনে করেন, ক্যাসিনো ক্লাবের অনুমোদন দেওয়ার সময় হয়েছে কিনা তা ভেবেচিন্তে দেখা দরকার। আমাদের কোনও বিষয়ে কাণ্ড-জ্ঞান নেই। দেশে চার-পাঁচ শত দৈনিক পত্রিকা, ৪০-৪৫টি টেলিভিশন চ্যানেল অনুমোদন দিতে সরকার অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেনি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপনের ওপর চলে। দেশে কত টাকার বিজ্ঞাপন রয়েছে, সেই বিজ্ঞাপন দিয়ে এতগুলো প্রতিষ্ঠান চলবে কিনা তার কোনও হিসাব-নিকাশ না করে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনের ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক ভিত্তির চেয়ে দেখা হয়েছে লাইসেন্সের আবেদনকারী ব্যক্তি সরকারের প্রতি কতটা অনুগত সেটি। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকবে কিনা, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এখন। অনেক প্রতিষ্ঠান তার সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না।

ক্যাসিনোর ব্যাপারে বেতনের প্রশ্ন জড়িত নেই। তবে এই জুয়া খেলাটা এমন যে ‘সকাল বেলা রাজা রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা’। তাই মহল্লায় মহল্লায় ক্যাসিনো ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে জাতিকে পথে বসিয়ে শেষপর্যন্ত সমাজে একটা ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি যেন না হয়, তাও চিন্তা করতে হবে। উন্নত দেশেও শুধুমাত্র একটা বিশেষ জোনে ক্যাসিনো পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়, যাতে সর্বসাধারণের নাগালের বাইরে থাকে এটা এবং লোকজন যেন সারাক্ষণ জুয়ায় মত্ত না হয়। আপাতত সমাজের আর্থিক উন্নতি হওয়া ব্যতিরেকে শহরের যেখানে সেখানে, যাকে তাকে ক্যাসিনোর লাইসেন্স না দেওয়াই উত্তম হবে মনে করি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

anisalamgir@gmail.com