শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখুন

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীদীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে এবং প্রশ্নাতীত ক্ষমতা উপভোগ করলে ক্ষমতা-সংশ্লিষ্টদের মন থেকে নীতি দুর্নীতির বোধ লুপ্ত হয়ে যায়। গত সপ্তাহব্যাপী ছাত্রলীগ-যুবলীগের ওপর অভিযান পরিচালনা করার পর যে তথ্য-উপাত্ত বের হয়ে আসছে তাতে ওপরে উল্লেখিত সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি দলের পাতি নেতাদের ঘরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে বস্তা বস্তা টাকা আর সের-মাপা সোনাদানা। রাঘববোয়ালরা তো এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের ধরা হলে হয়তো আরও অবাক হতে হবে। বিরোধী দলের কেউ কেউ এটা অভিযানকে কটাক্ষ করছেন। কিন্তু বিরোধী দলের উচিত প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো, যাতে অপারেশন জোরদার হয়। দুর্নীতিবাজরা উপযুক্ত সাজার আওতায় আসে।

সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত হয়ে আসাটা কঠিন কিছু ছিল না। তারা নির্বাচিত হয়ে এসে পুনরায় সরকার গঠন করেছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে পুনরায় আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে। অবশ্য নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কিন্তু বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনি ফলাফল মেনে নিয়ে সংসদে যোগদান করেছে।

অবশ্য বিএনপির সংগ্রাম করা উচিত ছিল পুনর্নির্বাচনের দাবিতে। তারা সেটা না করে সংসদে যোগদান করেছে। সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্ত বিএনপির নৈতিক পরাজয়। অবশ্য এটাও সত্য, আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার সামনে তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করতে অপারগ হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে হয়। তবে বিএনপিতেও নৈতিকতাসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। কারণ, ক্ষমতায় থাকতে এত ব্যাপক দুর্নীতি করেছিল যে, তারাও নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

দাউদকান্দির লোকেরা বলেন, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নামে পৈতৃক সূত্রে পাঁচ কাঠা জমিনের একটা খতিয়ান ছিল না। এখন নাকি তার আছে দেড় হাজার কোটি টাকার সম্পদ। আমানউল্লাহ আমান নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। এখন তিনি অঢেল সম্পদের মালিক। খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন এরা সবাই শত শত কোটি টাকার মালিক। সাদেক হোসেন খোকা, মির্জা আব্বাসের সম্পদের খবর তো সবারই জানা। এসব সম্পদের নিরাপত্তার জন্যই বিএনপির নেতারা আন্দোলনের ঝুঁকি নেন না।

আওয়ামী লীগে হাজার হাজার ত্যাগী কর্মী ছিল, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল। সবাই মনে করেছিল আওয়ামী লীগের শাসনকাল অন্যের মতো হবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে দুর্নীতিবাজদের কনুইয়ের ঠেলায় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা মাঠছাড়া। গত এক সপ্তাহব্যাপী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান চলছে তাতে যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাদের অন্যায়ের যেই ইতিবৃত্ত বের হয়ে এসেছে তা নিকৃষ্টতম কলঙ্কময়। যে শুদ্ধি অভিযানের সূচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে পারবেন কিনা জানি না। তবে অভীষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া উচিত।

যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী অভিযানের শুরুতে বিরূপ সুরে কথাবার্তা বলা শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছেন এটা নাকি বিরাজনীতিকরণের উদ্যোগ। যেসব এলাকায় ক্যাসিনো রয়েছে সেসব এলাকার থানার ওসি-র‌্যাব কর্মকর্তাকেও নাকি গ্রেফতার করা উচিত। সত্তর বছর বয়স্ক এই যুবনেতা অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চাইলেন কেন জানি না। তিনি ৭ বছর ধরে যুবলীগের সভাপতি। তার ছত্রছায়ায় যুবলীগের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি হয়েছে সারা দেশে। এর দায় তিনি অস্বীকার করেন কীভাবে!

আমরা যারা ওমর ফারুক চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, তারা জানি তিনি কোন ঘরানার লোক। তার বাবা ডাক্তার লাল মিয়া চৌধুরী চট্টগ্রামের রাউজান থানার কুখ্যাত ফজলুল কাদের চৌধুরীর ডানহাত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ওমর ফারুক চৌধুরী রাউজান হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে চট্টগ্রাম শহরে এসে মতিন বিল্ডিংয়ে থাকতেন। কখনও কোনও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। এখন দেখছি তিনি যুবলীগের মতো প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। হয়তো শেখ পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে তিনি এই পদ পেয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে তার সময় যুবলীগে ফ্রিডম পার্টি, বিএনপি’র লোকজন এসে ভিড় করেছে এবং বিভিন্ন পদ পদবি পেয়েছে। টাকার বিনিময়ে অন্য দলের সন্ত্রাসীদের তিনি দলের পদ পদবি দিয়েছেন- এই অভিযোগ উঠেছে এখন।

র‌্যাব-পুলিশের হাতে ধৃত খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম- যে দুইজন সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তারা একজন এসেছেন ফ্রিডম পার্টি থেকে, আরেকজন এসেছেন বিএনপি থেকে। পত্রিকায় দেখেছি, তিনি তার অফিসের একসময়ের পিয়ন কাজী আনিসুর রহমানকে দফতর সম্পাদক করেছেন। সে নাকি মাঝে মাঝে কম্পিউটারে যুবলীগের টাইপের কাজ করতো। যুবলীগের কি কোনও নেতা ছিল না যাকে দফতর সম্পাদক করা যেত? এখন ওই পিয়ন প্রতারণা করে গাড়ি বাড়ি সব করেছে। তাকে নাকি যুবলীগ অফিসে চেয়ারম্যান ফারুকের ক্যাশিয়ার হিসেবে সবাই জানেন।

ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের চেয়ারম্যান হিসেবে সফল হননি। তার বয়স হয়েছে। তার ছেলেমেয়েরা এখন যুবলীগ করার কথা। এখন তার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা উচিত। আমরা এযাবৎ ঠিকাদার কিং, ক্যাসিনো কিং দুইজনের মুখ থেকে বের হয়ে আসা কিছু তথ্য পেয়েছি। তাতে বেশি শঙ্কিত হয়েছি। ঠিকাদার কিং জি কে শামীমের কথা শুনেছি। তিনি নাকি দুই প্রকৌশলীকে ঘুষ দিয়েছেন দেড় হাজার কোটি টাকা। গণপূর্তমন্ত্রীকে নাকি টাকা পৌঁছাতেন বস্তাভর্তি করে। আমরা জেনেছি তিনি অনেক বহুতল ভবন করেছেন। দেশের বড় বড় প্রজেক্ট তার হাতের বাইরে যেতে পারতো না। গণপূর্ত দফতরের ২০ জন শীর্ষ অফিসারকে মাসে নাকি দুই থেকে তিন লক্ষ টাকা করে দিতেন।
এখন সন্দেহ হচ্ছে তিনি কাজগুলো মানসম্মতভাবে করেছেন কিনা। যে পয়সা খরচ করেছেন তাতে তো মনে হয় না কোনও ইঞ্জিনিয়ার মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে পেরেছে। সম্প্রতি পত্রিকায় দেখেছি, তিন মাস আগে বিটুমিন কার্পেটিং করা একটি রাস্তা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই ঠিকাদার মানসম্মত কাজ করেনি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, তিনি যেন এই শুদ্ধি অভিযান থেকে বিরত না হন। মাও সেতুংও চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিলেন। প্রত্যেকের প্রদত্ত জবানবন্দিতে যাদের নাম আসে তাদের সহায়-সম্পদের খোঁজ-খবর রাখেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com