শেখ হাসিনার ভারত সফর কতটা ফলপ্রসূ হবে

আনিস আলমগীরপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৩ অক্টোবর ভারত সফরে যাচ্ছেন। চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটাই শেখ হাসিনার প্রথম ভারত সফর। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাপক কোনও বিরোধ নেই এখন। উভয়ের মাঝে মুখ্য বিরোধ হচ্ছে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে। ২০১১ সালে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে তিস্তার পানিবণ্টন বিষয়ে চুক্তি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনাগ্রহের কারণে চুক্তিটি হতে পারেনি। প্রায় চার দশক ধরে তিস্তা পানিচুক্তি নিয়ে কথা হচ্ছে। এরমধ্যে একাধিকবার ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বাস দেওয়ার পরও এই চুক্তির অনিশ্চয়তা কাটছে না। চুক্তিটির মূল বৈশিষ্ট্য হলো—বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন ৫৪ নদীর ক্ষেত্রে তিস্তা চুক্তির খসড়া ব্যবহার করা যাবে।
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও ভারত সরকার চুক্তির ব্যাপারে কোনও দ্বিমত করেনি। এখনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছেন কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় শাসনতন্ত্র মোতাবেক যে চুক্তি সম্পাদন করা হবে, তা যদি কোনও রাজ্যের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে হয়ে থাকে, তবে সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি প্রয়োজন হয়। যা হোক, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৮ বছর হয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ চুক্তি ছাড়াই চলেছে। তিস্তার পানি নিয়ে হয়তোবা বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আরও কয়েক বছর চলতে হবে।

ভারত গঙ্গার ব্যাপারেও দীর্ঘদিন অহেতুক কথাবার্তা বলে সময় কাটিয়েছে। ভাটির দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীর পানি বাংলাদেশ যে পাবে, সেই সত্যটা ভারত সহজে অনুধাবন করার চেষ্টা করে না। বড় দেশ হিসেবে ভারত নিজের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বেশি, কিন্তু দেব গৌড়া যখন প্রধানমন্ত্রী, তিনি তখন গঙ্গার বিষয়ে বাড়াবাড়ি ত্যাগ করে ৩০ বছরের জন্য একটি চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদন করেছিলেন। তখন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের সন্তান, সোনারগাঁয়ে ছিল তার বাড়ি। প্রবীণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। আন্তর্জাতিক আইনকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়ার মধ্যে গঙ্গার পানি নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল তাতে বাংলাদেশের গঙ্গা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগে ভারতের সম্মতির কথা উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশের নদীর নাব্য রক্ষার জন্য গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে একটা জলাধার সৃষ্টি করার প্রয়োজন বহু আগে থেকে ছিল। সত্যি কথা বললে, পদ্মা সেতুর চেয়েও গঙ্গায় বাঁধ দেওয়া জরুরি ছিল।

২০২৬ সালে গঙ্গার পানি চুক্তি শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশ গঙ্গা ব্যারাজ বাস্তবায়ন করতে চায়। ২০১৪ সালে এই প্রকল্পের সারসংক্ষেপ ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশ ৪ বিলিয়ন ডলারের ব্যারাজ নির্মাণের বিষয়ে উদ্যোগী হয়। কারণ, ভারত ১৯৭৫ সাল থেকে ফারাক্কা ব্যারাজের মাধ্যমে ৪০ হাজার কিউসেক পানি অন্যদিকে সরিয়ে নিচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে ভারত বাংলাদেশকে পর্যাপ্ত পানি দিচ্ছে না, আবার বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানিতে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। বিহার, পাটনা ও মালদা এলাকায় বন্যার কারণে ভারত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ বিকালে ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেট খুলে দিয়েছে। তাতে এপারে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার পদ্মা নদীতে হুট করে পানিপ্রবাহ বেড়ে গেছে। ফলে নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। 

প্রধানমন্ত্রী এই সফর মূলত ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটে যোগদান উপলক্ষে। ইন্ডিয়ার অনুরোধে দ্বিপক্ষীয় মাত্রাও যোগ করা হয়েছে। ফলে সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, যদিও এরমধ্যে দুই নেতা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে গিয়ে নিউ ইয়র্কে বেশ কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছেন। ৫ অক্টোবর হায়দরাবাদ হাউসে দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর উভয় দেশের মধ্যে কিছু চুক্তি সম্পাদন হওয়ারও সম্ভাবনা আছে বলে বাংলাদেশি মিডিয়া আভাস দিয়েছে।

তিন অক্টোবর শেখ হাসিনা দিল্লি বিমানবন্দর থেকে সরাসরি তাজ প্যালেস হোটেলে যাবেন। সেখানে ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিট অনুষ্ঠিত হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম আয়োজিত এই দীর্ঘ সম্মেলনে বাংলাদেশের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির কাহিনি শোনার জন্য শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই সম্মেলনে যোগদান ছাড়াও শেখ হাসিনা ভারতের শীর্ষ বণিকসভার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন এবং ভারতকে বাংলাদেশে যে তিনটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন দেওয়া হয়েছে তাতে বিনিয়োগ করার জন্য ভারতীয় শিল্পপতিদের প্রতি সরাসরি আহ্বান জানাবেন।

বাংলাদেশ সরকারকে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে যে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে, কীভাবে সেই অর্থ ব্যয় হবে, তার রূপরেখা ঠিক করা ছাড়াও সই হয়েছে আরও তিনটি সমঝোতা স্মারক। বাংলাদেশ বেশিরভাগ সময় চীন থেকে সমরাস্ত্র ক্রয় করে। এমনকি সাবমেরিনও ক্রয় করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে ভারত নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য হয়তো কিছু সমরাস্ত্র কেনার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করবে, যদিও তাদের সমরাস্ত্রের কোয়ালিটি নিয়ে নিজেদের দেশেই নানা হাস্য-কৌতুক চলে আসছে।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা নিয়ে চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এখন। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের (ইউএনএইচআরসি) অধিবেশনে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুর মানবাধিকার পরিস্থিতি’ নিয়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ভোটাভুটি হয়েছে। তাতে বাংলাদেশ ৩৫ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হলেও সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর। ইউএনএইচআরসির ৪৭ সদস্যের মধ্যে ৩৭ সদস্য বাংলাদেশের পক্ষে, দুই সদস্য বিপক্ষে ও আট সদস্য ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। এরমধ্যে চীন ও ফিলিপাইন বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে এবং ভারত, নেপাল, জাপান, ব্রাজিল, ইউক্রেন, অ্যাঙ্গোলা, ক্যামেরুন ও কঙ্গো ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত, চীন ও জাপান আমাদের পাশে আছে বললেও ভোটাভুটিতে তাদের পাশে না পাওয়া হতাশাজনক। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের সমান্তরাল নীতিতে চলা রাশিয়া বর্তমানে মানবাধিকার পরিষদের সদস্য নয়। প্রস্তাব সম্পর্কিত দেশ হিসেবে মিয়ানমার মানবাধিকার পরিষদে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিলেও সদস্য না হওয়ায় ভোট দিতে পারেনি।

রোহিঙ্গা নিয়ে আমরা বাংলাদেশের মানুষরা মূলত দুই বৃহৎ প্রতিবেশী চীন-ভারতের ভূমিকায় হতাশ। চীন রোহিঙ্গা সমস্যাকে দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের ভূমিকা দৃশ্যত মিয়ানমারের জান্তার পক্ষে। অন্যদিকে বাংলাদেশ আসামের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সময় উলফাকে বাংলাদেশ থেকে সমূলে উচ্ছেদ করে ভারতকে সহযোগিতা করেছে। উলফার শীর্ষ নেতাদের ভারতের কছে হস্তান্তর করেছে। অথচ এখন আমাদের প্রয়োজনে সহযোগিতার ভূমিকা রাখছে না।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করে চীনকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানিয়ে এসেছেন। অথচ জাতিসংঘে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভোট দিতে দ্বিধা করলো না তারা। ভারত এবং চীন নিজ নিজ স্বার্থের প্রাধান্য দিতে গিয়ে মিয়ানমার বিষয়ে কোনও শিথিলতার প্রশ্রয় দেয়নি। আশা করি আমাদের প্রধানমন্ত্রী সব বিষয় বিবেচনায় রেখে ভারতের সঙ্গে কথা বলবেন।

আসামে নাগরিকপঞ্জিতে ১৯ লাখ বাঙালিকে নাগরিকত্বহীন করা হয়েছে। মুসলমানরা ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীকে নাগরিকত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদি দিয়েছেন। কিন্তু ছয় লাখ মুসলমানকে শেষ পর্যন্ত তারা রোহিঙ্গাদের মতো বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবেন, এ আশঙ্কা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে। এ বিষয়ে আসামের অর্থমন্ত্রীসহ বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ নরেন্দ্র মোদি জাতিসংঘের অধিবেশনকালে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে বলেছেন, নাগরিকপঞ্জির বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাগরিকপঞ্জি বিষয়ে এখনও প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। অবশ্য বাংলাদেশের অনড় অবস্থানের কথা তিনি ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো উচিত বলে মনে করি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com