ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না

আনিস আলমগীরবুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর দেশব্যাপী ছাত্র রাজনীতি বন্ধের গুঞ্জন উঠেছে। অনেকে বন্ধ করার পক্ষে বলছেন, যদিও সরকারের তরফ থেকে এমন কোনও সিদ্ধান্ত আসার আলামত নেই। বুয়েটের উপাচার্য গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ছাত্র-শিক্ষকদের যৌথসভায় বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা ঘোষণাও দিয়েছেন। উপাচার্য ছাত্র-শিক্ষকের পরামর্শেই এই ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, বুয়েট কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে তাদের ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধ করতে পারবে। তিনি একক সিদ্ধান্তে কাজ করেননি, ছাত্র-শিক্ষকদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিয়েছেন।
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি তেমন হতো না। তাদের অধ্যাদেশে নাকি ছাত্র রাজনীতির কথা নেই। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেবে কিনা জানি না। তবে অন্যান্য সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এমন সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হয় না। আসলে ছাত্র রাজনীতি তো দোষের কিছু নেই। দোষ তো রাজনীতি যারা করে তাদের। তারাও কলুষিত হয়েছে মূল সংগঠনের কারণে। কারণ কোনোখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে তো যে যার মতো করে তার সংগঠন করত।
নব্বইয়ের পর থেকে যে দল সরকারে যায়, তাদের ছাত্র সংগঠন ক্ষমতার মালিক হয়ে বসেছে। তারাই সিদ্ধান্ত নেয় কোন সংগঠন ক্যাম্পাসে থাকবে, আর কোন সংগঠন থাকবে না। এখন তো আরও উন্নতি হয়েছে। ডক্টর আইনুন নিশাতের এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটিতে কে থাকবে না থাকবে তা স্থির করে। উপাচার্যের কোনও কথা বলার এখতিয়ার পর্যন্ত নেই। আইনুন নিশাত বলেছেন, অথচ বুয়েটের অধ্যাদেশে উপাচার্যকে এত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে ইচ্ছে করলে ভিসি বুয়েট বিক্রি করেও দিতে পারেন।
এত ক্ষমতার পরও উপাচার্যকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রেখেছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নাকি ছাত্রনেতারা ডাকলেই পুলিশ আসে, অথচ আগে পুলিশ ক্যাম্পাসে একমাত্র ঢুকতে পারত উপাচার্য ডাকলে। আইন, রাজনীতি, বিধি-বিধান এখন খাতাপত্রে আছে, প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। আইনের সার্বভৌমত্ব যতক্ষণ প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও শান্তি-স্থিতি কিছুই কোনোখানে আসবে না। আমাদের গণতন্ত্রের সেবকেরা তা হতে দেবেন না।
সবার হৃদয়ে এই বিশ্বাস থাকা দরকার, সবকিছুরই শেষ আছে। বৃহস্পতির পর শুক্রবার আসে, শনিও দেখা দেয়। বৃহস্পতি চিরস্থায়ী না। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে প্রাণ হারানোর পর দীর্ঘ ২১ বছর পথে পথে ঘুরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। তার সামনে বিএনপি’র ব্যর্থতা হিসাব-নিকাশ খোলা রয়েছে। তারা পড়ছে বলে তো মনে হয় না। দেশবাসী আশা করেছিল, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আওয়ামী লীগ চলবে। কিন্তু ব্যর্থ পরিহাস। তারাও ‘লংকায় যে যায় সে রাবণ হয়’—এই প্রবাদ বাক্যের মতো পথ চলছে। সরকারি দল, বিরোধী দল ভাবছে—জনগণ তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। যেমন ইচ্ছে তেমন করে জনগণকে ব্যবহার করবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, আপনি ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, চার নেতার হত্যার বিচার করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। আপনার এবারের বিজয়ের পর মানুষ আশা করেছিল আপনি এই দেশ থেকে দুর্নীতি, মাস্তানি নির্মূল করে দেবেন। কিন্তু সরকারি দলের কিছু লোকের নানা কর্মকাণ্ডে মানুষ হতাশ হয়েছে। এসব কারণে আপনার প্রতি মানুষের আস্থা কিছু শীতল হলেও, এখনও আপনি বাংলাদেশের মানুষের ভরসাস্থল। আপনার বিকল্প এখনও হয়নি। সুতরাং সব এলোমেলো অবস্থাকে ঠিক করতে আপনি আরেকবার দৃঢ় পদক্ষেপ নিন, না হয় সবকিছুরই সর্বনাশ হবে।
আরেকটা বিষয় আপনাকে সতর্ক করব। চাটুকার কখনো বন্ধু হয় না। আপনার চারিদিকে এখন চাটুকারেরা কিলবিল করছে। ঘেরাও করে ফেলেছে আপনাকে। কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদে পদ-পদবি পেয়ে নিজেরাও নিজেদের জন্য চাকুটার গোষ্ঠী তৈরি করেছে। আখের গোছানোর কাজ করছে। এদের ব্যূহ ভেদ করে আপনাকে পাওয়া কঠিন। সুতরাং আপনাকে সর্ব অবস্থায় সজাগ থাকতে হবে। আপনি যদি ব্যর্থ হন, তবে তার দায়ভার এসব চাটুকার নেবে না। আর আপনার ব্যর্থতার জন্য সৃষ্ট দুর্ভোগ পোহাতে হবে জনগণকে।
যা হোক, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার দাবি মানা ঠিক হবে না। নেতা ছাড়া, নেতৃত্ব ছাড়া কোনও কিছুই চলে না। একটা প্রক্রিয়ার মাঝে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। রাজনীতিতে সেই প্রক্রিয়া হচ্ছে ছাত্র রাজনীতি, ছাত্র সংগঠন। সুতরাং যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিষয়ে চিন্তা করেন, তারা নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়া বন্ধ করার কথা বলেন। সমাজ, দেশ নেতা ছাড়া চলবে কী করে! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুজ্জমান, মনসুর আলী, শেখ হাসিনা, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ ছাত্র রাজনীতির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছেন। যাদের নাম উল্লেখ করেছি, তারা কেউ একদিনে নেতা হননি। দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রক্রিয়ার মাঝে থেকে নিজের দক্ষতা অর্জন করে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। জাতির সুখের সময়ও নেতার প্রয়োজন, দুঃখের সময়ও নেতার প্রয়োজন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অসংখ্য ছাত্রনেতা যদি কাজ না করতেন, ময়দানে না থাকতেন, তবে দেশ স্বাধীন হতো কিনা সন্দেহ ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কিন্তু মুসলিম লীগের পাকিস্তান সৃষ্টি কিংবা কংগ্রেসের ভারত সৃষ্টির আন্দোলন-সংগ্রাম নয়। এক কোটি লোক দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গিয়েছিল। নেতারাও চলে গিয়েছিলেন। বিদেশের মাটিতে বসে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করা খুবই কঠিন ছিল। যুবক, ছাত্রনেতারা ক্লান্তিহীনভাবে দীর্ঘ নয় মাস কাজ করেছেন। একদল সম্মুখ যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন, আরেকদল পেছনে প্রস্তুতি নিয়েছেন। সেটা ছিল আত্মত্যাগের এক মহড়া। যারা যুদ্ধ দেখেননি, তারা হয়তো সেই ক্লান্তিহীন কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব বুঝবেন না।
সুতরাং ছাত্র রাজনীতির সামান্য বিভ্রান্তিতে হতাশ হয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কথা চিন্তা করা যাবে না। ছাত্র রাজনীতির প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। ভাড়াটিয়া লোক দিয়ে নেতৃত্ব হয় না। নেতৃত্ব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। নেতৃত্ব ছাড়া একটা জাতি অচল হয়ে যাবে। কারণ রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদরাই অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি—সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশের পাশে দুটি বৃহৎ রাষ্ট্র—ভারত ও চীন। সুসম্পর্ক তাদের সঙ্গে আমাদের আছেই। অদূর ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটতে গেলে বাংলাদেশকেও সেইরকম রাজনীতিবিদ তৈরি করতে হবে। দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লোক থাকতে হবে। রাজনীতিতে মেধাশূন্য লোকের আবির্ভাব হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঝুঁকিতে পড়বে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com