রাশেদ খান মেননকে নিয়ে কিছু কথা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীরাশেদ খান মেনন সম্প্রতি আলোচিত হয়েছেন তিনটি ঘটনার কারণে। প্রথমে আলোচনায় আসেন ক্যাসিনোকাণ্ডে। যে এলাকায় ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা, সেই মতিঝিল এলাকার এমপি তিনি। ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতায় তার নামও উঠে আসে। ফকিরাপুলে ‘ক্যাসিনো’ চালানো ইয়ংমেন্স ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান স্থানীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননের ছবিও ঝুলছে ক্লাব ঘরে। তিনি অবশ্য দাবি করেছেন, এ ক্লাবের ভেতরে জুয়ার আসর বসতো, এমন খবর তার জানা ছিল না। তিনি ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার ক্লাব হিসেবেই সেটাকে জানতেন।
তারপর হঠাৎ করে তিনি বরিশালে দলীয় জনসভায় যে বক্তৃতা দেন, সেটি ভাইরাল হয়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায়। রাশেদ খান মেনন গত সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, তিনি তার সাক্ষী। পরে সেই ঘটনাকে মিডিয়ার অতিরঞ্জন বলে তিনি আবার পাল্টা ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। তার রেশ কাটতে না কাটতেই তিনি আবার আলোচনায় আসেন দলের মধ্যে বিদ্রোহ-ভাঙন নিয়ে। তার দলের পলিটব্যুরোর একজন সিনিয়র সদস্য বিমল বিশ্বাস পদত্যাগ করেছেন তার বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগ তুলে।
মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল। তিনি জোটের শরিক দল হিসেবে মন্ত্রিত্ব করেছেন। তার দল থেকে চার জন এমপিও পার্লামেন্টে রয়েছেন এখন। ১৪ দলে না থাকলে হয়তো এ বিজয় সম্ভব হতো না।

আমাদের নির্বাচন কোনও সহজ-সরল ‘সেরা জিনিস বেছে নাও’ গোচরের প্রতিযোগিতা নয়। তা হওয়া সম্ভবও নয়। সহজ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচন হয়। পাকিস্তানের সময় থেকে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে, কোনও নির্বাচন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে সুনাম অর্জন করতে পারেনি। কখনও পরাজিতরা স্থূল কারচুপির কথা বলেছেন, আবার কোনও সময় সূক্ষ্ম কারচুপির কথা বলেছেন। সূক্ষ্ম-স্থূল কারচুপি ছাড়া কোনও নির্বাচনের কথা গত ৭২ বছর জনগণ শোনেনি। বরিশালের সভায় রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘তিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন ওই নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়নি।’ তিনি নির্বাচনের ১০ মাস পর সাক্ষ্য  দিতে ময়দানে হাজির হলেন কেন, কেউ তার কারণ নির্ণয় করতে পারছে না।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তিনি মন্ত্রী হলে কি একথা বলতেন? ওবায়দুল কাদের এ কথা স্বাভাবিকভাবে বলার কথা।

আবার অনেকে মনে করেন, ‘ক্যাসিনোর ঘটনায় তিনিও কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ধরা পড়তে পারেন। কী জানি—এরকম চিন্তা করেই হয়তো তিনি আবোল-তাবোল বলা শুরু করেছেন! এখন সরকারের বিরুদ্ধে কিছু কথা বলে রাখলে ভালো, যাকে-তাকে ধরা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দিতে পারেন! কী চমৎকার রাজনৈতিক কূটবুদ্ধি!’

আবার পত্রিকার খবর যা বেরিয়েছে তাতে মনে করা হচ্ছে, মেননের কথা মন্ত্রিত্বের জন্যও নয়, বিবেকের তাড়নায়ও নয়। তার দলে ভাঙন প্রক্রিয়া চলছে। সম্ভবত সে প্রক্রিয়া ঠেকানোর জন্য এসব কথা বলছেন। নিজের দলে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে, দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত ছাড়াই স্ত্রীকে মহিলা কোটায় এমপি করা এবং এককভাবে মন্ত্রিত্ব করায় তার দলে নাকি তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আমাদের দেশে ক্ষমতার স্বাদ পেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভোগ করার রেওয়াজ আছে। রাশেদ খান মেনন তার ব্যতিক্রম হতে না পারা দুঃখজনক।

অবশ্য আমি তার প্রশংসা করি শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার ডাক পেয়েও তিনি মন্ত্রী হিসেবে প্রথম ডাকে শপথ নেননি, কারণ তার সঙ্গে আলোচনা না করেই নাকি তাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগের অবস্থা যখন খুবই নাজুক, বিদায় নেয় অবস্থা, মৌলবাদী উত্থান ঠেকাতে তখন তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়েছিলেন। বিদায়ের সুর যখন বেজে ওঠে, সাধারণত তখন কেউ মন্ত্রী হতে চান না।

রাশেদ খান মেনন জীবনে প্রথম কোনও মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। এই প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন না, তাই হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্য প্রধানমন্ত্রীর পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে তার পক্ষে। তবে একথা সত্য, রাজনীতির সমকালীন দুনিয়ায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিরল মানুষ। তিনি উপকারীর উপকার স্বীকার করা লোক। মেনন তার কাছাকাছি ছিলেন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে তার ধারণা নিশ্চয়ই আমাদের চে/চেয়ে বেশি ও স্বচ্ছ।

প্রধানমন্ত্রী তার নিজ দল নিয়ে এখন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। এই সময় ১৪ দলের কোনও ভাঙনের সুর তোলা উত্তম হবে না। ১৪ দল ক্ষমতায় আছে দীর্ঘদিন হলো। সুতরাং ক্ষমতাচ্যুত করার একটা ষড়যন্ত্র থাকা স্বাভাবিক। এই জোটে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুর মতো নেতা আছেন। তারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে বাংলাদেশে তাদের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ আছে বলে মনে হয় না। সর্বোপরি আওয়ামী লীগের মতো সংগঠন যদি তাদের সঙ্গে থাকে, তো কথাই নেই।

এখন কাদা ছোড়াছুড়ি করতে গেলে আওয়ামী লীগের চেয়ে রাশেদ খান মেননই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আওয়ামী লীগ ক্যাসিনো সম্রাট, জিকে শামীম, ওমর ফারুক চৌধুরী—এসবের কারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি  শেখ হাসিনা যে পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছেন, সবকিছুকে ম্লান করে দিয়ে নতুন বছরে নতুন উদ্যোগ নিয়ে অগ্রসর হবেন বলে আশা করি। অঙ্গ-সংগঠনের কোনও বিব্রতকর অবস্থা তাকে সহজে কাবু করতে পারবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই উদ্যোগ তিনি নিজেই নিয়েছেন, তিনিই তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। সহসা সংকট কেটে ওঠার মতো তার সাংগঠনিক শক্তিও আছে, নেতৃত্বও আছে।

রাশেদ খান মেননকে অনুরোধ করবো ১৪ দলীয় যে ঘরানা সৃষ্টি হয়েছে, তাকে যেন কোনোভাবে নষ্ট করার চেষ্টা না করেন। ওয়ার্কার্স পার্টি বাম ঘরানার দল। সুতরাং টুকরো টুকরো হওয়া তাদের নিয়তি। ১৯২৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কমিউনিস্টরা তত্ত্বকথা বলে ভেঙেছে, জোড়া লাগেনি। ভারতের পশ্চিম বাংলায়, ত্রিপুরায় ও কেরালায় তারা ক্ষমতায় ছিল। উল্লেখযোগ্য কিছু যে করতে পেরেছে, তা নয়। অবশ্য জ্যোতি বসু পশ্চিমবাংলার খাদ্য সংকট মোকাবিলা করেছেন।

পশ্চিমবাংলায় আগে খাদ্যের অভাব ছিল। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবাংলায় যাই, তখন দেখেছি পেট ভরে ভাত খাওয়া খুবই কঠিন ছিল। তার থেকে পশ্চিমবাংলাকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। আর কোনও কিছু উল্লেখ করার মতো মনে পড়ছে না। জ্যোতি বসু একবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রায় দ্বারপ্রান্তে ছিলেন, কিন্তু সীতারাম ইয়েচুরির তত্ত্বকথায় হতে পারেননি।

রাশেদ খান মেনন আত্মরক্ষার জন্য আবোল-তাবোল কথা বলে পার্টি রক্ষা করতে পারবেন না। কংগ্রেসে শেষ পরিণতি যা হওয়ার, তাই হবে। সুতরাং মেননের সঙ্গে যারা থাকেন, তাদের নিয়েই তিনি যেন ১৪ দলে থাকেন। একবার মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে এসেছেন। এখন ৭৯-৮০ বছর বয়স চলছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নতুন কোনও পথে পা না বাড়ানোই উত্তম হবে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, রাশেদ খান মেননকে নিয়ে যেন ব্যতিক্রমী এবং বিব্রতকর কোনও পরিস্থিতির সৃষ্টি না করেন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com