বাবরি মসজিদ মামলার রায় ও ‘বিচারিক লজ্জা’

মো. জাকির হোসেনবাবরি মসজিদ আর রামের জন্মভূমি নিয়ে বিতর্ক অনেক বছরের। সংক্ষেপে বাবরি মসজিদ আর রামের জন্মভূমি বিতর্কের ঘটনা হলো, হিন্দুদের একটি অংশের দাবি, অযোধ্যা ভগবান রামচন্দ্রের জন্মভূমি। মসজিদের জায়গাটিতে আগে রামের মন্দির ছিল। পরে মন্দিরের ভগ্নাবশেষের ওপর মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। তবে, মুসলমানরা বলছে, মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরির কোনও প্রমাণ নেই। তাদের দাবি, ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বলপূর্বক ঐতিহাসিক মসজিদটি ভেঙে দেয় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। তাই সেখানে মসজিদটি পুনঃস্থাপনই যৌক্তিক।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ তৈরি করেন। বাবরের নাম অনুসারে মসজিদের নামকরণ হয় বাবরি মসজিদ। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে মসজিদের মূল গম্বুজের নিচে রামলালার (শিশু রাম) মূর্তি স্থাপন করা হয়। মসজিদের ভেতর রামের মূর্তি রাখার প্রতিবাদ জানায় মুসলিমরা। সরকার জমিটিকে বিতর্কিত ঘোষণা করে তালাবদ্ধ করে দেয়। ১৯৫৯ সালে বাবরি মসজিদের ওই স্থানের অধিকার চেয়ে মামলা করে ‘নির্মোহী আখড়া’। ১৯৬১ সালে ‘নির্মোহী আখড়া’র দাবির বিরোধিতা করে জমির মালিকানা দাবি করে মামলা করে উত্তর প্রদেশ সেন্ট্রাল সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফৈজাবাদের আদালত মসজিদ চত্বরে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের উপাসনার অধিকার দিতে তালা খুলে দেওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। এলাহাবাদ হাইকোর্ট বিতর্কিত স্থানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। এরপর ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি গুজরাটের সোমনাথ থেকে রথযাত্রা শুরু করেন অযোধ্যার বাবরি মসজিদের উদ্দেশ্যে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর কর সেবকরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাংলাদেশ ও ভারত—দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। এ অবস্থায় ১৯৯৩ সালে সংসদে আইন পাস করে অযোধ্যার বিতর্কিত জমির দখল নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয়, বিতর্কিত জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া ও রামলালা বিরাজমানের মধ্যে সমবণ্টন করে দেওয়া হোক।

এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সব পক্ষ আপিল দায়ের করে। ২০১১ সালের ৯ মে হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। টানা ৪০ দিন শুনানির পর ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশের জন্য বিপজ্জনক ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর ঢামাডোলের মধ্যে ০৯ নভেম্বর ছুটির দিনে রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে অযোধ্যায় বিতর্কিত জায়গায় মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেওয়া হয়েছে। ২ দশমিক ৭৭ একর বিরোধপূর্ণ জমিতে মন্দিরের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্রাস্ট গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। ওই জমিতেই বাবরি মসজিদ ছিল। আর মসজিদ নির্মাণে সরকারকে অযোধ্যার অন্য কোনও জায়গায় পাঁচ একর জমি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।

আদালতের রায়ে বলা হয়, মসজিদটি ফাঁকা জায়গায় নির্মাণ করা হয়নি। এর নিচে অন্য কাঠামো ছিল। মসজিদের নিচে স্থাপনা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সুপ্রিম কোর্ট আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, খনন কাজে মসজিদের নিচে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, এতে বোঝা গেছে, সেগুলো ইসলামি নয়। তবে, এটি মন্দির কি না, তা-ও নিশ্চিত নয়। আদালত আরও বলেছেন, বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।

যে রায় হয়েছে, তা কি একেবারেই অচিন্তনীয় ছিল? উত্তর, না। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ ছিল মুসলমানদের মধ্যে। তিনি বিজেপি সমর্থক হিসেবে পরিচিত। আসামে এনআরসি করে বাঙালি মুসলমানদের অবৈধ চিহ্নিত করা, এনআরসি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও দ্রুত এনআরসি সম্পন্ন করতে বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের অতি উৎসাহ ছিল। বিতর্কিত যে মামলাগুলো বিজেপি এগিয়ে নিতে চায়, সেগুলোতে বিচারপতি গগৈ বরাবরই আগ্রহ দেখিয়ে আসছেন। এ বছরের ১৭ নভেম্বর দায়িত্ব শেষ হওয়ার আগেই বাবরি মসজিদ তথা রামের জন্মভূমি মামলার রায় ঘোষণার তার এ উদ্যোগ স্বভাবতই মুসলমানদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল।

খবরে জানা যায়, এ মামলায় নিয়োজিত মধ্যস্থতাকারী প্যানেল আদালতের বাইরে দুই পক্ষের মধ্যে আপসরফার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য আরও সময় চেয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি তার মেয়াদ শেষের আগেই মামলার রায় ঘোষণা করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন বলে মধ্যস্থতাকারী প্যানেলকে সময় বাড়াতে রাজি হননি। ১৬ অক্টোবর শুনানির শেষ দিন শুনানির শুরুতেই আরও কয়েক দিনের সময় চান এক আইনজীবী। কিন্তু পত্রপাঠ তা খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। তিনি বলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে। আজ বিকেল পাঁচটায় অযোধ্যা শুনানি শেষ হতেই হবে।’ অন্যদিকে, মামলায় অতিরিক্ত বক্তব্য তুলে ধরতে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল হিন্দু মহাসভা। কিন্তু, শীর্ষ আদালত সেই আবেদনও নাকচ করে দেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা মামলার সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষকে আগেই প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ সময়ে বক্তব্য শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলাম।’

এদিকে শনিবার ছুটির দিনে রায় ঘোষণা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আচমকা শুক্রবার রাতে সুপ্রিম কোর্ট জানান, শনিবার রায় ঘোষণা হবে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যসচিব ও পুলিশের ডিজি-কে দিল্লিতে নিজের চেম্বারে ডেকে এনে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আদালতের কাজ রায় দেওয়া। আইনশৃঙ্খলা দেখার কাজ প্রশাসনের। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কী হবে, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কেন মাথা ঘামাবে? কারণ, এর আগে শবরীমালা রায়ে সুপ্রিম কোর্টই বলেছিলেন, আদালত আইনের বিচার করবেন। সমাজে তার কী প্রভাব পড়বে, তা দেখা আদালতের কাজ নয়। প্রধান বিচারপতি কোনও রাজ্যের মুখ্যসচিব-ডিজিকে ডেকে বৈঠক করছেন, ইতিহাসে এমন হয়নি। বিচারপতিদের পাঁচ সদস্যদের বেঞ্চের অন্যতম বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ওয়াকফ বোর্ডের আইনজীবী রাজীব ধাওয়ানকে আনুপাতিক হারে বেশি প্রশ্ন ও পাল্টা প্রশ্ন করায় রাজীব ধাওয়ান বলেন, ‘সব প্রশ্ন আমাদের উদ্দেশে কেবল, অন্যদের উদ্দেশে নয়।’

রায়টি কেবল পরস্পরবিরোধী ও অসঙ্গতিপূর্ণই নয়, বরং এটি নতুন ‘বিপজ্জনক তত্ত্ব’ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যে সব কারণে এ বিতর্ক, সেগুলো হলো—এক. আদালত রায়ের ভিত্তি হিসেবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) খনন কার্যের রিপোর্টের কথা বলেছেন। অথচ এ রিপোর্টটিই বিতর্কিত। এএসআই অযোধ্যার জমিতে খননকালে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান সুপ্রিয়া ভার্মা এবং জয়া মেনন পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ২০১০ সালে ‘‌ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ পত্রিকায় লেখা এক নিবন্ধে তারা জানান, কেন তারা এএসআই-এর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। এর সবচেয়ে বড় কারণ, তাদের মনে হয়েছিল, এএসআই-এর কিছু পুরাতাত্ত্বিক এমন এক পূর্বসিদ্ধান্ত নিয়েই খননের কাজ শুরু করেছিলেন যে, মসজিদের তলায় মন্দিরই আছে। তাদের কাজ সেটাই খুঁজে বের করা। মসজিদের নিচে মন্দিরের অস্তিত্বের পক্ষে এএসআই পশ্চিমের দেওয়ালের কথা বলেছে। কিন্তু ভার্মার যুক্তি, মন্দিরে নয়, বরং মসজিদেই পশ্চিমদিকে দেওয়াল থাকে, যার সামনে নামাজ পড়া হয়। মন্দিরের গঠনশৈলী আলাদা হয়। পঞ্চাশটি স্তম্ভ দিয়ে তৈরি এক ভিতের কথা বলেছে এএসআই, যা নাকি মন্দিরের অবশেষ। ভার্মা বলছেন, এই দাবি ঠিক নয়। একাধিকবার আদালতকে জানানো হয়েছিল যে, এএসআই যেগুলোকে ভাঙা স্তম্ভ বলছে, সেগুলো আসলে জমে থাকা ইট, যার ভেতরে মাটি জমা হয়েছিল। এএসআই ১২টি ভাঙা টুকরো নমুনা হিসেবে দেখিয়েছে, যা নাকি ভাঙা মন্দিরের অংশ। ভার্মা যেহেতু খননের সময় আগাগোড়া হাজির ছিলেন, তিনি দাবি করছেন, ওই ভগ্নাংশগুলি একটিও মাটি খুঁড়ে পাওয়া নয়। বরং মসজিদের মেঝেতে জমে থাকা ধ্বংসস্তূপ থেকে ওইগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল। মন্দিরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে যা আদৌ যথেষ্ট নয়। ২০০৩ সালে হাইকোর্টে জমা পড়া এএসআই–এর রিপোর্ট সম্পর্কে সুপ্রিয়া ভার্মা বলছেন, এতে আরও তিনটি বিষয় আলাদাভাবে নজর করা উচিত। অযোধ্যার ওই জমি খুঁড়ে একাধিক নরকঙ্কালের অবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। চূড়ান্ত রিপোর্টে তার কোনও উল্লেখ নেই। রিপোর্টের প্রতিটি পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে, কোন পুরাতাত্ত্বিক সেই অংশটি লিখেছেন। রিপোর্টের শেষ পরিচ্ছেদে কিন্তু কারও নাম নেই। পশ্চিমের দেয়াল ও ৫০টি স্তম্ভের অবশেষের কারণে মসজিদের নিচে হিন্দু মন্দির থাকার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে আক্ষরিকভাবেই মাত্র তিন লাইনে। বাকি রিপোর্টে কিন্তু মন্দিরের কোনও উল্লেখ নেই। ‌অযোধ্যার ওই বিতর্কিত জমিতে এএসআই-এর যে রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে রায় দেওয়া হয়েছে, তার আগেও অযোধ্যা খনন হয়েছিল ও তার রিপোর্ট রয়েছে।

সুপ্রিয়া ভার্মা বলেন, প্রথমবার ১৮৬১ সালে খনন হয়েছিল। এএসআই-এর প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম-এর তত্ত্বাবধানে সেই খনন হয়। ওই জমির নিচে তিনটি ঢিবির সন্ধান পায় এএসআই, যার দুটি আকারে বৌদ্ধ স্তূপের মতো এবং তৃতীয়টির আকৃতি বৌদ্ধ বিহারের ধাঁচের। কানিংহ্যাম ওই অঞ্চলে মন্দির ধ্বংসের পক্ষে কোনও প্রমাণ না পাওয়ায় চূড়ান্ত রিপোর্টে মন্দিরের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। আদালত নিজেও স্বীকার করেছেন, মসজিদের নিচে যে কাঠামোর সন্ধান মিলেছিল, তা কোনও মন্দিরেরই কাঠামো ছিল, এমনটা এএসআই-এর রিপোর্টে স্পষ্ট হয়নি। তাহলে বিতর্কিত জায়গায় মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায়ের ভিত্তি কী? হিন্দু ধর্মের কিছু অনুসারীর বিশ্বাস ছাড়া আর কী? আদালত বলেছেন, ‘তবে ওই স্থানকে যে হিন্দুরা ভগবান রামের জন্ম স্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।’ রাম মন্দির ভেঙেই বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল, এমন কোনও অকাট্য প্রমাণ কি কেউ দাখিল করতে পেরেছিলেন? পারেননি। এরপরও সুপ্রিমকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক নয় কি?

আদালত সিদ্ধান্তে পৌঁছান অকাট্য প্রমাণ ও প্রামাণ্য নথিপত্রের ভিত্তিতে। আইনে বিশ্বাসের স্থান কোথায়? ইসলাম ধর্মে বর্ণিত আছে মসজিদ আল্লাহর ঘর। আবু হুরাইরা (র.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন: ‘যখন কিছু মানুষ আল্লাহর কোনও ঘরে (মসজিদে) সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পরস্পরে তা নিয়ে আলোচনা করে, তখন তাদের ওপর প্রশান্তি বর্ষিত হয়, তাদের রহমত ঢেকে নেয়, ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটস্থ ফেরেশতাদের কাছে তাদের প্রশংসা করেন।’ (সহীহ মুসলিম)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর নিকট সবচাইতে পছন্দনীয় স্থান হল মসজিদ এবং সবচাইতে অপছন্দনীয় স্থান হলো বাজার।’(সহিহ মুসলিম)। মসজিদ নির্মাণে উৎসাহ দিয়ে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদ তৈরি করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর নির্মাণ করবেন।’(সহিহ মুসলিম)। ইসলামের বিধান অনুযায়ী যা একবার শরয়ি মসজিদে পরিণত হয়, তা কিয়ামত পর্যন্ত মসজিদই থাকে। কোনও মসজিদকে পরিত্যাক্ত করাও বৈধ নয়। হ্যাঁ, যদি আবশ্যকীয় কোনও কারণে মসজিদটি অনাবাদ হয়ে পড়ে, তাহলে ওই মসজিদের চৌহদ্দিকে দেয়াল বা বেড়া দিয়ে আটকে দিতে হবে। যেন বোঝা যায়, এটি সম্মানিত স্থান—মসজিদ ছিল। ওই স্থানকে অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা জায়েজ হবে না। এখন আল্লাহর ঘর, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় স্থান যখন আক্রোশে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তার ওপর মন্দির নির্মাণের রায় হয়, তখন মুসলমানদের বিশ্বাসের বিষয়ে কী হবে?

দুই. আদালত রায়ে বলেছেন, ‘তবে বিতর্কিত জমির ওপর রামলালার অধিকার স্বীকার করে নেওয়াটা আইন-শৃঙ্খলা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’ এটি যদি রায়ের ভিত্তি হয়, তাহলে তো এটি পঞ্চায়েতের বা সালিশের রোয়েদাদ হবে, সুপ্রিম কোর্টের রায় নয়।

তিন. রায়ের পরে প্রশ্ন উঠেছে, মসজিদ তৈরির পর থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত তার পূর্ণ অধিকার শুধু মুসলিমদের ছিল কিনা, সেটি মুসলিমদের প্রমাণ করতে হবে। একই মাপকাঠিতে হিন্দুদের কেন প্রমাণ দিতে হবে না? রাজনৈতিক রায়ে মন্দির প্রতিষ্ঠার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে আদালত এ বিষয়ে নীরব।

চার. আদালত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় অকাট্য প্রমাণ এবং প্রামাণ্য নথিপত্রের ভিত্তিতে। কোনও বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করা ও সে অনুযায়ী রায় দেওয়া আদালতের কাজ নয়। অথচ এ রায়ে আদালত পৌরাণিক চরিত্রকে ঐতিহাসিক চরিত্রে উন্নীত করেছেন ও ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে বিচারিক নীতি ও মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়েছেন।

পাঁচ. রায়ে একটি ‘বিপজ্জনক তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন যে, অমুক মসজিদের নিচে মন্দির কিংবা অমুক মন্দিরের নিচে মসজিদের কাঠামো আছে, তাহলে তো এ রায়ের তত্ত্ব অনুযায়ী মাটির ওপর খাড়া ভবন ভেঙে মাটির নিচে পাওয়া কাঠামোর মালিককে জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। আইনের দৃষ্টিতে এটা কি সঠিক? মোটেও নয়। আদালত নিজেও বলেছেন বাবরি মসজিদের নিচের সে কাঠামোটি যদি কোনও হিন্দু স্থাপত্য হয়েও থাকে, তাহলেও আজকের দিনে এসে ওই জমিকে হিন্দুদের জমি হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না। তা হলে আদালত কোন যুক্তিতে ওই জায়গায় মন্দির বানানোর নির্দেশ দিলেন? বিজেপির সংসদ সদস্য বিনয় কাতিয়ার দাবি করেছেন, তাজমহল শিব মন্দিরের ওপর তৈরি করা হয়েছে। এটিকে অচিরেই তেজ মন্দিরে রূপান্তর করা হবে। এ মামলার রায় অনুযায়ী তাজমহলের জায়গায় শিবমন্দির নির্মাণের দাবি অস্বীকার করবেন কোন যুক্তিতে?

ছয়. প্রায় ৫ শতক ধরে টিকে থাকা মসজিদের ওপর মন্দির বানানোর লক্ষ্যে ট্রাস্ট গঠনের জন্য আদালত তিন মাস সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন, কিন্তু মসজিদ বানানোর জন্য ৫ একর জায়গা কতদিনের মধ্যে দিতে হবে, সে বিষয়ে কোনও নির্দেশনা নেই।

সাত. মামলায় ১০৪৫ পাতার রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সেই রায় কোন বিচারপতি লিখেছেন, তার উল্লেখ নেই। সর্বসম্মতিক্রমে এই রায় দিয়েছেন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ। কিন্তু ওই বিতর্কিত জমি রামের জন্মস্থান কিনা, তা নিয়ে ভিন্ন মত জানিয়েছেন এক বিচারপতি। রায়ে তার নামও উল্লেখ করা নেই। এই দু’টি ঘটনাই নজিরবিহীন। কারণ, যে বিচারপতি রায় লেখেন, রায়ে তার নাম উল্লেখ করাটাই প্রথা। কোনও বিচারপতি কোনও বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করলে তার নামও উল্লেখ করা থাকে। এই প্রথা কেন মানা হলো না, রায়ে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। রায়ে সংযোজনীতে হিন্দু ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী কেন ওই জমি রামের জন্মস্থান, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেটির লেখকেরও নাম উল্লেখ নেই।

আইন-শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে যদি ভারসাম্য রক্ষা করতেই হয়, তাহলে আদালতের উচিত ছিল বিতর্কিত পুরো জায়গায় (মসজিদ চত্বর ও তার বাইরে) তুলনামূলক ধর্মশিক্ষার কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা মানবহিতৈষী কোনও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া। অপ্রমাণিত মামলায় বিশ্বাসকে মান্যতা দিয়ে মন্দির নির্মাণ নয়।  আইন ও বিচারে একটা কথা প্রচলিত আছে, কেবল বিচার করলেই হবে না, ন্যায়বিচার যে করা হয়েছে, তা দৃশ্যমান হতে হবে। এখনও সুযোগ আছে রিভিউ পিটিশনের মাধ্যমে আদালতের রায় পুনর্বিবেচনা করার। কোম্পানি শাসনামলে কলকতা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রাজা নন্দকুমারকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান এখন ‘বিচারিক হত্যা’ হিসাবে ইতিহাসের কাঠগড়ায়। আর বাবরি মসজিদ মামলার রায় পুনর্বিবেচনা করা না হলে, গণতান্ত্রিক ভারতের বিচারিক ইতিহাসে এ রায় হয়তো ‘বিচারিক লজ্জা’ হিসাবে বিবেচিত হবে অনাদি কাল।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: zhossain1965@gmail.com