পেঁয়াজকাণ্ডের পর আবার কোন কাণ্ড?

বিভুরঞ্জন সরকারপেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। একদিনেই কেজিপ্রতি ৭০-৮০ টাকা দাম কমেছে। পেঁয়াজের দাম এখন দ্রুত কমবে। বিদেশ থেকে যেমন পেঁয়াজ আসছে, তেমনি বাজারে নতুন পেঁয়াজও উঠতে শুরু করেছে। পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক হয়ে এলে ক্রেতাদের মধ্যে যেমন স্বস্তি ফিরবে, তেমনি সরকারের মাথা থেকেও দুর্ভাবনা সরে যাবে। পেঁয়াজ নিয়ে দেশে যে হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হয়েছিল, তা সরকারের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠেছিল। পেঁয়াজের বাজার লাগামহীন হওয়ায় সরকারও কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়েছিল। তবে বিরোধী দল বরাবরের মতো পেঁয়াজ-ইস্যুতেও মাঠে নামতে পারেনি। পেঁয়াজ-রাজনীতি বিরোধী দলের জন্য একটি মোক্ষম হাতিয়ার ছিল। কিন্তু অদক্ষ বিরোধী দল এই অস্ত্র ব্যবহারেও ব্যর্থ হয়েছে।
পেঁয়াজের কেজি তিনশ’ টাকা বা তার কাছাকাছি হবে, এটা কেউ ভাবেননি। বাংলাদেশকে বলা হয় সব সম্ভবের দেশ। এখানে সবই সম্ভব। ব্যবসায়ীরা লাভের জন্য ব্যবসা করেন। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা সব সময় ওত পেতে থাকেন ক্রেতাদের পকেট কাটার জন্য। অন্য সব মানুষের দুটি হাত থাকে–ডান হাত এবং বাম হাত। কিন্তু বাঙালির নাকি তিন হাত। অতিরিক্ত হাতের নাম ‘অজুহাত’। জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে ব্যবসায়ীদের অজুহাতের অভাব হয় না। আজ  চাহিদা বেশি, বাড়াও দাম। কাল আকাশে মেঘ জমেছে, বাড়াও দাম। পরশু উৎপাদন কম হয়েছে, বাড়াও দাম। দাম বাড়ালে সমস্যা নেই। ক্রেতার তো অভাব নেই। দেশের সব মানুষ তো আর অর্থকষ্টে নেই। কিছু মানুষের এতো অর্থ যে তারা টাকার গরম না দেখিয়ে পারেন না। পেঁয়াজের দাম একশ’ বা তিনশ’ হোক তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না। বেশিরভাগ মানুষের দাম বাড়লে সমস্যা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার আসলে কম সংখ্যক মানুষের সন্তুষ্টিকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বেশিরভাগ মানুষের অসন্তুষ্টি সরকারকে সহজে বিচলিত করে না।

পেঁয়াজ না খেলে মানুষ মারা যায় না। কিন্তু পেঁয়াজ ছাড়াও মানুষের চলে না। তরকারিতে, বিশেষ করে মাছ-মাংসে পেঁয়াজ একটি অপরিহার্য উপাদান। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না অনেকেরই মুখে রোচে না। আবার গরিবের জন্য পেঁয়াজই তো মাছ-মাংসের সমতুল্য। পান্তা ভাতের সঙ্গে শুধু পেঁয়াজ হলেই অনেকের উদরপূর্তি এবং পরিতৃপ্তি—দুটোই হয়। তবে এখন অবস্থা বদলেছে। বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বেড়েছে। মানুষ এখন আর অনাহারে থাকে না। কাজেই পেঁয়াজ ছাড়া তরকারির কথা মানুষ এখন কেন ভাববে?

পেঁয়াজের বাজারে যে অস্থিরতা দেখা দেবে, সেটা সেপ্টেম্বর মাসেই বোঝা গিয়েছিল। ভারত থেকে আমরা পেঁয়াজ আমদানি করে থাকি। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ভাগে ভারত পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দেয়, শেষ দিকে এসে পেঁয়াজ রফতানিই বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ২৫-৩০ টাকার পেঁয়াজ ৭০-৮০ টাকায় ওঠে। ঘাটতি মেটানো বা চাহিদা পূরণের জন্য পেঁয়াজ আমদানির বিকল্প উৎস সন্ধান করা হয়নি দ্রুততার সঙ্গে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং বড় বড় কর্মকর্তার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে পেঁয়াজের বাজারে আগুন ধরে যায়। বাণিজ্যমন্ত্রী যখন বললেন, পেঁয়াজের দাম একশ’ টাকার বেশি হবে না, তখনই ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। মন্ত্রী যে পেঁয়াজের দাম একশ’ টাকা কেজির কথা বলেছিলেন সেটা কোন হিসাবে? তার এই দর নির্ধারণের ভিত্তি কী ছিল?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন ফণীভূষণ মজুমদার। ১৯৭৪ সালে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। চালের দাম হু হু করে বাড়ছিল। ফণী মজুমদার যেদিন চালের দাম একটি নির্ধারণ করে বলতেন, তারপরই বাজারে চালের দাম লাফ দিয়ে সেটাকে অতিক্রম করতো। মন্ত্রী জিনিসপত্রের দাম নিয়ে কথা বললে সমস্যা বাড়ে। কারণ, আমাদের মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা জানেন, আমাদের মন্ত্রীদের সমস্যা তৈরি করার ক্ষমতা থাকলেও সমাধানের সক্ষমতা নেই।

আচ্ছা, আমাদের দেশে পেঁয়াজের চাহিদা কতো? উৎপাদন কতো হয়? ঘাটতি কতো? এসবের কোনও সঠিক পরিসংখ্যান কি কারও কাছে আছে? কারও কারও মতে, বাংলাদেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। আবার কেউ মনে করেন, চাহিদা ৩০ লাখ টনের কাছাকাছি। আমরা যদি এই সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টনই চাহিদা হিসেবে ধরে নিচ্ছি। এর বিপরীতে আমাদের দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় কতো টন? কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। আবার পরিসংখ্যার ব্যুরোর তথ্যমতে, এই পরিমাণ হচ্ছে ১৯ লাখ ৩ হাজার টন। দুই সরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবেই ৫ লাখ টনের গড়বড়। আমরা নিচেরটা অর্থাৎ ১৯ লাখ টনই সহি হিসাবে ধরছি। এই সময়কালে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে ১১ লাখ টন। ১৯+১১। ৩০। তার মানে চাহিদা এবং উৎপাদন ও আমদানি সমান। তাহলে পেঁয়াজ নিয়ে এতো কেলেঙ্কারি কেন? গোঁজামিল বা শুভঙ্করের ফাঁকিটা কোথায়? মন্ত্রী-আমলারা জবাব দেবেন কী?

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যথার্থই বলেছেন, ‘পেঁয়াজের প্রকৃত চাহিদা কতো, মজুত কতো, কতো ঋণপত্র খোলা হয়েছে, আসার পথে আছে কতো টন এসব তথ্য প্রকাশ করা উচিত।’ এই উচিত কাজটি কে করবে? কার গোয়াল, কে দেয় ধোঁয়া!

পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী। খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে তিনি একবার ঢাকা এসে তখনকার দু’একজন মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলেছিলেন। তারপর এক ঘরোয়া আড্ডায় তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের মন্ত্রীদের তো ইতিহাস-ভূগোল কোনও বিষয়েই তেমন জ্ঞান নেই!’

এখনকার মন্ত্রীদের অবস্থা তারচেয়ে ভালো বলার মতো অবস্থা আছে কি? ভারত ছাড়া আর কোন কোন দেশ পেঁয়াজ রফতানি করে, কোন দেশে পেঁয়াজের দাম কম—এসব তথ্য জানা কি আজকের দিনে কোনও কঠিন কাজ?

পেঁয়াজ একটি পচনশীল পণ্য। এটি বেশি দিন গুদামজাত করে রাখা যায় না। এই পচনশীল অথচ প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়ক সামগ্রীটি যে কখনও কখনও রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করে, সেটা আমরা ভুলে যাই। পেঁয়াজের সঙ্গে উন্নয়নের রাজনীতির বোধহয় একটি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক আছে। পেঁয়াজ বুঝি উন্নয়ন সইতে পারে না। গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানি সামরিক ডিকটেটর আইয়ুব খান যখন উন্নয়নের রাজনীতির প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, তখনও একবার পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে আইয়ুব-মোনায়েম খানের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। তখন একটি বাংলা দৈনিক শিরোনাম করেছিল—‘বল, কোন ঘাটে ভিড়বে তোমার উন্নয়নের তরী: ঢাকার বাজারে আগুন-পেঁয়াজের সের আড়াই টাকা, রসুনের সের তিন টাকা’। বুঝুন ব্যাপারটা! তখনকার আড়াই টাকা এখন আড়াইশো তো হতেই পারে!

পেঁয়াজ খেলে নাকি মানুষের মাথা গরম হয়। মানুষকে নাকি উজ্জীবিত রাখতে সাহায্য করে পেঁয়াজ। সেজন্য পেঁয়াজের দাম বাড়লে মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পেঁয়াজ-উত্তেজনা রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। ভারত আমাদের পেঁয়াজ না দেওয়ায় আমরা এখন ভারতের নিন্দা-সমালোচনা করছি। আমরা কি জানি, পেঁয়াজ-দুর্যোগ ভারতে সরকারের ভিত একাধিকবার নাড়িয়ে দিয়েছিল? ভারত পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বনির্ভর হলেও মাঝে মাঝে খরা-বন্যা ইত্যাদি কারণে উৎপাদন কম হয়, আর দাম বেড়ে যায়। পেঁয়াজের বাজারে আগুন তো মানুষের মাথায়ও আগুন চড়ে যায়। তারা পেঁয়াজের মালা গলায় দিয়ে রাস্তায় নামে এবং গদিনশিন সরকারকেও গদি থেকে টেনে নামানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

পেঁয়াজ-সংকট ১৯৮০ সালে ভারতের জনতা দলের সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। ১৯৯৮ সালে পেঁয়াজ-দুর্যোগ দিল্লি ও রাজস্থানে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছিল। ২০১০ সালেও পেঁয়াজের কারণে ভারতের রাজনীতি উত্তাল হয়ে উঠেছিল। এবারও ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদন কম হয়েছে। পেঁয়াজের দাম ৭০-৮০ রুপি হওয়ায় সরকার ভয় পেয়ে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে। মানুষকে শান্ত রাখার উপায় জানা ক্ষমতার রাজনীতির একটি বড় কৌশল। নরেন্দ্র মোদির সরকার পেঁয়াজ-রাজনীতিতে পরাজিত হতে চায় না বলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। তারা তাদের সংকট না মিটিয়ে আমাদের প্রতি উদারতা দেখাবে কেন?

সেপ্টেম্বর মাসে সংকট তৈরি হলো, কিন্তু আমরা কেন দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থা নিতে পারলাম না? পেঁয়াজকে বিমানে চড়াতে দুই মাস লেগে গেলো কেন? আমাদের দেশের মানুষ এখনও মাথা গরম করে পেঁয়াজ-আন্দোলন শুরু করেনি। ফেসবুকে নানা রস-কৌতুকের মধ্যেই বিষয়টি এখনও সীমাবদ্ধ আছে। প্রেমিকা প্রেমিকের কাছে ডায়মন্ডের রিংয়ের বদলে ওনিয়ন রিং দাবি করছে, কিংবা আত্মীয় বাড়িতে মিষ্টির বদলে পেঁয়াজ নিয়ে যাচ্ছে—এসব কৌতুক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সরকার অবশ্য শেষ পর্যন্ত নড়েচড়ে বসেছে বলে মনে হচ্ছে। বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে কার্গো বিমানেও আনা হচ্ছে। পেঁয়াজ না খেয়ে বা কম খেয়ে মানুষ তার ‘তেজ’ কমাতে চায় না। মানুষের তেজের বহিঃপ্রকাশ ঘটার আগেই পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। পেঁয়াজ নিয়ে যারা কেলেঙ্কারি করলো, অতি মুনাফা লুটলো, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত চক্রকে খুঁজে বের করা হবে।

আমরা আশা করবো, এটা যেন কথার কথা না হয়। যারা পেঁয়াজ-দুর্যোগের জন্য দায়ী, তাদের শনাক্ত করে শাস্তি না দিলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। অন্য কোনও পণ্য নিয়ে মুনাফাবাজি করবে। চাল নিয়ে একটি ষড়যন্ত্র শুরু হওয়ার আশঙ্কা কেউ কেউ করছেন। অসাধু সিন্ডিকেটের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক