রাতে কোয়েস্ট মলে বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ লিপু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। গল্প শুনে শাহিন ভাবি বললেন, আরে আজহারের ছেলে তো সানিয়া মির্জার বোনকে বিয়ে করেছে। পরে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালো। দেখেছি সানিয়া মির্জা, তার বোন, বাবা, আজহার, আজহারের ছেলে মিলে বেশ জম্পেশ পারিবারিক আড্ডা দিচ্ছিলেন। আমার আর মুন্নীর সঙ্গে আজহারের ছবিটি তুলে দিয়েছিলেন সাবেক ক্রিকেটার, আমাদের বন্ধু জাবেদ ওমর বেলিম গোল্লা।
সৌরভ গাঙ্গুলীর দম ফেলার সময় নেই। চড়কির মতো ছুটছেন। তারকার মেলা তো তিনিই বসিয়েছেন। সবাইকে সামলাতে তো হচ্ছেই; সঙ্গে দুই ভিভিআইপি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরেকজনও খুব ব্যস্ত, ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সম্পাদক ও ভবিষ্যৎ সভাপতি অভিষেক। তবে তার পদ নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। পুরো নামটা শুনলে আগ্রহের কারণটা আপনিও টের পাবেন—অভিষেক ডালমিয়া, বাংলাদেশের ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধু জগমোহন ডালমিয়ার ছেলে। আইসিসির সভাপতি হিসেবে ডালমিয়ার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়া। কে না জানে, তখন মাঠের পারফরম্যান্সে কেনিয়া বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে ছিল। কিন্তু ডালমিয়ার টেবিলের পারফরম্যান্সে জিতে যায় বাংলাদেশ। আর তাতেই ডালমিয়া জিতে নেন কোটি বাঙালির হৃদয়। তাই ডালমিয়া শুনলেই আমরা শ্রদ্ধায় নত হই। তবে ডালমিয়ার ছেলেকে না পেলেও মেয়েকে পেয়েছি। সে আরও মজার গল্প। উদ্বোধনের সময় থেকে দেখছি মাঠে গোলাপি শাড়ি পরা এক সুন্দরী ঘুরে বেড়াচ্ছেন, উড়ে বেড়াচ্ছেন। এই মাঠে তো, এই ক্লাব হাউজে, এই বক্সে। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করছে। তিনিও সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছেন। বোঝাই যাচ্ছে, ইডেন তার ঘরের মতো। আমি ভেবেছিলাম, সৌরভ গাঙ্গুলীর স্ত্রী ডোনা গাঙ্গুলী। এক পুলিশের কাছে জানতে চাইতেই খুব বিস্ময় নিয়ে তাকালেন, যেন তাকে না চেনাটা অপরাধ। পরে শ্রদ্ধার সঙ্গে বললেন, উনি জাগমোহন ডালমিয়ার মেয়ে বৈশালী, তিনি এমএলএও। এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম, মুন্নী ছোট একটা ইন্টারভিউ করলো। হাসি যেন বৈশালীর মুখে কেটে বসিয়ে দেওয়া, এক মুহূর্তের জন্যও হারাতে দেখিনি।
তো সেই শচীনের খোঁজে জাবেদ ওমর বেলিম গোল্লা। কিছু না জেনে আমিও তার সঙ্গ নিলাম। হঠাৎ জাবেদ বক্সের সামনের সরু লবিতে ভিভিএস লক্ষ্মণের পথ আটকালেন, এই শচীন কোন বক্সে? বাধ্য ছেলে লক্ষ্মণ দেখিয়ে দিলো। আমি বিস্মিত হতেও ভুলে গেছি। লক্ষ্মণ নিজেই তো কিংবদন্তি। এই ইডেনেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফলোঅন করা ম্যাচ বাঁচিয়েছে লক্ষ্মণের ব্যাট। আর সেই লক্ষ্মণ কিনা আমাদের পথ প্রদর্শক। কিন্তু গন্তব্য যখন শচীন, তখন বাকি সবাই ম্লান। শচীনের মাঠে যাওয়ার তাড়া ছিল, তবুও একটা ছবি তোলা গেছে গোল্লার মোবাইলে।
শেখ হাসিনা যখন হোটেলে যাওয়ার জন্য বেরুচ্ছিলেন, বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের স্ত্রী সাবিনা আকরাম তাকে সালাম করলেন। প্রধানমন্ত্রী খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে তার সঙ্গে কথা বললেন।
দুর্জয়দের গল্প দিয়েই শেষ করবো লেখা। এতক্ষণ এত যে তারকা, কিংবদন্তির কথা বললাম; আমার কাছে কিন্তু সবচেয়ে বড় কিংবদন্তি আমাদের ক্রিকেটাররাই। ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশার ভার নিয়ে যারা মাঠে তুলে ধরেন বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ-ভারতের ঐতিহাসিক গোলাপি টেস্ট উপলক্ষে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলী আরও অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট স্কোয়াডকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যে টেস্ট শুরু হয়েছিল, তা অনেক কারণে ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট, এটুকুই ইতিহাসে ঠাঁই করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তারপরও ঢাকা টেস্ট আরও অনেক কারণে স্মরণীয়। এখন পর্যন্ত একমাত্র টেস্ট, যেখানে টস করতে নেমেছিলেন দুজন বাঙালি—বাংলাদেশের দুর্জয়, আর ভারতের সৌরভ। এই রেকর্ডটা ভাঙা কঠিনই। কারণ আবার কবে বাঙালি কেউ ভারতের অধিনায়ক হবেন, কে জানে। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের সঙ্গে সৌরভেরও দারুণ আবেগ আছে, বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টেই অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে সাবালক বানানো সৌরভ গাঙ্গুলীর। তাই নিজের টেস্ট অধিনায়কত্বের অভিষেকের দিনে যারা তার সঙ্গে মাঠে ছিলেন, নিজের ক্রিকেট প্রশাসকের অভিষেকের দিনে তাদের সবাইকে পাশে চেয়েছিলেন সৌরভ। নিউজিল্যান্ডে থিতু হওয়া আল শাহরিয়ার রোকন আর অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়া আমিনুল ইসলাম বুলবুল ছাড়া অভিষেক টেস্টের বাকি সবাই হাজির ইডেন গার্ডেন্সে। বুলবুল অনেকদিন ধরেই অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড। কোন অভিমানে জানি না, বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেট মস্তিষ্ক বুলবুল বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে দূরে আছেন।
এই যে বাংলাদেশের অভিষেক স্কোয়াডের মধ্যে উচ্ছ্বাসের জোয়ার, ইডেনে উৎসবের এত রঙ; তাতে পানি ঢেলে দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। টসে জিতে মুমিনুল হক কেন ব্যাটিং নিলেন জানি না। নিলেনই যখন, তখন একটু ধৈর্য ধরে ব্যাটিংটা করলেন না কেন। বাংলাদেশ যেন টি-৩০ খেলতে নেমেছিল। ৩০.৩ ওভারে ১০৫ রানে অলআউট! যে অভিষেক টেস্ট নিয়ে এত কথা, দ্বিতীয় ইনিংসে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে তাতেও বাংলাদেশ হেরেছিল। কিন্তু প্রথম ইনিংসে বুলবুলের ১৪৫ আর সুমনের সম্ভবত ৭১ রানের কল্যাণে ৪০০ রান করেছিল বাংলাদেশ। তাতে উঁচুই ছিল মাথা। কিন্তু ১৯ বছরে কতটা এগোলাম আমরা?
পিঙ্ক টেস্টের আগেরদিন সন্ধ্যায় ইডেন গার্ডেন্সের অনার্স বোর্ড দেখে একটা অসম্ভব প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল মনে, ইস হারজিত যাই হোক; বাংলাদেশের কেউ যদি এখানে নাম লেখাতে পারতো! অনার্স বোর্ড তো দূরের কথা; এখন তো মান-সম্মান আর সুস্থ শরীরে দেশে ফেরাই মুশকিল। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কি জানেন না, তারাই আমাদের তারকা, তারাই আমাদের কিংবদন্তি। তারা একটু খারাপ খেললে আমরা অনেক কষ্ট পাই। আবার অল্প একটু ভালো খেললেই গোটা জাতি উৎসবে মেতে ওঠে। প্রবল প্রত্যাশার চাপ সামলে মাঠে পারফর্ম করাই কিন্তু তাদের কাজ। কোটি বাংলাদেশি তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ