উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের নামে দেশের সর্বত্র এক ধরনের স্বেচ্ছাচার চলছে। কোথাও কোনও নিয়ম-নীতির বালাই নেই। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজর নেই সেখানেই অন্যায়, সেখানেই অনিয়ম। সরকারি কেনাকাটায় অর্থ লুটপাটের সামান্য যেসব খবর প্রকাশ পাচ্ছে, তাই তো রীতিমতো পিলে চমকানোর মতো। হাজার টাকার মাল লাখ টাকায়, লাখ টাকার মাল কোটি টাকায় কেনা হচ্ছে।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ দেশে যে লুটপাটের অর্থনীতি চালু করেছিলেন, এখনও তারই ধারাবাহিকতা চলছে। কান পাতলে বাতাসে নানা রকম কথা শোনা যায়। ব্যাংকের টাকা লোপাট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন-অপশাসনের কথা বললে এখন মানুষ বর্তমান সময়ের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরে বিব্রতকর সব কথা বলতে ছাড়েন না। মানুষের হাতে এখন নানা উপায়ে তথ্য হাজির হচ্ছে। সত্য ঘটনার সঙ্গে মিশেল হচ্ছে গুজবের। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না, কিছু সংখ্যক মানুষের হাতে দেশের সব সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে, সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক লক্ষ মানুষ এখন সব সুখভোগের অধিকারী। সৎ ও ছোট ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা ব্যাংকে গিয়ে দু'চার-দশ কোটি টাকা লোন পেতে ব্যাপক হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, বিদেশে টাকা পাচার করে বিলাসী জীবন যাপন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
যেকোনও আড্ডা-আলোচনায় বসলেই এমন সব মুখরোচক খবর শোনা যায় যেগুলো বিশ্বাস করতে মন চায় না। আবার বিশ্বাস না করার মতো মনের জোরও পাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-মন্ত্রীর অর্থবিত্তের বিবরণ শুনলে হা হয়ে থাকতে হয়। এসব উড়োখবর সবই মিথ্যা, বানোয়াট বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না দুটো কারণে: এক. যা রটে তার কিছু না কিছু বটে! দুই. সম্প্রতি দেশে দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান শুরু হয়েছে তাতে গ্রেফতারকৃতদের সম্পদের প্রকাশিত তথ্য।
সম্পদ গোপন করা যায় না। সম্পদের একটা আলাদা গরম আছে, জৌলুশ আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক প্রায় সব বক্তৃতায় অবৈধ সম্পদ উপার্জনের বিরুদ্ধে বলছেন। কিন্তু যারা অসৎ পথে হাঁটা শুরু করেছে, যারা টাকা কামানোর সহজ পথের সন্ধান পেয়েছে, সুপরামর্শে তারা সেপথ ছাড়বে না। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়। শেখ হাসিনাকে এখন আঙুল বাঁকাতেই হবে। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। তিনি যদি পথের বাধা, জঞ্জাল অপসারণ করতে না পারেন তাহলে কেউ আর তা পারবে না।
পেঁয়াজ থেকে আমরা একটু দূরে সরে এসেছি। ওই যে কথায় বলে না, কান টানলে মাথা আসে! তেমনি পেঁয়াজ-সঙ্কট কিন্তু আরো অনেক সঙ্কটকেই সামনে নিয়ে আসছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতার বিষয়টিও সামনে আসছে। মন্ত্রী -আমলারা যে বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষম নন, সেটা এখন প্রকটভাবে উপলব্ধি করা যাচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকেই হুকুম তামিল করতে পারেন, হুকুমের বাইরে কিছু হলেই সব গুবলেট পাকিয়ে ফেলেন।
সরকারি হিসাবনিকাশ থেকে পেঁয়াজের সংকট হওয়ার কোনও চিত্র পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে পেঁয়াজের যে চাহিদা তার বেশির ভাগ অংশই আমাদের দেশেই উৎপাদন হয় বলে কৃষি দফতরের তথ্য থেকে জানা যায়। বাকি পেঁয়াজ বাইরে থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। পেঁয়াজ আমাদের দেশে আমদানি করা হয় মূলত ভারত থেকে। ভারত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ। এবার প্রাকৃতিক কারণে ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদন কম হয়েছে। তো, আমাদের আমদানিকারক এবং সরকারি মহলে এই খবরটি জানা না থাকা বিস্ময়কর। ভারত সেপ্টেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিলে আমাদের কর্তাদের কানে পানি ঢোকে। তারা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের আগেই মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম হু হু করে বাড়িয়ে দিতে থাকেন। দেশে পেঁয়াজ ছিল না তা কিন্তু নয়। কারণ বাজারে পেঁয়াজের অভাব ছিল না। তারমানে এই পেঁয়াজগুলো ছিল কম দামে কেনা। কেনা দাম থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা ভোক্তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের এই পকেটকাটা এখনও অব্যাহত আছে।
পেঁয়াজ নিয়ে সফল হয়ে মুনাফালোভীরা অন্য নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম নিয়েও কারসাজি শুরু হয়েছে। চাল ডাল তেলসহ আরও কিছু জিনিসের দাম কোনও কারণ ছাড়াই বাড়ছে। শীতকালীন সবজির দামও আকাশছোঁয়া। বাধা আয়ের এবং নিম্ন আয়ের মানুষদের কিন্তু নাভিশ্বাস উঠে গেছে।
কৃষক যে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। কৃষক উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করছেন অথচ চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কোনও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। শীতকালীন সবজির ক্ষেত্রেও তাই। কৃষক বিক্রি করছেন নামমাত্র দামে আর ভোক্তারা কিনছেন চড়া দামে। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তার ভাঙা ঘরে কখনই চাঁদের আলো নামে না। সাধারণ ভোক্তারাও বেশি দামে জিনিস জিনে হিমশিম খাচ্ছেন। তার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে না। অথচ বাড়ছে ব্যয়ের পরিধি। কৃষক এবং ভোক্তাদের চিড়েচ্যাপ্টা করে মাঝখান থেকে মোটাতাজা হয়ে উঠছেন মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়িয়া এবং মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চক্র। সরকার এবং রাজনীতির অবস্থান এখন পর্যন্ত ওদের অনুকূলেই। ফলে অসাধু চক্রের হাতে জিম্মি দেশের সাধারণ মানুষ। মানুষকে এই জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে না পারলে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিতে বাধ্য। মানুষের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকি নেওয়া কারো জন্যই সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক