উড়িরচরের ঘূর্ণিঝড়ের পর উপদ্রুত এলাকার অবস্থা সরেজমিন দেখতে চলে আসেন নওয়াজ শরিফ। খালেদা-নেওয়াজ পরষ্পরের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতেন! সেই নওয়াজ এখন আবার ক্ষমতায়। কিন্তু খালেদা ক্ষমতায় নেই! বিরহ চলছেই। সেই বিরহ এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-ফাঁসিকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরণে রূপ নিয়েছে!
আস্কারার ঘটনাগুলো বলি। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলে হঠাৎ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যার সাহস করেনি সেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশে হত্যা করা হয়েছে দেখে পাকিস্তানে খুশির নহর বয়! ক্ষমতা দখলকারী নতুন সরকারকে শুধু স্বীকৃতি নয়, একইসঙ্গে তখন অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয় ইসলামাবাদ। এর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সরকার পাকিস্তানের কাছে পাওনা আদায় নিয়ে সোচ্চার ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের সরকার পাওনা আদায়ে শুধু ঢিলেমি নয়, এ প্রসঙ্গটাই চেপে যায়। উল্টো জয় বাংলার বদলে পাকিস্তানি স্টাইলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগান চালু, সংবিধানের বিসমিল্লাহকরণসহ নানা কিছুতে পাকিস্তানকে রাজনৈতিক নৈকট্য দেয়। জিয়া সরকারের নিরাপত্তায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তখন থেকে আবার বিপুল বিক্রমে কাজ শুরু করে বাংলাদেশে। মূলত তখন থেকেই ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশে আশ্রয় পেতে শুরু করে। আরাকান দেশ স্বাধীন করে দেবার নামে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের দিয়ে গড়া হয় আরাকান আর্মী। এভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি টেনে আনা হয় বাংলাদেশে! জিয়ার পর এরশাদ আমলেও পাকিস্তান-আইএসআই প্রভাবিত কার্যক্রম বাংলাদেশে চলতে থাকে। এরশাদের পর খালেদা আমলেও চলে একই পাকিস্তানি ধারাবাহিকতা। উড়িরচরের ঘূর্ণিঝড়ের পর উপদ্রুত এলাকার অবস্থা সরেজমিন দেখতে চলে আসেন নওয়াজ শরিফ। খালেদা-নেওয়াজ পরষ্পরের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতেন! সেই নওয়াজ এখন আবার ক্ষমতায়। কিন্তু খালেদা ক্ষমতায় নেই! বিরহ চলছেই। সেই বিরহ এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-ফাঁসিকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরণে রূপ নিয়েছে!
এখন পাকিস্তানে দৃশ্যত মিলিটারি শাসন নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ইস্যুতে সেখানকার মিলিটারি-রাজনৈতিক নেতৃত্বের চিন্তায় ফারাক নেই। জামায়াতে ইসলামী খুব একটা শক্তিশালী সংগঠন নয় পাকিস্তানে। কিন্তু বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে সব পাকিস্তানির মনই সমান কাঁদে! নওয়াজ শরিফের কাঁদে! ইমরান খানের কাঁদে! সর্বশেষ কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী, আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসিকে কেন্দ্র করে তাদের প্রতিক্রিয়া ঔদ্ধ্যত্বের সীমা ছাড়িয়েছে! সর্বশেষ একাত্তরের গণহত্যার দায় পর্যন্ত অস্বীকার করে বসেছে পাকিস্তান! তাহলে পঁচিশে মার্চের রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে গণহত্যা কারা ঘটিয়েছে? তখন কি এখানে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য, তাদের দোসর রাজাকার-আল বদররা ছিল না? না কোনও গায়েবি বাহিনী ছিল! ইদানীং কথায় কথায় সিমলা চুক্তির দোহাই দেয় পাকিস্তান! সিমলা চুক্তির মাধ্যমে তারা মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে আরেক ফ্রড করেছে। ওই চুক্তির নামে তারা তাদের যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জনকে পাকিস্তানে বিচারের নাম করে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বিচার করেনি। সিমলা চুক্তির কোথায় উল্লেখ করা আছে আমরা আমাদের আশেপাশে যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিনি-জানি তাদের বিচার করতে পারবো না? আমরা আমাদের সার্বভৌমত্বের ভেতরে বসে আমাদের আইনে যা করবো তাতে নাক গলানোর পাকিস্তান কে? সেদেশতো আমাদের কাছে আগাগোড়া একটি ফ্রড রাষ্ট্র। সেই ভাষা প্রশ্নে ১৯৪৮ থেকে তারা আমাদের সঙ্গে ফ্রডগিরি শুরু করে। তারা আমাদের সঙ্গে ফ্রডগিরি করেছে ১৯৫২'য়, হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১'এ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই ফ্রডদের আমরা এখান থেকে বিদায় করেছি। তাদের সহযোগী ফ্রডগুলোর এখন আমরা বিচার করছি। আর সে আমাদের তালিম দেয় এতে নাকি দু'দেশের জনগণের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে! বাংলাদেশের জনগণ বলতে তো তাদের কাছে জামায়াতে ইসলামী, সাকা চৌধুরির মতো লোকজন! এরা আমাদের বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী নয়। এরা এখানে আটকে পড়া পাকিস্তানি। বাংলাদেশকে শুধু বাংলাদেশের জনগণের করতে আমরা আমাদের সার্বভৌমত্বের যা প্রয়োজন তা-ই করবো। একাত্তরের খুনি রাষ্ট্র পাকিস্তান এতে আর নাক গলানোর চেষ্টা করলে এর বিরুদ্ধে যা যা ব্যবস্থা নেবার তা আমরা করবো।
সুখের কথা এই ব্যবস্থাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে একাত্তরে গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তান। বিজয়ের ঊষালগ্নে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই বেছে বেছে হত্যা করেছে। ঢাবির এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন। মুক্তিযোদ্ধা তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এ ব্যাপারে যে উচ্চকণ্ঠ নিয়েছেন সে জন্যে তাকে কৃতজ্ঞতা। আমেনা মোহসীনরা এতে মনে যত কষ্ট পাক, ইনিয়ে বিনিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে সাফাই গান না কেন আমাদের কাজ আমরা করে যাব। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-ফাঁসি চলবে। এ নিয়ে পাকিস্তান আর একটা টুঁ শব্দ করলে তাদের হাইকমিশনারকে এখান থেকে বের করে দিতে হবে। আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক রাজনীতি-অর্থনীতিতে পাকিস্তান আমাদের কাছে এমন কোনও দেশ নয় যে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে আমরা পানিতে পড়ে যাব। আমরা আমাদের সক্ষমতা মর্যাদায় আস্থাশীল। পাকিস্তানের মতো একটা চরম মৌলবাদী ফ্রড রাষ্ট্রের এহেন ঔদ্ধ্যত্বের প্রতিবাদে তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করলে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের সক্ষমতা মর্যাদা আরও বেড়ে যাবে। গো এহেড বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তে কেনা প্রিয় জন্মভূমি আমাদের। জয় বাংলা।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক