আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থা তো করুণ। তার এবারের প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। রাষ্ট্রটিতে যেভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় আসার পর গন্ডগোল শুরু হয়েছে, তাতে প্রবৃদ্ধি আরও নিম্নগামী হবে আশংকা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাতে ভারতের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আরও বাড়বে। পাকিস্তানের অবস্থাও ভালো নয়। অবশ্য সাধারণ মানুষ প্রবৃদ্ধি বোঝে না। ভাত-কাপড়ে সুখে আছে কিনা সেটা দেখে। আল্লাহর অশেষ রহমত আমরা ভাত-কাপড়েও সুখে আছি।
বিশ্বের বড় বড় দেশ মন্দাকবলিত হচ্ছে। এখন আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের উচিত সর্বাবস্থায় সতর্ক থাকা আর তৎপর থাকা, আমাদের অর্থনীতি যাতে মন্দাকবলিত না হয়। মন্দার লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। রাজস্ব খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত অর্থ না পেয়ে ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে সরকার। রেমিট্যান্স ছাড়া সবকিছুর সূচক নিম্নগামী। তার মোড় ফেরানোর কর্মযজ্ঞ দরকার। তাতে যেন কোনও শিথিলতা না আসে। আমাদের সাধারণ মানুষের উদ্যম উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তারা ডালা-কুলা রফতানি করে, আবার লাশ পরিবহনের বাক্স বানিয়েও রফতানি করে। ননট্র্যাডিশনাল আইটেমের রফতানি যে এত অকল্পনীয় দ্রব্যে গিয়ে পৌঁছেছে, তা দেখলে এই জাতিকে নিয়ে আশান্বিত হওয়া যায়।
আমরা যদি আমাদের মানব শক্তিকে কাজে লাগাতে চাই তবে ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আবার বিদেশি ভাষাও শেখাতে হবে। জাপান প্রশিক্ষণ আর ভাষা জানার প্রতি জোর দিয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন অনেক ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও তা স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের এই উন্নয়নের পেছনে সরকারের চেয়ে ব্যক্তি উদ্যোগের অবদানই বেশি।
২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছাবে। তখন বাংলাদেশ ২৪টি শীর্ষ উন্নত দেশের স্তরে এসে উপস্থিত হবে। সুতরাং আগামী দশক কী সাধারণ মানুষ, কী রাষ্ট্রযন্ত্র—কারও পেছনে ফিরে দেখার অবকাশ নেই। কাজের মাঝে ডুবে থাকলে আমরা নিশ্চয়ই সেই অবস্থানে আগামী ১০ বছরে পৌঁছে যাব।
১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া একটা জেনারেশন আমাদের হাতে রয়েছে যাকে বলা হয় ‘জেনারেশন জেড’ বা সংক্ষেপে ‘জেড জেন’। আইসিটি খাতকে বাংলাদেশ গুরুত্ব দিয়েছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের রফতানি আয় এক বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে বাংলাদেশ এই খাতে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য স্থির করেছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের মতে বর্তমান বিশ্বে অনলাইনে যে জনশক্তি নিয়োজিত আছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রথমে আছে ভারত। আমাদের ‘জেনারেশন জেড’কে আইটি সেক্টরের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশ তার স্থিরকৃত পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় করা সহজ হবে।
এমন একটি জেনারেশন চীনের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার নিয়ে সম্ভবত ত্রুটির মাঝে রয়েছি। সেই ত্রুটি কী তা নির্ণয় করে পরিবর্তন করা দরকার। চীন তাদের স্টেডিয়ামে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে গণহারে আইটি সেক্টরে তাদের জেনারেশনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আমাদেরও উচিত চীনের অনুসৃত নীতি অনুসরণ করা। প্রয়োজন এই ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো।
আমরা শুধু সৌদি আরব, ইউএই, কুয়েত, কাতার, ওমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বা মালয়েশিয়াতে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। অথচ আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে আইটি জানা জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আইটি উপদেষ্টা এবং তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অনুরোধ করবো যেন আমাদের জেনারেশন জেডকে আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তুলতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি না করেন। সিরিয়ার যেই ১০ লাখ শরণার্থীকে জার্মানি গ্রহণ করেছে সেই শরণার্থীর মধ্যে থাকা জেনারেশন জেডকে তারা আইটি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
এদিকে আমাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাস করছে। বাংলাদেশের জন্য যা একটি বিরাট বোঝা। ২০১৯ সালে ওআইসি গাম্বিয়াকে দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা রুজু করেছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার অভিযোগ এনে। আদালতে মিয়ানমারকে প্রতিনিধিত্ব করেছে তাদের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। আর গাম্বিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছে গাম্বিয়ার আইন ও বিচারমন্ত্রী। আদালতে উভয়পক্ষের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়েছে, গাম্বিয়া শক্তিশালী যুক্তিতর্ক পেশ করেছে এবং সাময়িকভাবে সেসব বিষয়ে নির্দেশনা চেয়েছে। হয়তো আদালত তা মঞ্জুর করতে পারেন। অবশ্য মিয়ানমার কোনও রীতিনীতি মানছে না। চীন, রাশিয়া, জাপান তার পক্ষে। শেষপর্যন্ত আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পক্ষে এলেও মিয়ানমার তা কার্যকর করে কিনা সন্দেহ আছে।
বছর শেষে আরেকটা ঘটনা বাংলাদেশের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে। রোহিঙ্গার ঢলের পর আমাদের জনসংখ্যার জন্য এটি আরেক হুমকি। ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যেকোনও সময়ের তুলনায় সুমধুর চললেও ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এবং নাগরিকপঞ্জি নিয়ে এই সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়েছে। ডিসেম্বরে বাংলাদেশের দুই মন্ত্রী তাদের নির্ধারিত ভারত সফর বাতিল করেছেন। এনআরসি এবং সিএএ দ্বারা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করলেও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব ঘটনাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনা বলে শেষ করতে চেয়েছেন। কিন্তু কাশ্মিরকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে বিবৃতি দিলেও নাগরিকপঞ্জি, নাগরিকত্ব বিল নিয়ে একথা চলে না।
ওই দুই ইস্যুতে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশেও পড়বে। বিজেপি নেতাদের বক্তব্য শুনলে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে ভারত ঝগড়া লাগাতে চাইলেও সুকৌশলে ইমরান তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে পাকিস্তানকে শত্রুরাষ্ট্র বানিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোদিরা যে ফায়দা নিচ্ছিলেন ক্রমেই সেটা সংকুচিত হয়ে আসছে। সে কারণে তারা বাংলাদেশকেও কাল্পনিক শত্রুরাষ্ট্র বানিয়ে বিবাদের সূত্রপাত করতে চাচ্ছে। তাদের দেশপ্রেম ব্যবসার জন্য এটা খুব জরুরি। আরও জরুরি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতায় আসা।
বাংলাদেশকে টার্গেট করা যাচ্ছে কারণ বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। নাগরিকত্ব আইন বানিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের কাতারে ফেলা হলেও বিজেপির মূল টার্গেট বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের সঙ্গে তার সীমান্তই নেই আর কড়া নজরদারিতে পাকিস্তানের সীমান্ত ক্রস মুসলমানদের পুশইন করানো সম্ভব নয়। পুশইন করতে বাংলাদেশের সীমান্তই তাদের জন্য সহজ। এখানে হিন্দু নির্যাতনের ইস্যু বানিয়ে মৌলবাদী হিন্দুদের কাছে যেমন বাহবা পাওয়া যাবে, তেমনি এই ডামাডোলে নিজেদের দেশে মুসলিম নির্যাতনকেও আড়াল করা যাবে।
আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশ ভারতীয় এই চাল মোকাবেলা করার সক্ষমতা রাখে না কারণ আন্তর্জাতিক মণ্ডলে বাংলাদেশের শক্তিশালী কোনও অন্ধ মিত্র নেই। আবার অপ্রিয় হলেও সত্য, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে মূলত কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি হিন্দু মৌলবাদী বিজেপি সরকারের এই নীতি বাস্তবায়নকে সমর্থন দিয়ে আসছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে মোদিরা প্রতিবেশী তিন মুসলিম দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেওয়ার কথা বলছে, অথচ তার সীমান্তবর্তী তিব্বত, শ্রীলংকা, নেপাল থেকে আসা হিন্দু শরণার্থীদের নিয়ে বিজেপির কোনও মাথাব্যথা নেই।
বিজেপি নেতাদের বক্তব্য শুনলে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের ষড়যন্ত্রটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অমিত শাহ আজকাল রাখঢাক করে কথা বলছেন না, স্পষ্ট করেই বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং কথিত অবৈধ বাংলাদেশি মুসলিমদের ফেরত পাঠানোর কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্রীড়নক হচ্ছেন এই বিজেপি প্রধান, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত, তারমধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই রয়েছে ২ হাজার ২১৭ কিলোমিটার সীমান্ত। পশ্চিমবাংলার লাখ লাখ মানুষকে নাগরিকত্বহীন করে ফেললে তারা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে আসবে। রোহিঙ্গাদের যেমন ঠেকানো যায়নি, তাদেরও ঠেকানো যাবে না। রাশিয়া তখন ভারতের পক্ষ অবলম্বন করবে। সুতরাং এখনই বাংলাদেশের উচিত সেই সম্পর্কে ভারতের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কথাবার্তা বলা।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি যে ভাষায় এনআরসি এবং সিএএ নিয়ে কথা বলেছেন সেটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সরকারের এই সংক্রান্ত নীতি নিয়ে মানুষ বিভ্রান্ত। অবশ্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বলা হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের কোনও লোক এখন ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের কাহিনিও এখন কাল্পনিক।
প্রকৃতপক্ষে, ভারতের কিছু দরগায় দরগায় ঘুরাফিরা করা পাগল ছাড়া বাংলাদেশি কোনও মুসলমানকে পাওয়া যাবে না। ফলে বাংলাদেশবিরোধী ভারতের এই প্রচারণাকে জোরালোভাবে রুখে দিতে হবে।
আবার দেখেন, যেসব হিন্দু বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েছে তাদের রেশন কার্ড আছে, ভোটার আইডি কার্ড আছে, তারা বহুদিন থেকে ভারতীয় নাগরিক। অমিত শাহ এখন বলেছেন, রেশন কার্ড আর ভোটার আইডি কার্ড নাগরিকত্বের মাপকাঠি হতে পারে না। অর্থাৎ তুমি ভাটিতে নদী পার হলেও উজানে পানি ঘোলা হচ্ছে—এমন একটা কথা বলে নিয়মিত সব ব্যবস্থাকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র করছে অমিত শাহরা। ভারতের এই দৃশ্যের শেষ পরিণতি না দেখা পর্যন্ত বাংলাদেশের উচিত মোদি সরকারের সঙ্গে দহরম-মহরম কমিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশ যদি এই বিষয়টির ওপর স্থির থাকতে না পারে, তবে বাংলাদেশের ভাগ্যে হয়তোবা দুর্ভোগ আছে।
অমিত শাহের মতো বিজেপি নেতারা বাংলাদেশটাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখতে চায়। বাংলাভাষী দেখলেই সবাইকে বাংলাদেশি সন্দেহ করাটা হিন্দিভাষী ভারতীয় নেতাদের, বিশেষ করে বিজেপি নেতাদের মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। এখন তো মুসলানদের ভাবছে, একদিন হয়তো ধর্মও বিচার করবে না, পশ্চিমবঙ্গের সব বাংলাভাষীকেই তারা বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করবে। সুতরাং এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বাংলাদেশের নির্বাক থাকলে হবে না। এটা যে শুধু ভারতের জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি ও সংহতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে তা নয়, বাংলাদেশকেও বিপর্যস্ত করে ছাড়বে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com