ইতিহাস নায়ক সৃষ্টি করে। আবার নায়কও ইতিহাস সৃষ্টি করেন। রাজনীতির ক্রম বিবর্তনে নায়ক বলুন আর ইতিহাস বলুন, কেউ সাধারণ মানুষকে পেছনে ঠেলে অগ্রসর হতে পারে না। সুতরাং তাদেরও একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকে। ১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সময়। সুতরাং এই সময়টা যারা রাজনীতির অনুঘটক ছিলেন, শুধু তাদের কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা করলে হবে না, ওই সময়ের সাধারণ মানুষের বিষয়কেও বিবেচনায় আনতে হবে। তাহলে আমার মনে হয় ঐতিহাসিক বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা হয়তো একটা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবো।
গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ, শেরে বাংলা অসাম্প্রদায়িক লোক ছিলেন। তবু ভারত সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজন হলো কেন? প্রারম্ভে এরা কেউ বিভাজনের আন্দোলন করেননি। কিন্তু এই মহতী স্বাধীনতা আন্দোলনকে তৃণমূল পর্যায়ে কিছু বিবাদ ধর্মীয় বিভাজনের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার কেন্দ্রভূমি ছিল পাঞ্জাব। পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রোশ এবং ভ্রান্ত ধারণা এখানেই সর্বাধিক প্রবল ছিল। বাংলায় ছিল প্রজা আর জমিদারের সমস্যা। জমিদার ছিল হিন্দু, আর প্রজা কৃষকেরা ছিল মুসলমান। জমিদারের সন্তানদের অন্নপ্রাশনেও প্রজা মুসলমান কৃষকদের বাধ্যতামূলক উপঢৌকন দিতে হতো।
জমিদারেরা গোটা হিন্দু সম্প্রদায় নয়। তারা একটা শ্রেণি মাত্র। অথচ একটা শ্রেণির অনাচার মুসলমান প্রজাদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার ছদ্মবেশে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পাঞ্জাব আর সিন্ধুতে টাকা লগ্নি করত হিন্দু মহাজনেরা, আর খাতক দল ছিল অধিকাংশ মুসলমান কৃষক। মহাজনদের চক্রবৃদ্ধি সুদের অনাচার দায়িকদের সমস্ত আক্রোশ সাম্প্রদায়িকতার শক্তিকে বৃদ্ধি করেছিল। অনুরূপ একটা শংকর পরিস্থিতিতে নেতারা তাদের অসাম্প্রদায়িক ভূমিকা পালনে অকার্যকর হয়ে পড়েছিলেন। কারণ সাম্প্রদায়িকতা তখন তৃণমূলে বিস্তার লাভ করেছিল। তখন ভারত বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল এবং ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত বিভক্ত করে ১৪ তারিখ পাকিস্তানকে আর ১৫ তারিখ ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করে ভারত ত্যাগ করে।
তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক চেতনা নেতাদের মাঝেও সম্প্রসারিত হয়েছিল। গান্ধী, জিন্নাহ, নেহরু, সুভাষ, শেরে বাংলা ভিন্ন অন্য কোনও অসাম্প্রদায়িক নেতা ছিলেন না। আর গান্ধী ভারতের ঐক্যের ব্যাপারে অনড় থাকলেও তার মুখ্য সহকর্মী জওহরলাল নেহরু এবং সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল দীর্ঘ কারাবরণ এবং বয়সের কারণে হতাশ হয়ে উঠেছিলেন। যে কারণে গান্ধী সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্যও শীতল হয়ে পড়েছিল। গান্ধী, নেহরু ও প্যাটেলকে বলেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাতে তারা সম্মত হননি।
অবশেষে গান্ধী ভারত বিভক্তির ব্যাপারে তার বাড়াবাড়ি পরিত্যাগ করেছিলেন। কারণ মাউন্টব্যাটনের সঙ্গে গান্ধীর আলোচনার সময় আড়ালে-আবডালে গান্ধীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিনি শেষ কথা বলার অধিকার হারিয়েছেন। দেশভাগের সিদ্ধান্ত তাকে বাদ দিয়েই নেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আর সীমান্তের খান আবদুল গাফফার খান ছাড়া সবাই ভারত ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।
যাই হোক, অবশেষে ভারত বিভক্ত হলো। ‘পোকাখাওয়া’ পাকিস্তান নিয়ে জিন্নাহ বোম্বের মালবার হিলের বাড়ি ছেড়ে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে করাচিতে গেলেন। পোকাখাওয়া শব্দটা আমার নয়। এই শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন জিন্নাহ। পূর্ব বাংলার টাকায় কলকাতা গড়ে উঠেছে। কলকাতা পেল না পূর্ব বাংলা। কথা ছিল পূর্ব ও পশ্চিমের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান হবে অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জেলা মুর্শিদাবাদ, মালদহ, করিমগঞ্জ, পশ্চিম দিনাজপুর ইত্যাদি পার্টিশন কমিশনের চেয়ারম্যান রেডক্লিফ ভারতকে অন্যায়ভাবে দিয়ে দিলেন। জিন্নাহর কিছুই করার ছিল না।
যে পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট জন্ম নিলো তা জন্মসূত্রে ছিল প্রতিবন্ধী। দুই অংশের অবস্থান পরস্পর থেকে ১২শ’ মাইল দূরত্বে। জন্মেই তার ধ্বংসের বীজ নিহিত ছিল। সরকারের ব্যয়, জনসাধারণের আয়—অর্থনীতির এই সূত্রে কেন্দ্রীয় সরকার যে খরচটা করলো, তার সুফল পেলো না বাংলার মানুষ, দূরত্বের কারণে। সুতরাং বৈষম্য বাড়লো দুই অংশের মধ্যে। গণ অসন্তোষও বাড়লো সমান তালে। পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা কেন্দ্রীয় রাজধানী হাতের কাছে পেয়ে সুবিধা লুটলো দুই হাতে। বৈষম্য রাত-দিনের মতো হয়ে গেলো।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমায়। গোপালগঞ্জ তখনও জেলা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। তিনি শহরে থাকতেন। বঙ্গবন্ধুও লেখাপড়া আরম্ভ করেছেন বাবার সঙ্গে থেকে গোপালগঞ্জ শহরে। স্কুল জীবনে গোপালগঞ্জ শহরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরিচয়। জহুরি রতন চেনে। তিনি কলকাতায় এলে বঙ্গবন্ধুকে দেখা করতে বলেছিলেন। স্কুল জীবন শেষ করে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় চলে যান। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে চলে আসেন। এই সম্পর্কটাই তাকে সমগ্র বাংলাদেশ পরিচিতি দান করে, আর রাজনীতিতে খ্যাতি অর্জনের সুযোগ করে দেয়।
গণমানুষের সঙ্গে, গণমানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে, বঙ্গবন্ধু ছোটকাল থেকে সম্পৃক্ত। তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে তা বুঝা যায়। আর আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তারা তার গণমানুষমুখী তার চরিত্র লক্ষ করেছি। শুধু তিনি নন, তার সেই গুণ তার সহকর্মীদের মধ্যেও সম্প্রসারিত হয়েছিল। গণআকাঙ্ক্ষার মর্মভূমিতে নিজেকে একাকার করে দেওয়ার গুণটা ছিল বঙ্গবন্ধুর। এই মহৎ গুণটি তাকে গণমানুষের নেতা করেছে। বঙ্গবন্ধু করেছে। আর সবশেষে জাতির পিতার আসনে বসিয়ে তাকে সম্মানিত করেছে।
শেখ মুজিব খুব আত্মবিশ্বাসী লোক ছিলেন। যার আত্মবিশ্বাস নেই, সে তো আশ্রয়হীনা লতার মতো পড়ে থাকে। তার আত্মবিশ্বাসী তাকে এত ওপরে টেনে তুলেছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর ৪৩ দিন পর তিনি আওয়ামী লীগ পুনর্জীবিত করেছিলেন। পুনর্জীবিত আওয়ামী লীগে প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমেদরা আসেননি। তিনি নতুন একটি টিম নিয়ে আওয়ামী লীগ আরম্ভ করেছিলেন। খুলনার আবদুল আজিজ, যশোরের মশিউর রহমান (যাকে পাকিস্তানি বাহিনী ২৬ মার্চ ১৯৭১ হত্যা করে), ফরিদপুরের মোল্লা জালাল উদ্দিন, ঢাকার তাজউদ্দীন আহমদ ও শামসুল হক, ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রাজশাহীর কামারুজ্জামান, পাবনার মনসুর আলী, বরিশালের হেমায়েত উদ্দিন, চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী, কুমিল্লার কাজী জহিরুল কাইয়ুম ও মিজানুর রহমান চৌধুরী, সিলেটের আবদুস সামাদ আজাদ, নোয়াখালীর মালেক উকিল—প্রমুখকে নিয়ে তার পদযাত্রা।
সবাই ছিলেন প্রায় তার সমবয়সী। এই টিমটা নির্বাচনে এতো দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন যে স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত নিতে কেউ কোনও দ্বিমত করেননি। সহকর্মী নির্বাচনে তার সিদ্ধান্ত ছিল অভ্রান্ত এবং কাল উত্তীর্ণ। বঙ্গবন্ধু অনেক সময় বক্তৃতা দিতে গিয়ে পুরনো নেতাদের ‘মীরজাফর’ বলতেন। তখন একদিন নুরুল আমিন তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘মুজিবর আমরা সবাই মীরজাফর হলে তুমি এক সিরাজ করবে কী!’ বঙ্গবন্ধু তার আরেক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘এক সিরাজ কী করতে পারে, তা দেখার জন্য আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখুক।’ সত্যই নুরুল আমিন তা দেখে গেছেন।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com