এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, এ রুলিং রোহিঙ্গাদের খুশি করেছে (তবে, আশান্বিত করেছে কিনা আমি সন্দিহান!) এবং খুব স্বাভাবিক কারণেই মিয়ানমারকে ব্যথিত করেছে। পাশাপাশি ইউনিভার্সেল জাস্টিসের বা সার্বজনীন ন্যায়বিচারের যে ধারণা, সেটা খানিকটা হলেও এ আদেশের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি যে নির্যাতন এবং জুলুম হয়েছে, তার বিচার চেয়ে যে গ্লোবাল অ্যাকটিভিজম আমরা লক্ষ করেছি, সেটাও খানিকটা সফল হয়েছে বলা যায়। কিন্তু এতে করে বাংলাদেশের কী লাভ? বাংলাদেশ ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, তাদের লালন-পালন করছে, এবং এ বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর চাপ টেকনাফ-উখিয়া-কক্সবাজারসহ বাংলাদেশের মানুষকে বহন করতে হচ্ছে। জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী দুই বছরে (আগস্ট ২০১৭-আগস্ট ২০১৯) রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার। এর সবই এদেশের মানুষের করের টাকা, যা জনগণের পকেট থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। তাই, আন্তর্জাতিক ফোরামে এসব মামলা-মোকদ্দমা এবং আইসিজের এসব আদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে কীভাবে সাহায্য করতে পারে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের লাভ হয়েছে বা হবে মোটা দাগে তিনটি।
এক. আইসিজের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে ৬ লাখ রোহিঙ্গা অবশিষ্ট আছে, তারা এখনও মারাত্মকভাবে জেনোসাইডের ঝুঁকির মধ্যে আছে। এটাই প্রমাণ করে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে বাস করা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে বেড়াতে আসেনি বরং জেনোসাইডের হাত থেকে বাঁচার জন্য লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কোনও রকমে ‘জান’ হাতে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তাই, বাংলাদেশ জান হাতে নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে একটা বড় হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয়, এ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসেবে সারাজীবন বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় দিয়ে রাখতে হবে এবং ভারণ-পোষণ করতে হবে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে এটা আবারও প্রমাণ হলো, রোহিঙ্গারা জেনোসাইডের শিকার এবং মিয়ানমার সে জেনোসাইড সংঘটন করেছে। আর বাংলাদেশ হচ্ছে এ পুরো সংকটের একটি নির্দোষ ভুক্তভোগী দেশ (ভিকটিম উইথ নো রিজন)। পুরো সংকটে যার কোনও ধরনের সম্পৃক্ততা নেই, অথচ তাকেই পুরো সংকটের ভার বহন করতে হচ্ছে—এ নির্মম সত্যটি বিশ্ববাসীর সামনে নতুন করে উপস্থাপিত হয়েছে। এ আদেশের মধ্য দিয়ে এটাই বাংলাদেশের নগদ লাভ।
দুই. বাংলাদেশ দুই দফা প্রত্যাবাসন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে প্রধানত মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে। প্রথম দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ, আর দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৯ সালের আগস্টের ২২ তারিখ। কিন্তু উভয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়েছিল মিয়ানমারের পর্যাপ্ত প্রস্তুতিহীনতা, দৃশ্যমান অনাগ্রহ এবং রোহিঙ্গাদের বিশ্বাসযোগ্য কোনও আশ্বাস দিতে না পারার কারণে। রোহিঙ্গাদের অনেক বোঝানোর পরও তারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হচ্ছিল না, যার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাদের এখনও নিরাপদ নয় বলে রোহিঙ্গারা বারবার নিজেদের আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। আইসিজের আদেশে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, মিয়ানমারে যে অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা বসবাস করছে তারা এখনও সিরিয়াসলি জেনোসাইডের ঝুঁকির মধ্যে আছে এবং যেকোনও মুহূর্তে নির্যাতনের শিকার হতে পারে। যে কারণে, আইসিজে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের যেকোনও ধরনের জেনোসাইডের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষার জন্য মিয়ানমারকে নির্দেশ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়, রোহিঙ্গারা যে জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কারণে মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হচ্ছে না, সেটা মোটাদাগে সত্য। এটা প্রকারান্তরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে নতুন করে চাপ সৃষ্টির একটা ক্ষেত্র তৈরি করবে, যা শেষ বিচারে বাংলাদেশ যে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর নিত্য চেষ্টা করছে, তাকে বেগবান করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
তিন. আইসিজের এ আদেশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক ফোরামে নতুন করে অত্যন্ত গুরুত্ব এবং তাৎপর্যের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। কেননা আইসিজে রোহিঙ্গাদের সপক্ষে ও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আদেশ দিতে গিয়ে বাংলাদেশ যে প্রায় ১৩ লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে অনেক বড় মানবতার পরিচয় দিয়েছে, সেটা নতুন করে বিশ্ববাসীর সামনে এসেছে। এখানে মনে রাখা জরুরি, প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উখিয়া এবং টেকনাফে আশ্রয় দিতে গিয়ে তাদের ভরণ-পোষণ এবং লালন-পালনের জন্য যে পরিমাণ আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার কথা, সেটা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। এ ক্রমহ্রাসমান আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, কেননা যদি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে, এতো বিপুল সংখ্যক শরণার্থী রক্ষণাবেক্ষণে বাংলাদেশ একটা বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়বে। সংকটের মধ্যে পড়বে প্রায় ১৩ লাখ নির্যাতিত এবং নিজের ঘরবাড়ি-ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত শরণার্থী। আইসিজের এ রায়ের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা পুনরায় বিশ্বসম্প্রদায়ের সামনে উন্মোচিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের কাঁধের ওপর একা যে চাপ পড়ছে, সেটাও বিশ্ববাসীর সামনে অবগুণ্ঠিত হয়েছে। ফলে, আমরা আশা করতে পারি আইসিজের রায়ের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্ববাসীর সমবেদনা নতুন করে জাগ্রত হবে এবং বাংলাদেশে বসবাসরত ১৩ লাখ রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে।
পরিশেষে বলবো, আইসিজেতে বাদী হিসেবে মামলা করেছে গাম্বিয়া এবং মামলার অভিযুক্ত বিবাদী হচ্ছে মিয়ানমার। ফলে, এখানে বাংলাদেশ মামলার কোনও পক্ষ নয় এবং মামলা-মোকদ্দমা কেন্দ্রিক আইনের কাঠামোতে বাংলাদেশের কোনও পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থান না থাকলেও বাংলাদেশ কিন্তু এ মামলার সবচেয়ে বড় অংশীজন। সে কারণেই এ মামলায় দেওয়া প্রাথমিক নির্দেশনার মধ্য দিয়ে যদি মিয়ানমার জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন ১৯৪৮-এর আর্টিক্যাল ২ ধারা অনুযায়ী মিয়ানমারে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে এবং নতুন কোনও ধরনের আক্রমণ বা জেনোসাইডের পরকিল্পনা বা চিন্তা থেকে সামরিক, আধা-সামরিক এবং অস্ত্রধারী বেসরকারি লোকের আক্রমণ থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে বাংলাদেশে বসবাসকারী ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একধরনের আস্থা এবং বিশ্বাসের জন্ম নেবে। ফলে, এ মামলার প্রাথমিক নির্দেশনা এবং চূড়ান্ত রায়, দুটোই যদি গাম্বিয়ার পক্ষে যায় অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের পক্ষে যায়, শেষ বিচারে লাভবান হবে বাংলাদেশ। আইসিজের মামলার কোনও পক্ষ বা প্রতিপক্ষ না হয়েও বাংলাদেশ যেমন নিরপেক্ষ নয় (অবশ্যই বাংলাদেশ গাম্বিয়ার পক্ষে), তেমনি এ মামলায় রায় যদি ইতিবাচক হয়, কোনও পক্ষ না হয়েও সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বাংলাদেশ। বাকিটা সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে, কেননা সময়ই সবসময় শ্রেষ্ঠ বিচারক।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।