রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ: মিয়ানমারকে কি দমানো যাবে?

আনিস আলমগীররোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে আফ্রিকার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ গাম্বিয়া ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। ১৯৪৯ সালের জাতিসংঘের গণহত্যা সনদে গাম্বিয়া ও মিয়ানমার স্বাক্ষরকারী দেশ। গত ২৩ জানুয়ারি ২০২০ আইসিজে এ বিষয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করেছেন। আদালত বিষয়টিকে আপাতত গণহত্যা হিসেবে গণ্য না করলেও আদেশটি প্রদান করেছেন জাতিসংঘের গণহত্যা সনদের দুই নম্বর অনুচ্ছেদের আলোকে।
বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণে গাম্বিয়া এই অন্তর্বর্তী আদেশ প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে আবেদন পেশ করেছিল। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন এবং ২০১৭ সালে সেনা অভিযানের কারণে চূড়ান্ত রায়ের পূর্বেই এমন একটি অন্তর্বর্তী আদেশের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক আদালত সহৃদয়তার সঙ্গে ২০১৯ সালের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর তিনদিন মিয়ানমার এবং গাম্বিয়ার বক্তব্য শুনে অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছেন।

ডিসেম্বরের ওই তিনদিন আদালত মিয়ানমারের পক্ষে তাদের স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সু চি এবং গাম্বিয়ার পক্ষে তাদের বিচার ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু তাদের বক্তব্য পেশ করেন। উভয়পক্ষে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীরাও ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে আমেরিকার স্যাটেলাইটে ধারণ করা ছবি থেকে জাতিসংঘে আমেরিকার প্রতিনিধি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জাতিসংঘে প্রকাশ করেছিল। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। ওই অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় ৭ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। ওই অভিযানে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। গ্রামের পর গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রোহিঙ্গা মা-বোনদের ধর্ষণ করা হয়। মিয়ানমার সেনাদের এই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান হিসেবে অভিহিত করেছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানে বিশেষ করে তুরস্কের কথায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।

২০১৭ সালের অক্টোবরে আসা রোহিঙ্গা এবং পূর্বে আসা রোহিঙ্গাসহ এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। রাখাইনে এখনও ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এক লাখ রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের ঘটনা কয়েক দশকব্যাপী চলছে। পাকিস্তানেও চার লাখের মতো রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। সৌদি আরবে ১৭ লাখের মতো রোহিঙ্গা চলে গেছে। বাদশাহ ফয়সাল ও বাদশাহ খালেদের সময় অর্ধেক রোহিঙ্গাকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে হজ উপলক্ষে সৌদি আরব সফরের সময় রোহিঙ্গাদের মুখে শুনেছি, বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

যাহোক, আন্তর্জাতিক আদালত ২৫ পৃষ্ঠার এই লিখিত আদেশের শুরুতে মামলার শুনানিতে আদালতের এখতিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে অং সান সু চির দেওয়া বক্তব্যের জবাবে আদালত বলেছেন, গণহত্যা ঘটেছে কী ঘটেনি সেটা বিচারের ওপর আদালতের এখতিয়ার সীমাবদ্ধ নয়। গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা অনুসরণে কোনও স্বাক্ষরকারী দেশ ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে সনদে স্বাক্ষরকারী অন্য যেকোনও দেশ আপত্তি জানালে তা নিষ্পত্তির এখতিয়ার আদালতের রয়েছে।

গাম্বিয়া এই আদালতে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার প্রক্সি হিসেবে মামলা করেছে বলে মিয়ানমারের যে দাবি, আদালত তা খারিজ করে গাম্বিয়ার মামলা করার বৈধতা স্বীকার করেছেন। আদালত বলেছেন, গাম্বিয়া তার নিজস্ব পরিচয়ে মামলা করেছে এবং ওআইসিসহ অন্য যেকোনও সংস্থার সহায়তা নেওয়ার অধিকার তার রয়েছে।

মামলার সময় মিয়ানমারের সঙ্গে গাম্বিয়ার কোনও বিরোধ ছিল না এমন দাবিও আদালত নাকচ করে দিয়েছেন। মিয়ানমারকে গাম্বিয়া ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর কূটনৈতিক পর্যায়ে চিঠির মাধ্যমে বাধ্যবাধকতা মেনে চলার বিষয়ে যে দাবি জানিয়েছিল, তার জবাব না দেওয়া উভয় দেশের মধ্যে বিরোধের একটা আলামত বলে আদালত মন্তব্য করেছেন। আদালতকে অং সাং সু চি বলেছিলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর পরিচালিত কার্যক্রম সনদের আওতায় গণহত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত বলে গণ্য করা যায় না। মিয়ানমারের এমন দাবির বিষয়ে আদালত বলেছেন, গণহত্যা ঘটেছে কি ঘটেনি এই পর্যায়ে তা বিচার্য নয়। গাম্বিয়ার অভিযোগ অনুযায়ী মিয়ানমারের কিছু কিছু কার্যক্রম সনদের শর্তগুলো পূরণ করে।

গণহত্যা সনদের আওতায় প্রতিটি রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে বাধ্যবাধকতার প্রয়োগ ও প্রতিপালন বিষয়ে আদালত অন্য কিছু প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বর্ণিত বিষয়কে সঠিক হিসেবে  (prima facie) গ্রহণ করতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন। মামলা করার এখতিয়ার গাম্বিয়ার নেই বলে অং সান সু চি যে যুক্তি প্রদান করেছিলেন, তা বাতিল করে আদালত বলেছেন, এমন দাবি সঠিক নয়। গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণে অভিন্ন স্বার্থে সনদে স্বাক্ষরকারী যেকোনও রাষ্ট্র মামলা করার এখতিয়ার রাখে। সুতরাং গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকার রয়েছে।

আদালত বলেছেন সনদের ৪১ বিধি অনুযায়ী যাদের সুরক্ষা চাওয়া হয়েছে, আদালতের সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার থাকায় আদালত গাম্বিয়ার সুরক্ষা গ্রহণের আবেদন নিয়ে পর্যালোচনা করেছে এবং সুরক্ষা গ্রহণের আদেশ মঞ্জুর করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের অন্তর্বর্তী আদেশে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা চলবে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যেকোনও নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যেন কোনও গণহত্যায় না জড়ায় সেই বিষয়ে হুঁশিয়ারি প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়া নিরাপত্তাবাহিনী যাতে উসকানি না দেয় কিংবা নির্যাতনের চেষ্টা না করে, সেজন্য ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তার একটা প্রতিবেদন মিয়ানমারকে চার মাসের মধ্যে আদালতে পেশ করতে বলা হয়েছে এবং এই মামলা চলা পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর তাদের সুরক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন মিয়ানমারকে আদালতে পেশ করতে হবে। এসব প্রতিবেদন গাম্বিয়ার কাছে তুলে ধরা হবে।

রাখাইনে এখনও ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের সুরক্ষার বিষয়ে আদালত মিয়ানমারকে সতর্ক করেছেন। আন্তর্জাতিক আদালতের প্রধান বিচারপতি আবদুল কোয়াই আহমেদ ইউসুফ ২৩ জানুয়ারি বিকাল ৩টায় আদালতে এই আদেশ পড়ে শোনান। আদালতে ১৫ জন স্থায়ী বিচারপতি, মিয়ানমার এবং গাম্বিয়ার দুইজন অ্যাডহক বিচারপতি ছিলেন। সবাই অন্তর্বর্তী আদেশগুলোর ব্যাপারে একমত হলেও আদালতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট, একজন স্থায়ী বিচারপতি এবং একজন অ্যাডহক বিচারপতি দুই একটা বিষয়ে ভিন্নমত দেন। চীনের বিচারপতি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সনদ অনুসারে গণহত্যা হয়েছে বলে মনে করেন না। তবে যেসব অত্যাচার রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত হয়েছে তার জন্য অন্তর্বর্তী আদেশ প্রযোজ্য বলে মনে করেন। আদালত গণহত্যার উদ্দেশ্যে ছিল কি ছিল না, সেই বিষয়ে বিস্তারিত নিরীক্ষা করেননি। আদালতের এ আদেশ মূল মামলার গুণাগুণ বিচারে কোনও প্রভাব ফেলবে না বলেও আদালত উল্লেখ করেছেন।

মিয়ানমার দায়িত্বজ্ঞানহীন রাষ্ট্র। কোনও কিছুকে অবহেলা করে নিশ্চুপ থাকার বদঅভ্যাস আছে। রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনার তদন্ত ও বিচার করতে মিয়ানমারকে যেহেতু খুব বেশি আগ্রহী হিসেবে দেখা যায়নি, তাই আন্তর্জাতিক জবাবদিহিমূলক প্রচেষ্টার জন্য এই আদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আবার মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে চীন ও রাশিয়া বারবার ভেটো প্রদান করেছে অতীতে। সেই কারণে রোহিঙ্গা বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ মিয়ানমারকে কোনও চাপ দিতে পারেনি। সমস্যাটারও সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব হয়নি। আদালতের আদেশকে বাস্তবায়ন করা সনদের বিবরণ অনুসারে নিরাপত্তা পরিষদের এখতিয়ার। এখন দেখা যাক মিয়ানমার কী করে এবং চীন-রাশিয়া কী ভূমিকা গ্রহণ করে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

anisalamgir@gmail.com