অর্থপাচার রোধ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাবাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এটা একদিকে যেমন খবর, তেমনি দেশের অর্থনীতি নিয়ে বড় চিন্তার বিষয়। অনেকদিন ধরেই একটা কথা প্রচলিত আছে যে, বাংলাদেশের বাণিজ্য রফতানিতে যত আয় তার চেয়ে ব্যয় বেশি। আয়ের বড় অংশ ছিদ্রপথে বিদেশে চলে যাচ্ছে। অভিযোগের আঙুল কাস্টমস আর ব্যাংক কর্তাদের দিকে। রফতানি সংস্থার মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশে তারা অর্থ নির্গমনের পথ চওড়া করছেন।
তবে রফ্তানি আয়ের একটা অংশ ব্যবসায়ীরা বিদেশে রেখে দিচ্ছেন বা শুল্ক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আন্ডার আর ওভার ইনভয়েসের খেলা খেলছেন, বিষয়টা আর তেমন নেই শুধু। ব্যবসা করবেন বা শিল্প গড়বেন বলে ব্যাংক থেকে শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দিচ্ছেন কেউ কেউ, এমন খবরই এখন বেশি আসছে ইদানীং।
এই পাচারকৃত অর্থের একটা বড় অংশই যাচ্ছে কানাডায়। আর তাই ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শীতের মধ্যেই টরন্টোর রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ জানালো একদল বাংলাদেশি। তাদের প্রতিবাদ বাংলাদেশ থেকে কানাডায় পালিয়ে আসা কথিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে, যারা নাকি সেখানে পাচার করা বিপুল সম্পদ দিয়ে আয়েশি জীবনযাপন করছেন। বিষয়টি উঠেছে জাতীয় সংসদেও। ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদে তার বক্তৃতায় বলেছেন, ‘কানাডা প্রবাসীরা এদের বিরুদ্ধে (অর্থপাচারকারী) বিক্ষোভ করেছেন। তালিকা প্রকাশ করতে বলেছেন। আমিও বলি, সংসদে ঋণখেলাপিদের মতো এই অর্থপাচারকারী-বেগমপাড়ার মালিকদের নাম প্রকাশ করা হোক।’

তালিকা হয়তো সরকার প্রকাশ করবে না, তবে অনেক নামই প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্টদের কোনও বক্তব্য নেই এ বিষয়ে। কেউ কিছু বলছে না। দুদক কিছুটা বলছে। কিন্তু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি নিয়ে চম্পট দেওয়া প্রশান্ত কুমার হালদার বা এ জাতীয় অনেক ব্যক্তি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনও আওয়াজ পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী, আবার এ দেশ থেকে অর্থপাচার হয় বেশি–এই এক অদ্ভুত দিক। ব্যাংক ঋণ মেরে দেওয়া এতটাই সহজ, স্বাভাবিক এবং নিরাপদ হয়েছে যে, খোদ সরকারদলীয় সংসদ সদস্যকে উদ্ধৃত করে একজন সম্পাদক লিখেছেন, ২০ কোটি টাকা চাইলে ব্যাংকাররা ২০০ কোটি টাকা দিতে চায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি অনেকদিন থেকেই বলছে যে, কর ফাঁকি, সরকারি সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার, ব্যাংক ঋণ আত্মসাৎ করে অসৎ ব্যবসায়ীরা টাকা পাচার করছে বিদেশে। কিন্তু অর্থপাচারের ঘটনায় কেবল সমাজবিরোধী বা ব্যবসায়ীরা যুক্ত নয়, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকারী অনেক সরকারি চাকরিজীবীও নীতি-নৈতিকতা ও দেশপ্রেম ভুলে একই পথের পথিক হয়েছেন।

মাঝে মাঝেই পত্রপত্রিকায় পড়ছি অর্থপাচারের অভিনব সব কৌশল সম্পর্কে। আইনগতভাবে দেশের বাইরে টাকা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও গত এক যুগের বেশি সময় ধরে অনেক বাংলাদেশি মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাড়ি-ফ্ল্যাট করাসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

অর্থপাচারের এই হিড়িক সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে তা শুধু নয়, অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি বয়ে আনছে। এমন ঘটনা ঘটলে কেউ আর সৎ থাকতে চাইবে না। পুঁজি পাচারের ঘটনা ঘটে মূলত সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হলে। বাস্তবতা হলো, দেশে সঞ্চয় বাড়লেও বিনিয়োগ বাড়ছে না। টাকা পাচারের আরেকটি বড় কারণ হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থপাচারের হারও দিন দিন বাড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় খোঁজা জরুরি। অর্থপাচারকারীরা যাতে কোনোভাবে পার না পায়, সরকারের উচিত তা নিশ্চিত করা। তা না হলে নানা প্রক্রিয়ায় অর্থপাচারের ঘটনা বাড়তেই থাকবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

অর্থপাচার রোধে সরকারকে সচেষ্ট হতেই হবে। আর সেজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। একটা বড় উপায় হলো যেসব দেশে টাকা গেছে সেসব দেশের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা। জানা দরকার, এই দেশগুলো কেন অর্থের উৎস না জেনে এসব পাচারকারীর অর্থ গ্রহণ করেছে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন একটি বড় প্রশ্ন। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে আরও বড় বড় ঘটনা ঘটবে বলেই আশঙ্কা। সবচেয়ে বড় কথা, সরকারের দিক থেকে একটা কঠোর বার্তা আসা দরকার। আর তার মাধ্যমেই এই অপরাধ রোধ করতে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা দৃঢ়ভাবে প্রকাশিত হবে। কিছু একটা করা না গেলে দেশে দেশে বেগমপাড়া সৃষ্টি হতেই থাকবে।  

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা