করোনার বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি

মো. জাকির হোসেনমহা আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে করোনা। একাধিকবার জিনের গঠন বদলে ডাক্তার-গবেষকদের বিভ্রান্ত করছে করোনা। তাই এর সঠিক চিকিৎসা ও কার্যকর ওষুধ খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছে। করোনা ভাইরাস কোনও করুণা করছে না, ঝড়ের বেগে ছড়াচ্ছে, যাকে বাগে পাচ্ছে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী, ২৩ মার্চ রাত ১২টা পর্যন্ত ১৯৫টির বেশি দেশ ও অঞ্চলে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯৫ জন এবং প্রাণ গেছে ১৬ হাজার ১০০ জনের। আক্রান্তের সংখ্যায় শীর্ষ ৫ দেশ হলো চীন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও জার্মানি।  মৃতের সংখ্যায় শীর্ষ পাঁচ দেশ হলো—ইতালি, চীন, স্পেন, ইরান ও ফ্রান্স। 
করোনা এমন এক ত্রাসের সৃষ্টি করেছে, মরার পর কেউ ছুঁতে পারছে না। দেখতে পারছে না। মরার বুকে আছড়ে পরে কাঁদতে পারছে না। জানাজায় লোক হচ্ছে না। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হচ্ছে না।  কোথাও কোথাও দাফন হচ্ছে না। হলেও গণকবর হচ্ছে। আবার কোথাও মৃতদেহ এত বেশি যে, সরাসরি পুড়িয়ে ফেলছে। করোনা মানুষের হৃদয় থেকে করুণা কেড়ে নিয়েছে। রাজধানীর উত্তরায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে ভর্তি ও চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয়রা। করোনা রোগী সন্দেহে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করছে না। ভর্তি রোগীর করোনা সন্দেহ হলে হাসপাতাল ভয়ে তার চিকিৎসা দিচ্ছে না। করোনা আতঙ্কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা-অবহেলায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে কানাডায় অধ্যয়নরত এক ছাত্রীর।

বাংলাদেশে করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েনি এখনও। করোনা কয়েক ধাপে মহামারির রূপ নেয়। তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন আগামী দুই সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ সংকটের হতে পারে। করোনা নিয়ে ‘খারাপ পরিস্থিতি’র আশঙ্কা পুলিশের। মাঠ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পুলিশের কর্মকর্তারা এক ‘ভয়ঙ্কর পরিণতি’র আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, সব মানুষের প্রতি আপনি বিশেষ করুণা করুন, আমাদের করোনার দুর্যোগ থেকে রক্ষা করুন। করোনা প্রতিবেশী চীন থেকে সরাসরি আমাদের দেশে না এসে ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্য হয়ে প্রবাসীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে নোঙর করেছে। করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতির জন্য আমাদের দেশ আড়াই মাস সময় পেয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এ দীর্ঘ সময়ে প্রথমদিকে আমরা যথাযথ প্রস্তুতি দূরে থাক, দায়িত্বপ্রাপ্তরা করোনার ভয়াবহতাই আমলে নেননি। মূল দায়িত্বপ্রাপ্তদের বক্তব্যই বলে দিচ্ছে করোনার বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা তেমন প্রস্তুতি নেননি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ৯ মার্চ বলেছেন, ‘করোনা ভাইরাস মারাত্মক নয়, ছোঁয়াচে’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১২ মার্চ বলছেন, ‘করোনা মারাত্মক রোগ নয়, এটি সর্দি-জ্বরের মতো’। অর্থমন্ত্রী ১৮ মার্চ বলেছেন, ‘করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজনে চীনের মতো হাসপাতাল’। করোনার ভয়াবহতা আমলে না নেওয়ার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে সরাসরি মাঠের যোদ্ধা হলেন ডাক্তার ও নার্সগণ, কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য Personal Protective Equipment (PPE) সংগ্রহ করা হয়নি। সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত মাস্ক সরবরাহ করতে পারছে না বলে নোটিশ প্রদান করেছে। নিজ উদ্যোগে মাস্ক সংগ্রহের আহ্বান জানিয়েছেন হাসপাতাল পরিচালক। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ১১ নম্বর ইউনিট নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের খরচেই বানিয়ে নিয়েছেন তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার জরুরি জিনিসপত্র। প্রয়োজনীয় পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) না থাকায় ‘করোনার ভয়ে’ কর্মবিরতি পালন শুরু করেছেন খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম না পেয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগ চিকিৎসকরা রোগী ভর্তি বন্ধের নোটিশ টাঙিয়েছিলেন। অবশ্য পরে সেটি খুলে ফেলা হয়। অথচ ২৩ মার্চ সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘এখনও পিপিই অতটা দরকার নেই’। কেবলমাত্র ঢাকায় অবস্থিত Institute of Epidemiology, Disease Control and Research (IEDCR) করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটিমাত্র করোনা নির্ণয় কেন্দ্রের সেবা কেমন হতে পারে, তা মিরপুরে করোনায় মৃত ব্যক্তির সন্তানের আহাজারি দেখে বুঝা যায়। তার সন্তান জানিয়েছেন, ‘পিতা করোনায় আক্রান্ত, ডাক্তারদের এ সন্দেহের কারণে আমরা টেস্ট এর জন্য IEDCR এর হান্টিং নম্বরে ফোন দেওয়া শুরু করি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তাদের সঙ্গে আমরা কমিউনিকেশন করতে সমর্থ হই, তারা আমাদের জানায় যেহেতু অসুস্থ ব্যক্তি বিদেশফেরত না এবং বিদেশফেরত কোনও ব্যক্তির সংস্পর্শে উনি আসেন নাই, সেহেতু এই টেস্ট ওনার জন্য প্রযোজ্য নয়, আমি তাদের বলেছিলাম উনি মসজিদে যান এবং ওখান থেকে এই ভাইরাস আসতে পারে কি না। তারা আমাদের বলেছেন, এই ভাইরাস বাংলাদেশে কমিউনিটিতে মাস লেভেলে এখনও সংক্রমিত হয়নি, সুতরাং আপনারা চিন্তা করেন না, এটা সাধারণ শ্বাসকষ্টের সমস্যা। পরের দিন আবার আমরা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ IEDCR-এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। এর পরেরদিন বিকেলে IEDCR রাজি হয় এবং রাতে টেস্ট করে এবং পরের দিন ২০ তারিখ দুপুরে IEDCR আমাদের জানায় যে রিপোর্ট পজিটিভ। রিপোর্ট প্রদানের পরদিন মৃত্যু হয় পিতার।’

ঢাকায় বসবাস করেই করোনা পরীক্ষার এ অবস্থা, ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রোগীদের কী হবে? অথচ আগে থেকে পর্যাপ্ত টেস্ট কিট সংগ্রহ করে সকল জেলা-উপজেলা হাসপাতালে সরবরাহ করা হলে ও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের যৌথ সহযোগিতা নিশ্চিত করা গেলে সংকট মোকাবিলা আরও সহজ হতো। এটি সম্ভব না হলে অন্তত জেলা পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষাগারের ব্যবস্থা করা অতি জরুরি।

বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে এরই মধ্যে অধিকাংশ দেশেরই বড় শহরগুলো লকডাউন করা হচ্ছে। গণপরিবহন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিমানবন্দর, শপিংমল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ রেখে জনসাধারণকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ঘরে অবস্থান করতে; কিন্তু এরপরও কোনোভাবেই করোনাকে পরাস্ত করা যাচ্ছে না। অনেক শহর লকডাউন থাকার পরও হু হু করে সেখানে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এমন অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরাস্তে শুধু লকডাউন যথেষ্ট নয়, সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে যে কাজটি করতে হবে তা হলো—যারা এই ভাইরাসের সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাদের খুঁজে বের করা। এরপর তাদের অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করা। শুধু লকডাউন করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর ফের এ ভাইরাস হানা দিতে পারে। তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। চীন, সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে তাদের শহরগুলো লকডাউনের পাশাপাশি সন্দেহভাজন রোগীর পরীক্ষা করেছে, ঠিক সেভাবেই অন্য দেশগুলোকে একই তৎপরতা দেখানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমাদের ব্যাপক আকারে টেস্ট কিট সংগ্রহ করতে হবে। সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা করে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিদেশফেরতদের স্ব-গৃহে সঙ্গরোধ থাকার ঐচ্ছিক ব্যবস্থা সঠিক হয়নি। কোয়ারেন্টিনে রাখতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার এখন গলদঘর্ম দশা। জরিমানা করেও স্ব-গৃহে সঙ্গরোধ করা যাচ্ছে না। সঙ্গরোধ থাকা অবস্থাতেই নিজের বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে কিংবা অন্যের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হচ্ছে, সঙ্গে আছে আড্ডা-ঘোরাঘুরি। যে কারণে মাঠে নামানো হয়েছে পুলিশ, স্বাস্থ্য বিভাগ, গোয়েন্দাসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে। ইমিগ্রেশন পুলিশের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত ১ মার্চ থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে আকাশপথে প্রায় ২ লাখ ৯৮ হাজার ৩৩৩ জন দেশে এসেছেন। তাদের একটি বড় অংশই করোনা আক্রান্ত দেশে ছিলেন। আগতদের মধ্যে রাজধানীতে রয়েছেন সর্বাধিক ৩৩ হাজার ২০ জন। এরপরই আছে চট্টগ্রাম জেলা। এ জেলায় ২০ হাজার ১৮৪ জন প্রবাসী গত ২১ দিনে ঢুকেছেন। দেশে ফেরা প্রবাসী বাংলাদেশিরা পাসপোর্ট করার সময় যে ঠিকানা ব্যবহার করেন, সেই ঠিকানা অনুযায়ী তাদের কাউকে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় অবস্থান করছেন, পুলিশের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইমিগ্রেশন পুলিশের সূত্রমতে, অনেকেই পাসপোর্ট নেওয়ার সময় গ্রামের বাড়ির স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। সঙ্গে অস্থায়ী ঠিকানাও দিয়েছেন। কিন্তু তাদের একটি বড় অংশ পাসপোর্টে প্রদত্ত স্থায়ী ঠিকানায় বছরের পর বছর ধরে থাকেই না। ফলে তাদের স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের খুঁজে বের করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন যেরূপ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গরোধ ব্যবস্থা করা হয়েছে এটি শুরু থেকে করলে করোনা বিস্তারের সম্ভাবনা হ্রাস পেত।

করোনা শনাক্ত হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে। পর্যটন এলাকাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও মানুষের চলাচল কমে যাওয়ায় সৃষ্ট মন্দায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বলছে শুধু ঢাকাতেই রিকশাচালকের সংখ্যা ২২ লাখের মতো, রিকশা প্যাডেল না ঘুরলে যাদের অনাহারে দিন কাটে। অন্যান্য দিনমজুর যেমন, বাস ড্রাইভার, হেলপার, কুলি, ভিক্ষুক, মিস্ত্রি, মাঝিদের সংখ্যা পুরো দেশে কত? লকডাউনে এদের খাবার জোগাবে কে? আমরা কি তাদের দায়ভার নিতে প্রস্তুত? অন্যান্য সময় দেশীয় সংকট মোকাবিলায় বৈদেশিক সাহায্যের যে সুযোগ থাকে, বৈশ্বিক মাত্রার সংকটের কারণে তা না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে কাজ বন্ধ হওয়ায় বিভিন্ন দেশের বেকার নাগরিকদের সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণ মজুরি ও ৩-৪ মাসের ভাতা প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমাদের সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন-ধারণের জন্য ব্যবস্থা করেছেন। সরকার এ ব্যবস্থা করলেও চ্যালেঞ্জ হবে যাদের প্রয়োজন তাদের কাছে দুর্নীতিমুক্তভাবে অনুদান পৌঁছানো। ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া নিম্ন আয়ের মানুষদের সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা পরিশোধের দুশ্চিন্তা। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এমআরএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত ৬৯৯টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রহীতা রয়েছে ব্র্যাক, আশা, ব্যুরো বাংলাদেশ, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের। এর মধ্যে ১০ লাখের বেশি ঋণগ্রহীতা রয়েছে ব্র্যাক ও আশার। এক লাখ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত ঋণদাতা এনজিওর সংখ্যা ২৬টি। ইতোমধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। করোনা আক্রান্ত মন্দা অর্থনীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ যে জুনেও কিস্তি পরিশোধে ভীষণ চাপে থাকবে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

আমাদের রফতানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় খাত গার্মেন্টস শিল্প। বিরাটসংখ্যক শ্রমজীবী এখানে কাজ করেন। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার রয়েছে এমন দেশে করোনা ভাইরাসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাবে কোনও কোনও দেশ জরুরি অবস্থা জারি করেছে। কোনও কোনও দেশ অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। ফলে এসব দেশে পোশাক পণ্যের বেচাকেনা কমে গেছে ব্যাপকভাবে। কোনও কোনও শহরে বেচাকেনা একদম বন্ধ। ফলে বাংলাদেশ থেকে পোশাক নিয়ে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে যেসব ব্র্যান্ড তারা এ মুহূর্তে পোশাক নিতে চাইছে না। এজন্য অনেক ক্রেতা অর্ডার বাতিল করছে। অনেকে অর্ডার স্থগিত করছে। এ পর্যন্ত (২২ মার্চ) দেশের তৈরি পোশাক খাতের এক হাজার ৮৯টি কারখানার প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের ক্রয় আদেশ স্থগিত করা হয়েছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা বিশাল চ্যালেঞ্জ সরকারের জন্য।

ধীরে ধীরে কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা। মিরপুর, সিলেট, ভৈরব, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাইবান্ধা, কুমিল্লা, গাজীপুর ও চুয়াডাঙ্গা থেকে খবর আসছে। করোনার সেবাদানকারী ডাক্তারও করোনায় আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। দেশে চিকিৎসক ও সেবা প্রদানে সক্ষম জনবলের সংখ্যা সীমিত। করোনার পাশাপাশি এটি ডেঙ্গুরও মৌসুম। ফলে বড় সংকট হলে এ নগণ্য সংখ্যা দ্বারা চিকিৎসা প্রদান বিরাট চ্যালেঞ্জ হবে, সেই সঙ্গে চিকিৎসা অবকাঠামোর সংকট তো রয়েছেই। করোনার শুশ্রূষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করা আবশ্যক।

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাজারে কিংবা জনসমাগম স্থলে হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং বলার সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়। গতকালও রাস্তায় যেতে যেতে দেখেছি খাবারের দোকানগুলোতে বিশাল জনসমাগম। হাতে কোয়ারেন্টিন সিল নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যাংকে যাচ্ছে, ট্রেনে ওঠে পড়ছে। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিটি পর্যায়ে করোনা বিস্তার প্রতিরোধে মানুষকে ঘরে কোয়ারেন্টিনে রাখা। কিন্তু বাস-ট্রেন-লঞ্চে মানুষের উৎসবের আমেজে ভিড় নাগরিকদের দায়িত্বহীনতার চরম দৃষ্টান্ত। আমাদের নাগরিক দায়িত্ববোধ এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই স্ব-গৃহে স্বেচ্ছা সঙ্গরোধ বা লকডাউন কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাদুল্যাপুর উপজেলার ইউএনও স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার ৯নং বনগ্রাম ইউনিয়নের হাবিবুল্লাপুর গ্রামের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেন করোনায় আক্রান্ত দুই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। রবিবার তাদের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে সাদুল্যাপুর উপজেলার পাঁচ শতাধিক মানুষ অংশ নিয়েছেন। তাই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় লকডাউনের পরিবর্তে প্রয়োজনমতো কারফিউ জারির কথা চিন্তা করা যেতে পারে।

সরকার মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান বাতিল করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, কিছু এলাকা লকডাউন করা, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিলের ওপর সুদ জুন পর্যন্ত মওকুফ করা, সেনাবাহিনী নামানো, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস ছুটি ঘোষণা, বাস-ট্রেন-লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা, করোনা মোকাবিলায় চীন থেকে সাহায্য ও সরঞ্জাম আনাসহ দৃশ্যমান অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফল হতে হলে সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, নাগরিকদেরও সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কোয়ারেন্টিনে থাকা মানে অবরুদ্ধ হওয়া নয়, নিজেকে রক্ষা করা, দেশবাসীকে রক্ষা করা। ডাক্তাররা বলছেন, আমি আপনার জন্য হাসপাতালে আছি, আপনি আমার জন্য ঘরে থাকুন। আপনি ঘরে থাকছেন তো? পরিশেষে সেই অতি পরিচিত চরণ দুটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি—স্বদেশের উপকারে নাই যার মন/কে বলে মানুষ তারে?/পশু সেই জন। 

লেখক:  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: zhossain1965@gmail.com