বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮ মার্চ, প্রথম মৃত্যুর খবর এসেছে ১৮ মার্চ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে ১৭ মার্চ থেকে। আর সারাদেশ কার্যত ‘অবরুদ্ধ’ হয়েছে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস থেকে। প্রথম দুদিন একটু নিরিবিলি হলেও তৃতীয় দিন থেকেই মানুষ আস্তে ধীরে বাইরে বেরোতে থাকে, যা বিপদ বাড়াচ্ছিলই শুধু। অবশেষে প্রথম সংক্রমণের একমাসের মাথায় এসে সরকার কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাড়ার দোকানপাট দুপুর ২টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। ওষুধের দোকান ছাড়া বাকি সব দোকান বন্ধ হয়ে যাবে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে।
সরকার এখন যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা আরও অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সারাদেশ লকডাউন করে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো। অন্তত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটির দিন থেকেই লকডাউন নিশ্চিত করা উচিত ছিল। সেটা করা হয়নি। করোনা ছুটিকে ঈদের ছুটি বানিয়ে লাখে লাখে মানুষ গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরেছে। সেই সময় এই ‘হুজ্জতিপনা’টা ঠেকাতে না পারাটা একটা বড় ভুল হয়েছে। করোনা আরামসে সারাদেশে ছড়িয়েছে। আর গত ৪ এপ্রিল গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে যেটা হয়েছে; সেটা নিছক ভুল নয়, পাপ, অন্যায়। গার্মেন্টস সেক্টর যেন সরকারের ভেতরে আরেক সরকার। সরকার যখন ছুটি বাড়াচ্ছিল, তখন মালিকরা ৫ এপ্রিল থেকে গার্মেন্টস খোলার রাখার সিদ্ধান্ত নেন। গার্মেন্টস খোলার সিদ্ধান্ত হলেও গণপরিবহন কিন্তু বন্ধই ছিল। চাকরি বাঁচাতে, পেটের দায়ে গার্মেন্টস শ্রমিকরা দলে দলে, হাজারে হাজারে হেঁটে ঢাকায় আসেন। সামাজিক দূরত্ব তো দূরের কথা, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিও মানা সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে। দিনভর তুমুল সমালোচনার পর রাতে বিজিএমইএ মালিকদের অনুরোধ করলো গার্মেন্টস বন্ধ রাখতে। কিন্তু বিজিএসইএ’র কথা অনেক মালিকই শোনেননি। তারচেয়ে বড় কথা হলো, যে শ্রমিকরা পশুর মতো গাদাগাদি করে বা হেঁটে ঢাকায় এসেছিলেন, এখন তারা ফিরবেন কীভাবে? বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের সঙ্গে টম অ্যান্ড জেরি খেলা দেখে আমার দাস ব্যবসার কথা মনে পড়ে গেলো। আধুনিক দাস প্রথায় হয়তো শিকল নেই। কিন্তু অদৃশ্য শিকল অবশ্যই আছে। লোভী মালিকরা সেই শিকলে টান দিলেই তারা জীবনের পরোয়া না করে ছুটে আসে।
করোনা এমন এক ভয়াবহ ভাইরাস, যার পেছনে দৌড়ে খুব একটা লাভ নেই। জিততে হলে এর সামনে থেকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। বাংলাদেশ খুব ভাগ্যবান রাষ্ট্র ছিল, যাদের করোনার সামনে থেকে লড়াই করার সুযোগ ছিল। কারণ গতবছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় আর বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। তার মানে বাংলাদেশে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আড়াই মাস সময় পেয়েছিল। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই আড়াই মাসে আমরা প্রায় কিছুই করতে পারিনি। প্রথম কথা হলো, আমরা যদি জুতা আবিষ্কারের গল্পটা জানতাম তাহলেই আমরা অনেক নিরাপদ থাকতে পারতাম। যদি মাস তিনেক বিমানবন্দরে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করা যেতো, তাহলে এখন আমরা অনেক নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম। বিদেশ থেকে আসা তিন লাখ মানুষকে ঠিকভাবে নজরে রাখতে পারলে বা প্রয়োজনমতো কোয়ারেন্টিনে রাখতে পারলে আজ ১৬ কোটি মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রাখতে হতো না। কিন্তু বিমানবন্দরে আমরা ছিলাম মানবতার প্রতীক। এমনকি চীনে যখন করোনার চূড়ান্ত পর্যায়, তখনও আমরা সেখান থেকে লোকজনকে আনিয়েছি। দেশে না এনে তাদের সেখানেই নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করা যেতো। এমনকি সরকারিভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও করোনা আক্রান্ত ইতালি থেকে আমরা লোকজনকে আসতে দিয়েছি। শুধু আসতে দেওয়াই নয়, বিক্ষোভের মুখে কোয়ারেন্টিনে না রেখে তাদের বাড়ি যেতে দিয়েছি। বিমানবন্দর খুলে রেখে, সবাইকে ছেড়ে দিয়ে আমরা পরে সারাদেশে ঘুরে ঘুরে প্রবাসীদের খুঁজেছি, তাদের ঘৃণা করেছি, সামাজিকভাবে বয়কট করেছি। কিন্তু তারা তো কোনও অপরাধ করেননি, বেআইনিভাবেও দেশে আসেননি। আমরা আসতে দিয়েছি বলেই তারা বৈধভাবে দেশে ঢুকেছেন। কিন্তু বিমানবন্দরে তাদের যথাযথ ব্রিফিং দেওয়া হয়নি, করণীয় বলা হয়নি। অনেকে টাকা দিয়ে পরীক্ষা ছাড়াই বিমানবন্দর পার হয়েছেন। করোনাভাইরাসও কিন্তু বাতাসে ভেসে বাংলাদেশে আসেনি। বিদেশ থেকে আসা কেউ না কেউ সেটা বহন করে এনেছেন। তারাই আস্তে আস্তে সেটা ছড়িয়েছেন। আর আমরা ইচ্ছামতো বাড়িতে গিয়ে এসে, ঘোরাঘুরি করে, মসজিদে গিয়ে সেটা দেশজুড়ে ছড়াতে সহায়তা করেছি। এখন কান্নাকাটি করে কি আর ঠেকানো যাবে করোনার বিস্তার।
যে আড়াইটি অতি মূল্যবান মাস আমরা পেয়েছিলাম, তা আমরা কাজে লাগাইনি। সে সময়ে আমরা একটা প্রপার কোয়ারেন্টিন সেন্টার গড়ে তুলতে পারিনি। ইতালির মতো উন্নত দেশ থেকে আসা লোকজনকে যখন আপনি আশকোনার হজ ক্যাম্পের ফ্লোরে রাখতে চাইবেন, তারা তো একটু প্রতিবাদ করবেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় এই ‘নবাবজাদা’দের ফাইভ স্টারে না হলেও একটা বাসযোগ্য পরিবেশে রাখা তো সরকারের পক্ষে অসম্ভব ছিল না। সেটা না করে তাদের বিক্ষোভের কাছে আত্মসমর্পণ করে এখন গোটা জাতিকে করোনার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য করছি।
আড়াই মাসে আমরা একটা ভালো হাসপাতাল তৈরি করতে পারিনি। চিকিৎসা ব্যবস্থার একটা সহজ প্রটোকল তৈরি করতে পারিনি। সাধারণ মানুষ জ্বর-শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা পায়নি। সাধারণ হাসপাতালে গেলে বলা হয়েছে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে যেতে। আর করোনার হাসপাতালে গেলে বলা হয়েছে, নিশ্চিত করোনা না হলে এখানে চিকিৎসা হবে না। আর বাংলাদেশে সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল করোনার টেস্ট করা। করোনা টেস্টকে আইইডিসিআরের হাতে কুক্ষিগত করে রাখাটা ছিল করোনা মোকাবিলায় আমাদের সবচেয়ে বড় খামেখেয়ালি।
এই খামখেয়ালির বড় দাম দিতে হবে মনে হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন বারবার বলছিল—টেস্ট টেস্ট এবং টেস্ট। তখনও আমরা উট পাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে টেস্টে অনীহা দেখিয়েছি। এখন এই তিন মাসের বেশি সময় পরও ১৬ কোটি মানুষের দেশে টেস্ট হয়েছে মাত্র চার হাজারের কিছু বেশি। অথচ এই সময়ে বিদেশ থেকেই লোক এসেছে তিন লাখের বেশি। টেস্ট না হলে আমরা জানতেই পারবো না, আমাদের পাশের কেউ শরীরে ‘করোনা বোমা’ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিনা। করোনা মোকাবিলায় টেস্টটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে টেস্ট করে কাউকে পজিটিভ পাওয়া গেলেই তাকে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দিতে হবে। ভালো আম থেকে পচা আমটা আলাদা করে ফেলতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া কিন্তু বেশি বেশি টেস্ট করেই করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। টেস্ট না করলে হয়তো আপনার সংখ্যা কম থাকবে, কিন্তু করোনার বিস্তার তো থেমে থাকবে না। বরং আমাদের চোখের আড়ালে আরও দ্রত বিস্তার ঘটবে।
করোনা যুদ্ধে আরেকটা সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো সমন্বয়হীনতা। সবাই যখন বলছে ঘরে থাকতে, তখন বাণিজ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে গার্মেন্টস খোলা রাখা সম্ভব। আর তার কথায় গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলে। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। তিনি গার্মেন্টস খোলা রাখার পক্ষে অজুহাত দাঁড় করাতেই পারেন। কিন্তু গার্মেন্টস খুলবে কী খুলবে না, সে সিদ্ধান্ত তো তিনি দেবেন না। কেন দিলেন। দেওয়ার আগে কি তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন?
গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা খেলে গোটা দেশকে করোনার ঝুঁকিতে ফেলার দায়ে তাকে এবার অবশ্যই অপসারণ করতে হবে। সমন্বয়হীনতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজেই। তিনি করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কমিটির প্রধান। কিন্তু তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, কোথায় কী সিদ্ধান্ত হয় তিনি কিছুই জানেন না। কখন গার্মেন্টস খোলা, কখন মসজিদ বন্ধ, কখন বাজার বন্ধ, কখন যান চলাচল বন্ধ; কিছুই তাকে জিজ্ঞাসা করে করা হয় না।
জাহিদ মালেক ডাক্তার নন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ডাক্তার হতেই হবে এমন কোনও কথাও নেই। কিন্তু তাকে তো তার কাজটা বুঝতে হবে। পিপিইকে ‘পিপিপি’ বলে অনেক লোক হাসিয়েছেন তিনি। আমি মনে করি না, এই উচ্চারণ বিভ্রাট বিরাট কোনও অপরাধ না। কিন্তু এটা প্রমাণ করেছেন, তিনি আসলে বিষয়টা বোঝেনই না। আমার ধারণা এই না বোঝা থেকেই তিনি শীর্ষ পর্যায়ে সময়মতো যথাযথ তথ্য দেননি, করোনার বিপদটা বলেননি। বারবার ভুল তথ্য দিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করেছেন। যার খেসারত আজ গোটা জাতিকে দিতে হচ্ছে। ডেঙ্গুর সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশের বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। আর করোনার সময় ৩৭ জন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করার পর চলে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনে। আবার কোয়ারেন্টিনে শেষ না করেই মাঠে নেমে পড়েছেন। কিন্তু নেমে পড়েই তিনি শুধু নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন আর ভুল তথ্য দিচ্ছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনায় মৃতের সংখ্যা চার বলার ঘণ্টাখানেক পর আইইডিসিআর জানায় তিন। এই করোনার সময় ছোট আকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকেও যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ডাকা হয় না, তখন তিনি নিজে না বুঝলেও সাধারণ মানুষ বোঝে তিনি অনেক আগেই নিধিরাম সর্দার হয়ে গেছেন। এই মুহূর্তে তাকে অপসারণ বা তার পদত্যাগ বিভ্রান্তি আরও বাড়াবে। তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে আইসোলেশনে পাঠানো হোক। তিনি মুক্ত থাকলে বিভ্রান্তি আরও বাড়াবেন শুধু। আর লম্বা লম্বা জাতীয় কমিটির কোনও দরকার নেই। কমিটি হোক এক সদস্যের, যার প্রধান হবেন শেখ হাসিনা। শুরুর দিকে সরকারের অনেক সিদ্ধান্তহীনতা আমাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু সামনে অনেক লম্বা লড়াই রয়ে গেছে। এখনও সময় আছে দ্রুত দৌড়ে আমরা করোনার সামনে যেতে পারি যদি, লড়াইটা অনেক সহজ হবে। পেছন থেকে দৌড়ে করোনাকে হারানো কঠিন। আর এই দৌড়ে লড়াই করার, জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা শুধু শেখ হাসিনারই আছে। মনে রাখতে হবে, করোনা কিন্তু সরকারের ব্যর্থতা নয়। আর উন্নত বিশ্বও যেখানে করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশও যে খুব সামলে উঠবে, তেমন নাও হতে পারে। তবু আমি চাই এই যুদ্ধে শেখ হাসিনাই নেতৃত্ব দিন। মমতা নিয়ে জনগণের পাশে থাকুন। জনগণ যাতে অন্তত চিকিৎসাটা পায়। লকডাউনের সময় যেন খাবারটা পায়। লকডাউনের পরে প্রণোদনা প্যাকেজের যেন যথাযথ ব্যবহার হয়।
কোথাও যেন কোনও গাফিলতি না হয়, দুর্নীতি না হয়, সমন্বয়হীনতা যেন না থাকে। নানা জায়গায় ত্রাণ নিয়ে নানান অনিয়মের খবর আসছে এখনই। তাই শেখ হাসিনাকেও এখনই কঠোর হাতে হাল ধরতে হবে। আমরা অবহেলায় অনেক সময় নষ্ট করেছি। আর এক সেকেন্ডও যেন নষ্ট না হয়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ