আমাদের এমন নিরস দিন-রাত্রী যাপন, উৎকণ্ঠার করোনাকাল আর কতদিন চলবে, কেউ জানি না। আমরা বিশেষজ্ঞ নই, তাই কোডিভ-১৯-এর প্রতিষেধকের আশায় চেয়ে আছি বিশেষজ্ঞদের দিকে, বিজ্ঞানীদের মুখের পানে। আশাজাগানিয়া অনেক কথা শুনছি। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, কোনও প্রতিষেধক এরমধ্যে আবিষ্কার হলেও মানবদেহে প্রয়োগের পর্যায়ে আসতে আরও ১৮ মাস সময় লাগবে।
দীর্ঘ দুই বছর এই ভাইরাস যদি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত তার ধ্বংসলীলা চালিয়ে যায়, তবে বিশ্বের অবস্থা নিঃসংশয়ভাবে করুণ হয়ে পড়বে। এখন কোনও দেশের কোনও সরকারের আয় রুজি নেই। পুঁজি ভেঙে সব খরচ সামাল দিচ্ছে। বড় দেশ আমেরিকা, চীন এবং জাপান—তারাও এই ভাইরাসে আক্রান্ত। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর কিছুটা সামাল দিলেও অন্য রাষ্ট্রগুলো তো বেসামাল অবস্থায় আছে। ইতালি, স্পেন আর আমেরিকার অবস্থা সবচেয়ে করুণ।
ডাক্তাররা অনেক দেশে ভয়ে রোগী পর্যন্ত দেখছেন না। বাংলাদেশেও এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন যেন ডাক্তাররা উৎসাহী হন। আবার মানুষের ভরসার জন্য প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ডাক্তার আনার কথা বলছেন। করোনা প্রতিটি রাষ্ট্রকে অপ্রস্তুত করে তুলেছে। এত দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে যে অনেককে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় দেয়নি। ব্রিটেনের মতো দেশে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের কর্মীরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন ময়লা ফেলার ব্যাগ বা বিন ব্যাগ দিয়ে বানানো পিপিই পরে। ব্রিটেনের পিপিই কেনার কি অর্থের অভাব হয়েছে! মোদ্দাকথা হলো প্রস্তুতির সময় পায়নি অনেকে।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, উন্নয়নের গতি যখন এসেছিল তখন করোনার আঘাত এলো। প্রতিটি দেশের সীমান্ত বন্ধ। মানুষ বলুন, মালামাল বলুন—সবকিছুর চলাচল প্রায় বন্ধ। বিশ্ব তো গ্লোবাল ভিলেজের রূপ নিয়েছিল। এমন অবস্থায় সব সীমান্তের স্থবিরতার একটি প্রতিক্রিয়া তো নিশ্চয়ই হবে। সঙ্গে উৎপাদন বন্ধ, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। সব মিলিয়ে একটা মন্দা নিয়ে আসবে। সুতরাং ভয়াবহতা কীরূপ হবে, তা উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না।
চীন থেকে করোনা চলে গেছে। লকডাউন প্রত্যাহার করেছে। পত্রিকায় দেখলাম লোকজন ঘরের থেকে বের হয়ে পরস্পর কোলাকুলি করছে। কিন্তু আরেকটা বিষয় দেখলাম, উহানের যে বন্যপ্রাণীর বাজারে বাদুড়, প্যাঙ্গোলিনসহ নানা প্রাণী বিক্রি হতো, যেখান থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে ছিল—সেই বাজার নাকি পুনরায় বসছে এবং বন্যপ্রাণীর রমরমা ব্যবসাও শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা ক্যাম্পেইনাররা চীনের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা বন্যপ্রাণী বাণিজ্য স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করে।
এটা দেখে উদ্বিগ্ন হলাম কারণ করোনার চেয়ে আরও ভয়াবহ কোনও ভাইরাস যদি ছড়ায়, তবে তখন কী উপায় হবে! বিশ্ববাসীর এত বড় একটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হলো, তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আগেই আবার ওই প্রাণীগুলোকে বাজারে বসানো কি উচিত হলো চীনাদের! চীন তার অনেক কথাই বাইরে আসতে দেয় না। সে কারণে সত্য-মিথ্যা সবই ছড়ায়। এখন ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, উহানে ৫০ হাজার মানুষ মরেছে। চীনে খোলামেলা কথা বলার স্বাধীনতা নেই, দেখা যায় অনেক সত্য বাধা ডিঙিয়ে আসতে পারে না। যা এলো তা হয়তো সত্য নয়।
পুনরায় বন্যপ্রাণীর বাজার বসার কথাটা সত্য হলে তা নিয়ে বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন হতে হয়। কথা যদি সত্য হয়, আমরা চীন সরকারকে অনুরোধ করবো ওই বাজার যেন স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ দুনিয়ার মানুষকে বাঁচাতে হবে। সার্স ভাইরাসও চীন থেকে উদ্ভব হয়েছিল। আর করোনাভাইরাস এমন যে শ্বাস-প্রশ্বাসে পর্যন্ত ছড়াচ্ছে। যে কারণে তিন মাসের মধ্যে সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভাইরাসকে খুবই যত্নের সঙ্গে প্রতিরোধ করতে হবে।
বাংলাদেশে এই ভাইরাস এসেছে বিদেশ থেকে আগত লোকের মাধ্যমে। অবাধে বিমানবন্দর দিয়ে ভাইরাস ঢুকেছে। যারা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। এখন তারা শহরে সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামেও ছড়িয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি আর মৃতের সংখ্যাও বেশি। সরকার এই দুই এলাকার মধ্যে ভাইরাসকে সীমাবদ্ধ রেখে নির্মূল করার প্রাণপণ চেষ্টা করা দরকার। ব্যাপকভাবে ছড়ালে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল হবে।
দেখা যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করছে সরকার। এরমধ্যে চুরির খবরও আসছে। গরিব মানুষদের ত্রাণের ট্রাক লুট করা, ত্রাণের জন্য মিছিলের খবরও আসছে। এসব ভয়ানক কথা। যেসব এলাকা এমনিতেই দরিদ্রপীড়িত, ওইসব এলাকার প্রতি বেশি যত্নবান হতে হবে। তবে একটি বিষয়ে সতর্ক হতে হবে, উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ সরবরাহের ব্যাপারে যেন কোনও শিথিলতা না হয়।
আমরা একটা বিষয় দেখে আতঙ্কিত হই, যখন কোনও নাজুক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একযোগে তাদের দাবি উত্থাপন করে। ১৭ কোটি মানুষকে ত্রাণ দেওয়া সম্ভব নয়। আর সব মানুষের ত্রাণের প্রয়োজন নেই। সরকারের গুদামে ১৭ লাখ টন খাদ্য মজুত আছে বলে সরকার স্বীকার করেছে। মানুষের ঘরে ঘরেও খাদ্য মজুত রয়েছে। সুতরাং ধৈর্যসহকারে চললে ব্যাপক কোনও অনটন হওয়ার কথা নয়। তবে সরকারকে অনুরোধ করবো যেন শক্ত হাতে সবকিছু সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। শিথিলতা এলে বিপর্যয় অনিবার্য।
আবার সাধারণ মানুষকে অনুরোধ করব যেন কোনও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা না করে। সরকারকে যদি এই সময়ে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হয়, তবে দুঃখের কোনও সীমা-পরিসীমা থাকবে না। আমরা ঘরে আবদ্ধ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখছি ডাক্তাররা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে রোগী দেখতে চাচ্ছেন না। যদি তাই হয়, এটা ডাক্তারদের গুরুতর অপরাধ। নন্দলালদের এই পেশায় আসা দরকার ছিল না। আমরা সরকারকে অনুরোধ করবো, চীন থেকে কিছু ডাক্তার-নার্স আনার জন্য। আর চিকিৎসা সরঞ্জাম মজুতের যেন প্রাণপণ চেষ্টা করে।
এই সময়ে করোনার প্রধান চিকিৎসা চলছে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে। শনিবার (১১ এপ্রিল) ওই হাসপাতালের ছয় চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের দুজনের বক্তব্য শুনে আবার জনগণের ভাবতে হচ্ছে—ডাক্তারদের ভিলেন বানানোর চেষ্টা হচ্ছে না তো? শুরু থেকে বলে আসছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সময়মতো কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। বিদেশ থেকে অবাধে এই ভাইরাস আসতে দিয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর এই দায় এড়াতে পারবেন না। তারা ভাইরাস দেখা দেওয়ার পর প্রায় তিন মাস ধরে পদক্ষেপ না নিয়ে, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা না করে, কোভিড রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল ঠিক না করে, পর্যাপ্ত পরীক্ষার উদ্যোগ না নিয়ে—‘আমরা প্রস্তুত বলে’ ডাক্তার এবং জনগণের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। এখন ডাক্তার ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজেদের অদক্ষতা, নিষ্ক্রিয়তা, অপকর্ম ঢাকতে চাচ্ছে বলে অভিযোগ ডাক্তারদের।
ডাক্তাররা না বাঁচলে রোগীরা বাঁচবে কী করে! ডাক্তাররা আক্রান্ত হলে সবার আগে তো রোগীরা আক্রান্ত হবে। স্বাস্থ্যসেবকদের কাজের পরিবেশ এবং থাকার ব্যবস্থা তো শুরু থেকে করা উচিত ছিল।ডেজিগনেটেড হাসপাতাল কোভিড পজিটিভ না হলে রোগী নেবে না, কারণ সে নেগেটিভ হলে ওখানে ঢুকে ইনফেক্টেড হতে পারে। অন্য হাসপাতাল পজিটিভ হলে রোগী ভর্তি করাবে না, কারণ তার মাধ্যমে হাসপাতালের অন্য রোগীরা আক্রান্ত হতে পারে। চিকিৎসক রিজার্ভ রাখারও ব্যাপার আছে। সবাই আক্রান্ত হলে চিকিৎসক সঙ্কট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এসব মামুলি বিষয়ও যদি স্বাস্থ্যসেবা মন্ত্রণালয়ের চালকরা না জানেন, ব্যবস্থা না করেন, তাহলে ডাক্তাররা তো চিকিৎসা দিতে ভয় পাবেনই। ডাক্তার নিজে না বাঁচলে রোগীকে বাঁচাবেন কী করে!
তাই এখন হুমকি-ধামকি, অকারণে বা সামান্য কারণে ডাক্তারদের বরখাস্ত না করে আপসে কাজ করা ভালো। পরস্পরের লড়াইয়ের সময় এখন না। বেঁচে থাকলে ডাক্তারদের প্রতি সরকার, জনগণের প্রতি ডাক্তারদের রাগ দেখানোর অনেক সময় পাওয়া যাবে। করোনা চিকিৎসায় সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা না নিলে দ্রুত ফল পাওয়া যাবে না। গরিবদের মাঝে ত্রাণ, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আর নির্ভীক ডাক্তার—এই হচ্ছে এখনকার মুখ্য চাহিদা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।