একটা বছর কারও কারও জন্য সারা বছরের খোরাক। তাদের কথা বলছি যারা এই সময়টার অপেক্ষায় থাকে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহর, প্রতিটি জেলা শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত এলাকায়ও মানুষ সাধ্যমতো কেনাকাটা করে। নতুন বছরকে সাদরে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। হালখাতা হয়, ছোট আর মাঝারি কারু ও ফ্যাশন শিল্পের বদৌলতে সাধ্যমতো নতুন জামাকাপড় গায়ে দিয়ে নতুন বছরের ঘর থেকে বের হয় সব শ্রেণির মানুষ দেশজুড়ে। কত যে মেলা, কত যে আনন্দ দেশব্যাপী থাকে। এই নববর্ষের অর্থনীতির যে চাঞ্চল্য, তা এবার নেই। ফলে কত মানুষের এবার আয় হলো না, সে কথা আমরা কেউ জানি না।
আপামর জনসাধারণ ঘরবন্দি। এই বন্দিদশার শেষ কবে জানা নেই কারও। শুধু যারা দিন আনে দিন খায় তারা নয়, সাধারণ আয় রোজগার করা মানুষ রুজি হারিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ত্রাণের নুন, তেল, আটা আর ডাল সংগ্রহে ব্যস্ত। পেটটা তো চালাতে হবে। এই যখন অবস্থা, তখন আর বৈশাখের কেনাকাটা হয় কীভাবে?
সরকারি চাকরিজীবী আর ধনীলোক ছাড়া করপোরেট খাতের সচ্ছল চাকরিজীবীরাও এখন চিন্তিত। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করে করে তাদের অন্তরেও ভয়। লিকিউড সোপ আর স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে জীবাণু থেকে মুক্তির উপায় পেলেও তারা ভাবছে কবে না জানি তাদের অফিস যাওয়াটা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ভাইরাসের উদ্বেগ আর রুজি বন্ধের উদ্বেগ এখন একাকার।
দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতিকে উপেক্ষা করে সরকার সব কার্যক্রম বন্ধ করে সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে চলেছে। এ অবস্থায় হতদরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে। দিন আনে দিন খায় এমন মানুষ না খেয়ে দিনাতিপাত করছে। ফলে বিত্তবানরাও এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। ঠিক এমনি সময়ে প্রধানমন্ত্রী অসহায়দের জন্য বড় ধরনের সাহায্য নিয়ে হাজির হয়েছে। এই দুর্যোগকালে কোনও মানুষ যেন অসহায়ত্বের জীবনযাপন না করে। পৌঁছে গেছে প্রতিটি ইউনিয়নে ত্রাণসামগ্রী। যার যেটুকু সামর্থ্য আছে, সেটুকু নিয়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে।
কিন্তু অন্য ছবিও আছে। সভ্যতার সঙ্কট আজ যখন নতুন মোড়কে নতুন চেহারায় আবির্ভূত, তখন দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ প্রাচীনই রয়ে গেছে। সরকার যখন তার সীমিত সম্পদ নিয়েও মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, তখন আমরা দেখছি একটা অংশ কী আচরণ করছে। সারাদেশে যেন এক পাইকারি ভ্রষ্টাচারের দৃশ্য। ত্রাণের চাল চুরি হচ্ছে দেদার, ওএমএসের সামগ্রী মেরে দেওয়া হচ্ছে এবং এসব অভিযোগের বেশিরভাগ আসছে তাদের বিরুদ্ধে যারা ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে ডিলারশিপের ব্যবসা করে। প্রধানমন্ত্রী যিনি ক্ষমতাসীন দলেরও প্রধান, তার কড়া নির্দেশ দরিদ্র মানুষের ত্রাণ নিয়ে যেন কোনও দুর্নীতি না হয়। নিজ দলের প্রধানের, দেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক নির্দেশ অমান্য করার মতো সাহস যারা দেখায়, তারা কোন যোগ্যতায় শাসক দলের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে?
কেউ কেউ হয়তো বলবেন এত নেতিবাচক হওয়ার কিছু নেই। সরকারি দলের লোকদের ধরছে সরকারই, কাউকে ছাড়া হচ্ছে না, দলীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। সারাবিশ্বেই এমনটা আছে। কী হচ্ছে, তা সবাই দেখছেন; সেটাই সব নয়। সবখানেই বিশৃঙ্খলা, অসাম্য, অসঙ্গতি আছে। এসব চোরকে বাদ দিলে দেশ সামগ্রিকভাবে মনুষ্যত্বের পথেই চলছে এবং তা সম্ভব হয়েছে সম্মিলিতভাবে সবাই যেহেতু সরকার প্রধানের আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সততা, মনুষ্যত্ব, ন্যায়বিচারের পথে দেশ আছে কিনা, সেটাই বড় কথা। আমরাও বিশ্বাস করতে চাই যে, কিছু অসৎ মানুষের জন্য এই মনুষ্যত্বের পথ অপ্রয়োজনীয় বা মিথ্যে হয়ে যায় না।
খবর আসছে যে, ইতালিতে মাফিয়ারা পর্যন্ত এই দুর্দিনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের সম্পদ বিলিয়ে দিচ্ছে। কঠিন সময়ে ইতালির গরিব মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে সেদেশের বিভিন্ন মাফিয়া গোষ্ঠী। খাবারের পাশাপাশি মানুষের কাছে দৈনন্দিন প্রয়োজনের জরুরি সামগ্রীও পৌঁছে দিচ্ছে মাফিয়া দলগুলো। মাফিয়া গোষ্ঠীগুলোর নির্দেশে দক্ষিণ ইতালির রাজধানী নেপলসে সুদের কারবারিরা বিনা সুদে মানুষকে ঋণও দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের এই চাল চোর, ত্রাণ চোররা একদম আলাদা ধাতুতে গড়া। এরা বুঝিয়ে দিচ্ছে এমন ক্রান্তিকালেও কিছু মানুষ কতটা অতলে নামতে পারে। এক কথায় তা অকল্পনীয়। একদিন আমরা হয়তো ভাইরাসকে পরাজিত করবো, কিন্তু এই ভ্রষ্ট রাজনীতিকদের কারণে রাজনীতির অভ্যন্তর হতে নৈতিকতার কণ্ঠস্বর আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পারব কিনা জানি না।
লেখক: সাংবাদিক