কাশ্মিরিদের দুর্ভোগ ও করোনার দুর্যোগ

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীআট মাস ধরে কাশ্মিরে কারফিউ এবং লকডাইন জারি আছে। আবার করোনাভাইরাস ঠেকাতে ভারত গত ২৫ মার্চ থেকে সারাদেশে লকডাইন শুরু করেছে, যা এখনও জারি আছে। লকডাউনের এক সপ্তাহের মধ্যে যখন সবাই হাঁপিয়ে ওঠে, ভারতের এনডিটিভির প্রখ্যাত সাংবাদিক রবিশ কুমার তার প্রাইমটাইম শোতে কাশ্মিরিদের বিষয়টি তুলে আনেন। এই ক’দিনে আপনাদের এই অবস্থা, তাহলে কাশ্মিরিদের কী হাল ভাবুন। আর আপনি তো সৌভাগ্যবান যে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে সুপার শপে যেতে পারেন, বাসায় বসে ইন্টারনেট চালাতে পারছেন, তাদের সেই সুযোগও নেই।
সত্যি দুনিয়ার মানুষের এখন উপলব্ধি করার সময় কীভাবে চলছে কাশ্মিরিদের জীবনযাত্রা, যখন এই ক’দিনের লকডাউনে সবাই বাসায় বসে দিশেহারা। গত ৫ আগস্ট ২০১৯ ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ঘোষণার মধ্য দিয়ে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। জম্মু-কাশ্মিরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে পার্লামেন্টে পাস হয় একটি বিলও। ৯ আগস্ট রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আইনে পরিণত হয় তা। এই পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে কাশ্মিরজুড়ে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক অতিরিক্ত সেনা। ইন্টারনেট-মোবাইল পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়। আটক করা হয় সেখানকার শীর্ষ রাজনীতিকদের।

আমরা সবাই যখন বাসায় বন্দি, তখন ফেসবুকে ভারতের ইকোনমিক টাইমসের রিপোর্টার অরবিন্দ মিশ্রের একটি স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়েছে। গত ক’দিন ধরে শেয়ার হচ্ছে খুব। বাংলাদেশেও অনেকে তা শেয়ার করছেন। দেশে-বিদেশে নানা সমালোচনায়, সাত মাসের মাথায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকজন এমপিকে এনে কাশ্মির পরিদর্শন করানো হয়েছিল। এই আয়োজন করেছিল ভারত সরকার নিজেই। সেই পরিদর্শক দলের সঙ্গে থাকার অনুমতি দেওয়া হয় দেশের কয়েকজন ‘বাছাই করা’ সাংবাদিককে, যাতে কাশ্মির নিয়ে রিপোর্টিং করা হলেও তা যেন সরকারের বিরুদ্ধে না যায়। সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন ইকোনমিক টাইমসের অরবিন্দ মিশ্র। লকডাউনের নতুন উপলব্ধিতে ক’দিন আগে তিনি এক কাশ্মিরি মেয়েকে নিয়ে রিপোর্ট করেন। জানালায় দাঁড়ানো ওই মেয়ের ছবিও যায় রিপোর্টের সঙ্গে। আবার এরমধ্যে তার ওই কাশ্মির ভ্রমণের রিপোর্ট নিয়ে বানানো একটি ছোট্ট ডকুড্রামাও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে এখন।

সেখানে দেখা যায় সফরকালে অরবিন্দ মিশ্র যখন তার পুরনো এক কাশ্মিরি বন্ধুর বাসায় কয়েক মিনিটের জন্য যাওয়ার অনুমতি পান, সিঁড়ির কাছে নাফিসা উমর নামে তার বন্ধুর এক প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা হয়। নাফিসা তাদের এই কয়মাসের অবরুদ্ধ কারফিউ জীবনের দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে তার এক প্রার্থনার কথা বলেন। কী প্রার্থনা অরবিন্দ জানতে চাইলে নাফিসা বলেন, ‘ইয়া আল্লাহ! যা কিছু আমাদের ওপর হচ্ছে তা যেন অন্য কারোর ওপর না হয়, শুধু তুমি এমন একটা কিছু করে দাও, যাতে গোটা পৃথিবী কিছুদিনের জন্য নিজেদের ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে বাধ্য হয়, সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, থেমে যায়। তাহলে হয়তো দুনিয়া এটা অনুভব করতে পারবে যে, আমরা বেঁচে আছি কেমন করে!’

অরবিন্দের মূল কথা, সারা বিশ্ব লকডাউনের শিকার হওয়ার কারণ তারা কাশ্মিরের ব্যাপারে নীরব। অরবিন্দ বিস্মিত, তাহলে ঈশ্বর কি নাফিসার প্রার্থনা কবুল করে ফেললো!

ভারতীয় পত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটের আহমদাবাদ সিভিল হসপিটালে দুটি আলাদা আলাদা ওয়ার্ডে হিন্দু ও মুসলিম রোগীদের ধর্ম বিচার করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আরও অভিযোগ, মুসলিম রোগীদের প্রতি অবহেলা করা হচ্ছে। তাদের দিকে নজরই দিচ্ছেন না হাসপাতালের ডাক্তার , নার্স ও অন্যান্য কর্মীরা। দেখা যাচ্ছে, ভারতে মুসলমানদের হেয় করা আর তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো এই করোনাকালেও থামেনি। তাবলিগ জামাতকে করোনা ছড়ানোর জন্য দায়ী করে সারাদেশে তোলপাড় শেষে এখন সরকার করোনা বিষয়ক এক নোটে ছোট্ট করে বলছে, করোনার জন্য কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে দায়ী করা ঠিক না। করোনার মধ্যেও নাগরিকত্ব বিল পাস করাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার পিছ পা হয়নি। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে পাস করিয়ে দিয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এই নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ব্যাপক গণআন্দোলন হয়েছে। থামানো হয়েছে তা ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে চলা দিল্লির দাঙ্গা দিয়ে। প্রতিটি রাজ্যে ব্যাপক গণমিছিল হয়েছিল। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আইনটির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকায় ছিলেন। তিনি করোনার ভয়াবহতা শুরুর আগেও কলকাতায় দুই লাখ লোকের গণমিছিল করেছিলেন।

পশ্চিমবাংলা, কেরালা, বিহার এবং পাঞ্জাবের বিধানসভাসহ আরও কয়েকটি রাজ্য বিধানসভার প্রস্তাব পাস করেছিল যে তারা তাদের রাজ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী এবং জনগণনা আইন কার্যকর হতে দেবে না। ভারতের জন্য আইন প্রণয়নের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হলো ভারতীয় লোকসভা। এখন বড় বড় রাজ্যের বিধানসভা প্রস্তাব পাস করেছে যে তারা এই আইন তাদের রাজ্যে কার্যকর হতে দেবে না। অথচ ভারতীয় লোকসভায় গৃহীত আইন কোনও রাজ্য বিধানসভা পর্যালোচনা ছাড়া তার রাজ্যে কার্যকর করতে বাধ্য। তাহলে এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় সার্বভৌমত্ব ভাঙনের মুখে পড়ল কিনা দেখা যাবে করোনাকাল শেষ হলে।

ভারত বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। পণ্ডিতেরা বলেন যা নেই ভারতে, তা নেই জগতে। আর অনুরূপ বৈচিত্র্যের কথা চিন্তা করেই ভারতের স্বাধীনতার স্থপতিরা বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য সাধনের লক্ষ্যে সংবিধান রচনা করেছিলেন। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস একটানা ক্ষমতায় ছিল। এরপর মোরারজি দেশাই, দেবগৌড়া, চন্দ্রশেখর, ভিপি সিং, এমনকি বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়িও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, কিন্তু কেউই স্বাধীনতার স্থপতিদের রচিত এই শাসনতন্ত্র সংশোধনের সাহস করেননি। মৌলিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে ছোটখাটো সংশোধনীতেও তারা সতর্কতা অবলম্বন করতেন।

স্বাধীনতার মুখ্য স্থপতিদের মধ্যে জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ আর সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ছিলেন অগ্রগণ্য। নেহরু আর আজাদের ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য আর সর্দার প্যাটেল ছিলেন রূঢ় বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। নেহরুর লেখাপড়ার প্রতি বহির্বিশ্ব আস্থাশীল ছিল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় একবার প্রস্তাব দিয়েছিল তাকে চ্যান্সেলর করার জন্য। নেহরুর অনিচ্ছার কারণে তা হয়নি। এসব পণ্ডিত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে ভারতের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন।

কাশ্মির সম্পর্কে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর জম্মু ও কাশ্মির এবং লাদাককে দুইটি পৃথক অঞ্চল ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় শাসনে আনা হয়েছে। এর মধ্যে কাশ্মির সম্পর্কে একটা বিতর্কিত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাতে কাশ্মিরের বাসিন্দাদের নতুন পরিচয় দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যারা জম্মু-কাশ্মিরে ১৫ বছর ধরে বসবাস করছেন, সাত বছর সেখানে লেখাপড়া করছেন এবং সেখান থেকেই দশম বা দ্বাদশ শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়েছেন, তারাই কেবল স্থায়ী বাসিন্দা (ডোমিসাইল) সনদ পেতে পারেন। কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি গবেষণাগারে যেসব কর্মী জম্মু-কাশ্মিরে কাজ করছেন, তাদের সন্তানেরা কনস্টেবল, এলডিসি পদের জন্য আবেদন করতে পারবে, আর জম্মু-কাশ্মিরের বাকি পদগুলোর জন্য ভারতের যেকোনও নাগরিক আবেদন করতে পারবেন। ৩৭০ ধারায় কাশ্মিরের জন্য যেসব সংরক্ষণ বিধি ছিল, এই প্রজ্ঞাপনের দ্বারা সব বিলুপ্ত করে দেওয়া হলো। কাশ্মির গত আট মাসব্যাপী অচল হয়ে আছে। লকডাউন চলছে। এই প্রজ্ঞাপনের কারণে হয়তোবা কাশ্মিরের অস্থিরতা আরও বাড়বে।

ভারত বিভক্তির সময় ভারতে মুসলমান ছিল পাঁচ কোটি। এখন ভারত সরকার বলে ২২ কোটি। কিন্তু প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারসহ বহু সাংবাদিকের লেখা দেখেছি এবং ভারতীয় মুসলমান নেতারা দাবি করেন, ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ৩০ কোটি। ভারতীয় মুসলমানরা ভারত বিভক্তির পর বহু দাঙ্গার সম্মুখীন হয়েছে, অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, কিন্তু কখনও রাস্তায় নামেনি। এবার তারা নাগরিকত্ব সংশোধনী ও জনগণনার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, নদোয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় আর জামিয়া মিলিয়ার শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ছিল। এমনকি মুসলিম নারীরা দীর্ঘ দিন ধরে দিল্লির শাহীনবাগে অবরোধ সৃষ্টি করে রেখেছিল। দিল্লির দাঙ্গায় ৫৭ জন প্রাণ হারিয়েছে। পিঠ ঠেকে যাওয়ায় মুসলমানদের হয়তো রাস্তায় নামতে সাহসী করে তুলেছে। কিন্তু সবকিছু স্তব্ধ করে দিয়েছে করোনা। মুসলমানরা স্তব্ধ হলেও থেমে নেই মোদির মিডিয়া। তারা সমানে চালিয়ে যাচ্ছে ঘৃণার চাষ।

মোদি সরকার ধর্ম, জাত, সম্প্রদায়ের নামে সমাজকে দ্রুত বিভাজন করছে। এই বিভাজন কিন্তু মারাত্মক রূপ নেবে, যা শেষ পর্যন্ত ভারতের সংহতিকেও হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে। ভারতীয় জনতা পার্টির কেউ বা তাদের পূর্বের হিন্দু মহাসভা বা জনসংঘের নেতাদের শস্য পরিমাণ অবদান নেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে। তখনও তাদের অবদান ছিল সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টিতে, বিভাজন সৃষ্টিতে, এখনও তারা সেই পথে হাঁটছে। করোনা দুর্যোগের আগেই যে বিভাজন দুর্যোগের বীজ মোদি-অমিত শাহ বপন করেছেন, তা ক্ষয় রোগের মতো ভারতকে মরার পথে টানবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com