করোনা যুদ্ধে লড়ছেন একা একজন শেখ হাসিনা

 

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীকরোনাভাইরাসের দুর্যোগের সময়েও দক্ষিণ কোরিয়ায় জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, আর অনুল্লেখযোগ্য হলেও ঢাকার একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন হয়েছে। সংক্ষিপ্ত হলেও গত ১৮ এপ্রিল সংসদের অধিবেশন বসেছিল একদিনের জন্য। এক্ষেত্রে উভয় দেশের সরকারের শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার প্রতি আনুগত্য প্রশংসনীয়।








প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছেন। তার ভাষণ সংক্ষিপ্ত হলেও দিকনির্দেশনামূলক সব কথাই তিনি বলেছেন। দোষে-গুণে মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মানুষ, দোষ-গুণের সংমিশ্রণ তার মধ্যে রয়েছে। তবে স্রষ্টার কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। কারণ, তিনি এই গভীর সংকটের সময় শেখ হাসিনার মতো মানুষকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে রেখেছেন। তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তিনি সাহসী এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সময় তার সাহস আরও বেড়ে যায়। শেখ হাসিনা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন। দুর্যোগের সময় তার বুদ্ধিমত্তার প্রখরতাও চোখে পড়ে।

সরকারি রাজস্ব আয় খরচ করে বসে বসে রাষ্ট্র চালনা আর দুর্যোগের সময় রাষ্ট্র পরিচালনা করা এক কথা নয়। শেখ হাসিনার বৈশিষ্ট্য হলো উভয় সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা রয়েছে তার। এখন তার বয়স বেড়েছে। জানি না কখন কী অবস্থা হয়। তবে তিনি পরিশ্রমবিমুখ সরকার প্রধান নন। খুবই কঠিন কঠোর পরিশ্রমী। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি স্রষ্টাতে আত্মসমর্পিত। পরিপূর্ণ আত্মসমর্পিত মানুষকে আল্লাহ সহজে অপমান করেন না। জানি না করোনা মোকাবিলায় তিনি কতটুকু সফলতা দেখাতে পারবেন। ষড়যন্ত্রকারীরা তো এই সময়েও মিথ্যাচার, গুজব প্রচারে থেমে নেই।

তবে আজ পর্যন্ত এটা পরিষ্কার, তিনি একাই লড়ছেন এই যুদ্ধে। যে ক’টি ভিডিও কনফারেন্স দেখলাম, মন্ত্রী-আমলাদের স্তুতিযুক্ত কথা শুনলাম, আর রাষ্ট্রনায়কসুলভ সিদ্ধান্ত, সুচিন্তিত মতামত দিতে দেখলাম শেখ হাসিনাকে। তিনি সাহস হারাননি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না। আগে থেকে এই মন্ত্রণালয়টির দুর্নীতির খবর প্রকাশিত। দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভয়ংকর। মন্ত্রী-সচিব সবাইকে 'অকামের ঢেঁকি' মনে হচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনা গৃহের কর্তার মতো খুঁটিনাটি সব দেখছেন। নির্দেশ নিচ্ছেন। সমাধান দিচ্ছেন। হিসেবি গিন্নির মতো ঘরে রাখা খাদ্যভাণ্ডার, মাঠে থাকা শস্যের হিসাব রাখছেন। ফসল তুলতে পরামর্শ দিচ্ছেন। হাওরের কৃষকদের জন্য ধানকাটার যন্ত্র দিচ্ছেন। বলা যেতে পারে একাই লড়ছেন সাহসকে সঙ্গী করে। করোনা অবশ্য বাংলাদেশের একার ব্যাপার নয়। এটা তো বৈশ্বিক ব্যাপার।

প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভার এবারের টিমটা খুবই দুর্বল টিম হয়েছে। এই কথা সবাই বলেন। আর সবাই আতঙ্কিতও, কারণ কখন কী ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তারা! সাম্প্রতিক সময়ে কিছু লোক পরামর্শ দিয়েছেন প্রয়োজনে দুর্যোগ সামাল দিতে নতুন টাকা ছাপানোর ব্যবস্থা করতেও সরকার যাতে দ্বিধা না করে। এটা মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো পরামর্শ। মুদ্রা ব্যবস্থায় মুদ্রার কোনও সংকট সৃষ্টি হয়নি। নতুন মুদ্রা ছাপানোর প্রয়োজন কী! নোট বাতিলের মতো অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় ছোট্ট ভুলের জন্য নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতের অগ্রগতিতে বড় একটা বাধা সৃষ্টি করেছেন বলে মনমোহন সিং, চিদাম্বরম, অমর্ত্য সেনের মতো জগৎখ্যাত অর্থনীতিবিদরা অভিমত দিয়েছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, অর্থনীতির ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যেন অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নেওয়া হয়। নাপিতের পরামর্শে অপারেশন চলে না। অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র কাজও মেজর অপারেশনের মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি এবং জাপান বিধিবিধানের বাইরে নোট ছাপিয়ে বাজারে ছেড়ে তাদের অর্থনীতিকে ভেঙে খান খান করে দিয়েছিল। এক মাথার চুল কাটাতে মাথা বোঝাই টাকা নিয়ে যেতে হতো। আমাদের দেশেও বিধিবিধানের বাইরে গিয়ে কোনও কাজ করতে গেলে চালের কেজি ২০০ টাকা হবে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো সংকটের সময় যেন হুঁশ না হারান।

করোনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। তার শেষ কোথায় কেউ জানেন না। অনেকে বলছেন করোনা নাকি চার বছর অব্যাহত থাকবে। কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। প্লেগ পাঁচ বছর স্থায়ী ছিল। ১৫ কোটি মানুষ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। প্লেগ থেকেও মানবজাতি মুক্তি পেয়েছে। আমি আশাবাদী যে করোনা থেকেও বিশ্ববাসী মুক্তি পাবেন। তবে চার বছর ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকলে সভ্যতার বিবর্তন হবে। আমরা আশাবাদী, এর মধ্যে কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে গেলে হয়তো দেশের প্রাণস্পন্দন থেমে থাকবে না। এখন কৃষির ওপর জোর দিতে হবে এবং কৃষি কাজে কৃষি শ্রমিকদের কাজ করার মতো উপায় বের করার চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। সীমান্ত বন্ধ। কোনও দেশ থেকে কোনও কিছু আসছে না। বাংলাদেশ থেকেও কোনও দেশে কিছু যাচ্ছে না। অনুরূপ একটি লকডাউন অব্যাহত থাকলে নিত্যপণ্যের অভাব দেখা দিতে পারে।

দেশের কোথাও কোথাও ত্রাণের চাল চুরি হওয়ার খবর আসছে। হোক সেটা নগণ্য সংখ্যায়, তারপরও কঠোর হাতে এদের দমন করতে হবে। এমন সাজা দিতে হবে যাতে অন্যরা সাহস করতে না পারে। ত্রাণের চাল লুট হওয়া কোনও শুভ লক্ষণ নয়। ত্রাণ নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি হলে দেশের অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। রি‌লিফ, টি‌সি‌বি পণ্য, ভিজিএফ এবং ওএমএস সু‌বিধা যে‌ন জনগ‌ণের কা‌ছে যথাযথভা‌বে পৌঁছায় সেজন্য যথাযথ তদারকির মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা না করলে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের চেয়েও ভয়াবহ মন্বন্তর হবে। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ( খ্রি. ১৭৭০) এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল বলে 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় অর্ধেক মানুষ মরে গিয়েছিল। আর গত শতাব্দী তেতাল্লিশের মন্বন্তরে সরকারি হিসাবেই প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল।

সুতরাং দেশের মানুষকে অনুরোধ করবো দেশকে যেন অরাজকতা থেকে বাঁচিয়ে রাখে। রাষ্ট্রকে অনুরোধ করবো নাজুক সময়ে দায়িত্বশীল হয়ে সব কাজ করতে হবে। এটাও সরকারকে সচেতনতার সঙ্গে মনে রাখতে হবে। ওবায়দুল কাদের এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে অনুরোধ করবো অহেতুক, অনাবশ্যক কথাবার্তা থেকে যেন বিরত থাকেন। দুর্দিনে যেন দেশে বিতর্ক সৃষ্টি না করেন। আর প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, একক দায়িত্বে সবকিছু সরকার ও সরকারি দলের কাঁধে রাখা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। সংসদে যেসব দলের প্রতিনিধিত্ব আছে, সবাইকে নিয়ে জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় একটা ঐক্যবদ্ধ প্রক্রিয়াও আরম্ভ করা দরকার। সেই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মনোযোগী হলে জাতি উপকৃত হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com