বাংলাদেশের সর্বত্র করোনাভাইরাস ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ার খবর আমরা মিডিয়ার বরাতে নিয়মিত পাচ্ছি। এবং যেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে, সেখানেই লকডাউন বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজারেও একজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী অর্থাৎ কভিড-১৯ পজিটিভ রোগী পাওয়া যাওয়ার সাথে সাথে গত ৮ এপ্রিল থেকে পুরো কক্সবাজার লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। কক্সবাজারের এ লকডাউনের সাথে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো কীভাবে সম্পৃক্ত এ ব্যাপারে পত্রিকান্তরে কক্সবাজারে অবস্থিত এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার (আরআরআরসি) জানান, “বুধবার (৮এপ্রিল) থেকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক পুরো কক্সবাজার লকডাউন করেছেন। ফলে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোও এ লকডাউনের আওতায় পড়বে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বাইর থেকে যাতে কোন মানুষ ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি রয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি আগের মতো নাই। ক্যাম্পগুলোতে শুধু ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু আছে” (বাংলা ট্রিবিউন, ৮ এপ্রিল, ২০২০)। কিন্তু প্রকৃত চিত্র আদতে অন্যরকম।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সংখ্যা ৩৪টি। গত ৮ এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো জেলা লকডাউনের আওতায় এলেও প্রকৃতপক্ষে ক্যাম্পগুলোতে অঘোষিত লকডাউন শুরু হয় ১১ মার্চ থেকে। কেননা, অতি জরুরি সার্ভিস ছাড়া গত ১১ মার্চ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। ফলে, ১১ মার্চ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বাইরের জগৎ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় প্রচারিত বিধিনিষেধ বিবেচনায় এটা প্রকারান্তরে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলা যায়। কেননা, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, যদি কোনোভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তাহলে সেখানে একটা অকল্পনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, যা সামাল দেওয়া রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়বে। এটার প্রধান কারণ হচ্ছে, ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের বসবাসের ধরন, আবাসন কাঠামো, পারস্পরিক সংযোগের ব্যাপকতা, অস্বাস্থ্যকার পরিবেশ, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং ভাইরাস সম্পর্কিত অজ্ঞতা ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার’ বিষয়টি রীতিমত অসম্ভব করে তুলবে। ওয়ার্ল্ড ভিশনের কক্সবাজারের সিনিয়র ডিরেক্টর রাচেল উফ সম্প্রতি জাপান টাইমসকে দেওয়া এক মন্তব্যে বলেছেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো যেভাবে তৈরি, সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা রীতিমত অসম্ভব”। ফলে, কোনোভাবে একবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনাভাইরাস প্রবেশ করলে, সেখানে যে এক অভাবনীয়, অবর্ণনীয় এবং করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন অর্গানের লোকজন মাইকিং করে করোনা সতর্কতামূলক কিছু প্রচারণা চালালেও এটি অত্যন্ত আতঙ্কের বিষয় যে, একটা বড় অংশের রোহিঙ্গার মধ্যে করোনাভাইরাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত এবং স্বচ্ছ কোনও ধারণা নাই। এবং এর অন্যতম একটি প্রধান কারণ হচ্ছে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে ক্যাম্পগুলোতে কোনও ধরনের টেলিযোগাযোগ এবং ইন্টারনেট সংযোগ না-থাকা। কেননা, ২০১৯ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ বালুখালী ক্যাম্পে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তন্মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে হাজার হাজার সিমকার্ড জব্দ করা, সিম কার্ড নিষিদ্ধ করা এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মোবাইল সার্ভিস এবং ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া। ফলে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে করোনা ভাইরাস নিয়ে নানান সচেতনতামূলক প্রচারণার কোনও তথ্য যথাযথভাবে পৌঁছাচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে মাইকিং করে এবং ব্যারিকেড দিয়ে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখা, হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক পরা এবং হাতে গ্লাভস পরার কথা বলা হলেও বেশিরভাগ রোহিঙ্গার মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত পর্যাপ্ত কোনও সতর্কতা লক্ষ করা যায় না। ফলে, এরইমধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেওয়ায় ঘুনধুমের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে ৩০ জন রোহিঙ্গাকে। এছাড়াও দুই মাস সাগরে ঘুরে গত ১৬ এপ্রিল প্রায় ৩৯৬ জন রোহিঙ্গা পরে থাইল্যান্ড ও পরে মালয়েশিয়া থেকে পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসে, যাদের সবাইকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। এরাও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর করোনাভাইরাস ছড়ানোর একটা বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া, শতাধিক পরিবার বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে’ অপেক্ষা করছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা সাফ ইঙ্গিত দেয় যে রোহিঙ্গারা এখনও সুযোগ পেলে ফাঁকফোকর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, যা ক্যাম্পগুলোতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিকে ত্বরান্বিত করবে। তাছাড়া, একটা সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় সুনির্দিষ্ট টার্গেট নিয়ে নিয়ে যথাযথ প্রচরণার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মধ্যে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত কোনও সচেতনতা কাজ সেভাবে করা হচ্ছে না। ফলে, একটা ব্যাপক সংখ্যক রোহিঙ্গা করোনাভাইরাস নিয়ে কোনও ধারণাই রাখে না। আমি জানতে পেরেছি, মাঝি (বিভিন্ন ব্লকের প্রধান) লেভেলে কিছু তথ্য প্রচার করা হচ্ছে কিন্তু সেটা একেবারেই অসংগঠিত এবং খুবই নগণ্য। তাছাড়া কিছু সিভিল সোসাইটি গ্রুপ সীমিত আকারে করোনাভাইরাসে করণীয় বিষয়ে কিছু প্রচারণা চালাচ্ছে। এছাড়াও তরুণ রোহিঙ্গাদের একটা সংগঠন, রোহিঙ্গা ইয়ুথ ফর লিগ্যাল অ্যাকশন, করোনাভাইরাস সম্পর্কিত কিছু সতর্কতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। করোনাভাইরাসের যে ভয়াবহতা এবং এর যে বৈশ্বিক তীব্রতা তা উপলব্ধির জন্য ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গার একটা বড় অংশের মধ্যে এসব সচেতনতামূলক কার্যক্রম সত্যিকার অর্থে ন্যূনতম সচেতনতাও তৈরি করতে পারছে এটা দাবি করা যাবে না।
আমি আরও জানতে পেরেছি, এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গারও কভিড-১৯ পরীক্ষা হয়নি, যদিও অনেক রোহিঙ্গা বিভিন্ন ক্যাম্পে নানান ধরনের সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। যদিও সর্দি, কাশি আর শ্বাসকষ্ট হলেই তাকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বলা যাবে না, কিন্তু পরীক্ষা না-করলে শনাক্ত হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই তো নেই। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার হ্রাস করার জন্য প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ব্যাপক ভিত্তিতে পরীক্ষা বা টেস্টের ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। আমেরিকা এ পরীক্ষা করতে দেরি করার কারণে আজকে তার মাশুল দিচ্ছে। আরও আশঙ্কার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী সেইভ দ্য চিলেড্রেনের মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটা ভেন্টিলেটরেরও ব্যবস্থা নেই। যেকোনও জরুরি প্রয়োজনে, যদি কোনও রোহিঙ্গা কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তার চিকিৎসা করার কোনও ব্যবস্থা সেখানে নে্ই। নেই কোনও প্রয়োজনীয় এবং প্রশিক্ষিত লোকবল। মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যমতে, পুরো বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটগুলোতে সব মিলিয়ে ১১৬৯টি বেড আছে, যার বেশিরভাগ বড় বড় শহরগুলোতে। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে সেভ দ্য চিলড্রেনের রোহিঙ্গা রেসপন্স এডভাইসরি ম্যানেজার এথনা রেইবার্ন বলেছেন, ‘ইন্টেনসিভ কেয়ার ফ্যাসিলিটির অভাবে [ক্যাম্পে বসবাসকারী ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর যদি একজনও আক্রান্ত হয়], তাকে ৯০ মাইল দূরে চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে হবে, যা জীবন ঝুঁকির (লাইভ-রিস্ক) সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।”
যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথ্য দিচ্ছে যে, ১০০ শয্যার একটা আইসোলেশন ওয়ার্ড ক্যাম্পের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে এবং ২০০ শয্যার একটা হাসপাতাল তৈরির কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ইউএনএইচসিআরও আশা দিচ্ছে যে, আইওএম, ইউনিসেফ এবং সেইভ দ্য চিলড্রেনের সহায়তায় ১৭০০ শয্যার আরও একটি আধুনিক হাসপাতাল ক্যাম্পের বাইরে করার পরিকল্পনা হচ্ছে। এছাড়াও সেইভ দ্য চিলড্রেন ১৬০ বেডের এবং ১৬০ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে Severe Acute Respiratory Infection (SARI) সেন্টার স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। আমরা এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গত তিন মাস ধরে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা আমাদের নানান পরিসংখ্যানের ভেতর দিয়ে জানান দিচ্ছে। অথচ রোহিঙ্গাদের জন্য এখন পর্যন্ত প্রায় সকল আয়োজন ‘প্রস্তুতির পর্যায়ে’ এবং ‘ঘোষণার পর্যাযে’ আছে, যা ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। সেখানে রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে একটা বড় অংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। বৃদ্ধদের মধ্যে একটা বড় অংশ নানান রকমের বার্ধক্যজনিত রোগে কষ্ট পাচ্ছে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম একটি উপায় যেখানে বলা হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সাধারণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবস্থা অত্যন্ত সাধারণ মানের বা সাধারণের চেয়ে নিম্নমানের। এরকম একটি অবস্থায় রোহিঙ্গারা করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে বললে অত্যুক্তি হয় না।
পরিশেষে বলবো, ত্রয়োদশ শতকের ডেনিশ দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্ড অস্তিত্ববাদী দর্শনের মূল কথাটা সামনে আনেন এভাবে যে, “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” অর্থাৎ আগে নিজের চিন্তা করো তারপর অন্যের ধান্দা! যদি আপনার গায়ে একটা তীর এসে লাগে, আপনি কে তীরটা আপনার গায়ে ছুড়ে মারলো সেটার খোঁজ নেওয়ার আগে আপনার শরীর থেকে তীরটা বের করবেন, এটাই অস্তিত্ববাদী দর্শনের মূল কথা। নিজের অস্তিত্ব থাকলেই তো অন্যের অস্তিত্বের খবর নেবেন। এটাই মানব প্রকৃতি বা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সুতরাং করোনাভাইরাসের প্রবল আতঙ্কের সময়ে আমাদের সকলের নিজের জীবন নিয়ে যেখানে টানাটানি, সেখানে ‘মরার’ রোহিঙ্গাদের খবর নেওয়ার সময় কই! কিন্তু মানব চরিত্রেরই আরেকটা দিক হচ্ছে, মানবতা, সহমর্মিতা, এবং অন্যের মঙ্গলচিন্তা। নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যের জীবন রক্ষা করা মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আমাদের সমাজে এরকম অসংখ্য নজির আছে। তাই তো, নিজের অস্তিত্বের চিন্তার পাশাপাশি পাড়া-প্রতিবেশীর জীবন নিয়েও আমরা দুশ্চিন্তায় থাকি। তাই, করোনাভাইরাসের এ সর্বগ্রাসী এবং ভয়াবহ আকালে নিজেদের জীবন রক্ষার সমস্ত আয়োজনের পাশাপাশি আমরা যেন ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দিকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে নজর রাখি। শরণার্থী হলেও রোহিঙ্গারা মানুষ। আমাদের সকলের মনে রাখা জরুরি যে, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’!
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।