করোনাকালে স্বাভাবিক মৃত্যু কি অপরাধ!

আনিস আলমগীর২৭ এপ্রিল ২০২০, তৃতীয় রোজার সেহরি খেয়ে শুয়ে পড়েছি, এমন সময় মেসেঞ্জারে ছোট বোনের ফোন। নিকটজনদের অসময়ে ফোন সবসময় খারাপ খবর নিয়ে আসে। বললো, আরা আপা আর নেই। মানে ঢাকার সেন্ট্রাল রোড নিবাসী আমার বড় বোনদের একজন আঞ্জুমান আরা (৬২) আর নেই।
গত দুই-তিন দিন তার শরীরটা আগের চেয়ে ভালো যাচ্ছিল না, জানতাম। কিন্তু এমন খবর প্রত্যাশা করিনি। বললাম বাসায় কে আছে? জানালো কাজের মেয়ে ফোন করে খবর দিয়েছে। আরেকটু আলো হলে সে গ্রিন রোড থেকে আপার বাসায় যাবে। আমার বোনের বড় মেয়েকে জানানো হয়েছে, সে লেকসার্কাসের বাসা থেকে আপার বাসায় রওনা হচ্ছে। ছোট মেয়েকেও জানানো হয়েছে, সে থাকে মিরপুর।
সেন্ট্রাল রোডের বাসায় আপা একাই থাকতেন। তার পাঁচ ছেলেমেয়ের বাকি দুই ছেলে, এক মেয়ে কানাডার তিন শহরে তিন জন সংসার পেতেছে। গত নভেম্বরে আপার বড় ধরনের স্ট্রোক হয়। ডায়াবেটিস, প্রেসারের সঙ্গে জটিল সমস্যা ছিল কিডনি নিয়ে। ১৬ দিন হাসপাতালে ভর্তির বেশিরভাগ ছিলেন আইসিইউতে। তখন আত্মীয়-স্বজন সবাই উদ্বিগ্ন ছিলাম। ছোট ছেলে কানাডা থেকে এসে প্রায় দুই মাস থেকে গেছে। সহযোগিতা নিয়ে মোটামুটি চলছিল তার, কিন্তু ক’দিন বাঁচবেন এমন একটা শঙ্কা ছিল।

২৩ এপ্রিল সর্বশেষ কিডনি ডায়ালাইসিস করিয়েছেন। ২৭ তারিখও ডায়ালাইসিস করাতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার কর্মসূচি ছিল। সেখানে চার মাস ধরে সপ্তায় দুইবার ডায়ালাইসিস করাচ্ছিলেন। সকালে আমার বড় ভাগ্নি, বিকেলে আমার ছোট বোন কথা বলে এসেছে তার সঙ্গে। সপ্তাহখানেক আগে চোখের সমস্যার কথা বলছিলেন আমাকে। এক হাসপাতালে দেখানোর চিন্তাও ছিল, কিন্তু আমার আরেক বোন সেখানে অপারেশন করে ভালো ফল পাননি বলে তিনি নেতিবাচক মত দিলেন। লকডাউন শেষে অন্য কোথাও দেখানোর অপেক্ষায় ছিলাম।

আমি খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আপার বাসায় পৌঁছে দেখি আমার ছোট বোন, দুই ভাগ্নি উপস্থিত। ছোট জামাইটাও এসেছে। সবার ছেলেমেয়েরাও আছে। আমার দুলাভাইয়ের ভাগ্নেরা আছে। দুলাভাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বায়োকেমিস্ট ছিলেন। সেই সুবাদে তারা দীর্ঘদিন আজিমপুর কলোনিতে ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, আতিথেয়তা, চারপাশের মানুষদের আপন করে থাকতে ভালোবাসতেন আপা-দুলাভাই। আমার প্রবাসী ভাগ্নেদের দু’তিনজন বন্ধুও এসেছে, যারা আজিমপুর কলোনিতে থাকতো। আর কয়েকজন বাসায় না এসে গিয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে কবরের বন্দোবস্ত করতে। সমানে ঢাকা-কানাডা ফোনে কথা বলছে ওরা দাফন-কাফন নিয়ে। ঢাকার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে খবর পৌঁছে গেছে। চারদিক থেকে ফোন আসছে।

কীভাবে কী করবো চিন্তা করছিলাম। প্রথম চিন্তা লাশ গোসল করানো এবং কবরস্থানে নেওয়া। বিল্ডিংয়ে গোসল করানো সম্ভব না। কারণ, অন্তত একজন প্রফেশনাল লোক দরকার। এরমধ্যে অ্যাপার্টমেন্টের গেট থেকে জানানো হলো নিউমার্কেট থানা থেকে পুলিশ এসেছে। নিচে ডাকছে। তখন সকাল ৭টা পার হয়েছে মাত্র। এই অ্যাপার্টমেন্ট অনেক বড়, অনেক ফ্ল্যাট, অনেক বাসিন্দা। এটিসহ আশপাশের চার বাড়ি লেখক কবীর চৌধুরীদের পৈতৃক সম্পত্তি। মরহুম চৌধুরীও এই অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। পুলিশ জানিয়েছে, অ্যাপার্টমেন্টের কেউ করোনার রোগী সন্দেহে ট্রিপল নাইনে ফোন করেছে। এখন যারাই মারা যাচ্ছে করোনা রোগী সন্দেহে সর্বত্র আতঙ্ক। সে কারণে হয়তো এই অ্যাপার্টমেন্টের কাউকে সমবেদনা জানাতে বাসার আশেপাশে আসতে দেখলাম না। বরং অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তার মুদি দোকানদার, মাংসের দোকানদার একে অন্যের সঙ্গে আপার কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখলাম। সবাই তাকে খালাম্মা ডাকতো।

থানা থেকে আসা সেই পুলিশকে পরিচয় দিয়ে বললাম, তিনি করোনা রোগী না, কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন অনেক দিন। আর করোনা হলেও লুকানোর কী আছে! আপনারা পরীক্ষা করতে নিয়ে যেতে চাইলে ব্যবস্থা করেন। আমরাও অ্যাম্বুলেন্স ডেকে দিতে পারি। পুলিশ বললেন, তারা এটা করেন না। আমাকে ট্রিপল থ্রিতে ফোন দিতে পরামর্শ দিলেন। আরও বললেন, কবরস্থানে নেওয়ার আগে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যেতে, সেখানে নাকি নাক থেকে নমুনা সংগ্রহ করবে পরীক্ষক দল। এই বলে চলে গেলেন। আমি ট্রিপল থ্রিতে এমন কোনও সেবার অপশন পেলাম না।

এদিকে কবরস্থানে যারা গেলো তারা জানালো, সেখানে গোসল, জানাজার ব্যবস্থা আছে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এলাকার কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র ছাড়া কর্তৃপক্ষ লাশ কবরস্থানে ঢুকতে দেবে না। কিংবা ডাক্তার থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিতে হবে করোনা রোগী না এই মর্মে। ফোনে কবরস্থানের ইনচার্জের সঙ্গেও কথা হলো আমার। তিনিও একই কথা জানালেন।

একে তো রোজার সকালের পর করোনার লকডাউন। এই ভোরে কাউন্সিলরের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা অসম্ভব। আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কতক্ষণ…। ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য গণস্বাস্থ্যে যোগাযোগ করা হলে ওরা দিতে পারবে না বলেছে। গণস্বাস্থ্যে যোগাযোগ করা হয়েছে, কারণ তিনি সর্বশেষ তাদের হাসপাতালে কিডনির ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন। কিন্তু রোগী তো তাদের হাসপাতালে মারা যায়নি, তারা কেন দেবে! লাশ নিয়ে গেলে দেবে কিনা—জানতে চাইলে সেটাও সম্ভব না বলেছে। তাদের যুক্তি অমূলক মনে হচ্ছিল না আমার।

কাউন্সিলরের সার্টিফিকেট কীভাবে পাবো সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে আমি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকতার সঙ্গে কথা বলি, যিনি পেশাগত সূত্রে পূর্ব পরিচিত। ভিন্নধর্মী হওয়ার কারণে তার সেহরি পরবর্তী ঘুমের সমস্যা থাকার কথা না, হয়তো সকাল সকাল উঠতে পারে এটা আশা করেছি। প্রথমবার রেসপন্স নেই। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিলে ধরলো, কিন্তু মনে হলো এখনও বিছানায়। দুঃখ প্রকাশ করে ঘটনা জানালাম এবং এলাকাটি কোন ওয়ার্ডের অধীন তাও জানি না বললাম। এরমধ্যে আমাদের কয়েকদফা ফোন, মেসেজ বিনিময়, স্থানীয় দোকানদারদের সহায়তায় পরিষ্কার হলো এটি ওয়ার্ড নম্বর ১৮। কাউন্সিলরের নাম, ফোন নম্বরও পেলাম। কাউন্সিলরের অফিস নিউমার্কেট এলাকায়।

সকাল তখন আটটা পেরিয়ে গেছে। এরমধ্যে জানা গেলো কাউন্সিলর অফিসের যে ব্যক্তি সার্টিফিকেট দেন তিনি আপার অ্যাপার্টমেন্টের এক বাড়ি পরের বিল্ডিংয়ে থাকেন। আপাদের অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজার, আমাদের দুজন লোক, সামনের মুদি দোকানদার গেলেন তার সঙ্গে কথা বলতে। কেউ দরজা খোলে না। কিছুক্ষণ পর তারা আবার গেলো, অনেকক্ষণ পর তিনি খুললেন এবং তাদের জানালেন বাসায় তো আর সিল-প্যাড নেই। অফিসে যেতে হবে ১০টার পর। এলিফ্যান্ট রোডে কাউন্সিলরের বাসার নিচে অস্থায়ী অফিসে বসেন তারা। এরমধ্যে আমি কাউন্সিলরকে ফোন করলাম। দ্বিতীয়বারে তিনি ধরলেন এবং পরিচয় দিয়ে এই সকালে ফোন করার জন্য মাফ চেয়ে আমাদের সমস্যাটা বললাম। বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন ডাক্তার থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিতে। আমি যখন তার স্টাফের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে জানালাম তখন বললেন, তাকে বলেন লাশ দেখে আসতে, করোনার রোগী হলেতো সার্টিফিকেট আমরা দিতে পারবো না।

এরমধ্যে বিকল্প খুঁজছিলাম। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাকরাইল শাখা জানালো তারা এখন গোসলের কাজ করাচ্ছে না। মারকাজুল নামের প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা-ফোন নম্বর দিলো। মারকাজুল মোহাম্মদপুর শাখা বললো তারা গোসলের ব্যবস্থা করে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখে। করোনা নেই এমন সার্টিফিকেট ছাড়া গোসল দেওয়া সম্ভব না। ধানমন্ডির তাকাওয়া মসজিদে মৃত নারীদের গোসলের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমি ভরসা পেলাম না এই সময়ে সেখানে নেওয়ার। তাছাড়া আগে যোগাযোগ করে যাওয়ারও উপায় নেই।

বসতে বসতে ১০টা বেজে গেলে আমি কাউন্সিলর অফিসের কর্মকর্তার বাসায় যাই। সাড়া না পেয়ে চলে আসি। ফোন নম্বর ছিল। ফোন দিলে ধরেন না। কিছুক্ষণ পরে আবার গেলাম, এবার বেল বাজানোর পাশাপাশি দরজায় নক করে ডাকাডাকি করলাম। তিনি দরজা খোলার পর সব কথা খুলে বললাম। কাউন্সিলর তাকে লাশ দেখে যেতে বলেছেন তাও জানালাম। আর বিনীত অনুরোধ করলাম যে, সার্টিফিকেট না হলে আমরা লাশটি ধোয়ারও ব্যবস্থা করতে পারছি না, অথচ সাতটা থেকে অ্যাম্বুলেন্স এসে অপেক্ষা করছে। তিনি জানালেন একটু পরে বের হবেন, আমরা যেন অফিসে গিয়ে বসি। আমি জানালাম, আমি নিচে অপেক্ষা করছি, তাকে ফলো করে যাবো।

আধাঘণ্টার মধ্যে তিনি এলেন। তার রিকশাকে ফলো করে ইস্টার্ন মল্লিকার উল্টো দিকে একটু সামনে গিয়ে আমরা নামলাম। এবার সমস্যা অফিসের সহকারীরা আসেনি এখনও। অফিস খোলার জন্য অপেক্ষা করছি আমরা দু’জন। অপেক্ষার সময় এমনিতে দীর্ঘ হয়, কিন্তু ২৪ ঘণ্টা ঘুমহীন থাকা, বাসার বাইরে সেই ৮টা থেকেই দাঁড়িয়ে থাকা, ঢাকায় ৩৫ বছর জীবনে সুখে-দুঃখের সবচেয়ে বেশি কাছে পাওয়া বোনের মৃত্যুশোক, দাফন সুসম্পন্ন করার চিন্তা, সবকিছু আমাকে হতাশ করে তোলে। কিছু লোক ত্রাণের জন্য ভিড় করছে বাইরে। এরমধ্যে কাউন্সিলরের সঙ্গে কর্মকর্তার ফোনে কথা হচ্ছে। বুঝলাম তিনি তার অফিসারকে জেরা করছেন, কেন তিনি প্রত্যয়নপত্র দেবেন। অফিসার বুঝাতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে তিনি মৃতের চিকিৎসার সব কাগজপত্র দেখেছেন, আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। এই এলাকার বাসিন্দা হিসেবে আপার জাতীয় পরিচয়পত্র আছে।

কাউন্সিলর কিছুক্ষণ পর ওপর থেকে নামলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে আমার ডাক পড়লো তার অফিসে। তিনিও কাগজপত্র দেখলেন, আর আমাকে জেরা করলেন, তার সহকর্মীকে বারবার অভিযুক্ত করছেন করোনা রোগী কিনা জানতে তিনি কেন বাসায় দেখে এলেন না। আর বেচারা বারবার বলছেন, আমি কীভাবে বুঝবো যে করোনা রোগী। আশেপাশের লোকেরা তো বলছে ওনার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। রোগী হিসেবে তাকে তারা দেখেছেন।

কাউন্সিলর আমার সঙ্গে অনেক কর্কশ ভাষায় কথা বললেন, জ্ঞান দিলেন লাশ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডেথ সার্টিফিকেট নেওয়া যায়। অফিসারকে ডিকটেশন দিয়ে লেখালেন। তার ভুল বাক্য সংশোধন করতে গেলে উল্টো আমাকে বললেন, আপনি ডিকটেশন দিচ্ছেন কেন, আমরা এগুলো লিখতে লিখতে…। শুরু করলেন আমার বয়ান শুনে আমার বোনের জন্য তিনি প্রত্যয়নপত্র দিচ্ছেন। শেষ করলেন, করোনা রোগী কিনা তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি বলে। আমার চোখের দিকে তাকালেন, তিনি বোধহয় আশা করেছিলেন আমি এই লাইন নিয়ে আপত্তি করবো। আমি তাকে হতাশ করে বললাম ঠিকই আছে। আপনি তো ডাক্তার না, পরীক্ষা না করে কীভাবে বলবেন! আর মৃত ব্যক্তির করোনা ছিল কী নেই আমার এই সার্টিফিকেট দরকার নেই। তিনি মৃত—এই সার্টিফিকেট দরকার আমার দাফনের জন্য। তিনি আপার চিকিৎসার কাগজপত্র ফটোকপি করে রাখলেন। আসতে আসতে ভাবছিলাম যেখানে তারা তাদের ভোটারদের মৃত্যুতে পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাবেন, সেখানে দিচ্ছেন লাঞ্ছনা। হয়তো নির্বাচিত হতে ওদের ভোটের দরকার হয়নি বলেই এই দাম্ভিকটা, অভদ্রতা এবং পাত্তা না দেওয়ার এই মানসিকতা অর্জিত হয়েছে। দেশে সব স্তরের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার চূড়ান্ত অধপতন দেখছি এখন।

কাউন্সিলর অফিস থেকে ফিরে শুনি, অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কল করে আবার পুলিশ ডাকা হয়েছিল। আমরা কেন করোনা রোগী কিনা পরীক্ষা করতে লাশ নিচ্ছি না। বাসা থেকে পুলিশকে বলা হয়েছে আমরা কাউন্সিলরের পত্র সংগ্রহ করতে পেরেশান। আপনাদের প্রয়োজন থাকলে লাশ নিয়ে পরীক্ষা করান। আমরা গাড়িও দিচ্ছি। অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম মালিকদের কমিটির সভাপতি কে? নাম জানিয়ে বলা হলো তিনি সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। আমি বললাম, বারবার পুলিশ কেন ডাকছেন তিনি! তিনি কি মরবেন না! অমরত্বের গ্যারান্টি পেয়েছেন! আর তোমরা জানো না তিনি কিসের রোগী। সবাই বললো, আমরা তো জানি। আমরা কী করবো!

যাক ঝামেলা ছাড়াই আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে গেলাম। সেখানে খুব সহযোগিতা করলো সবাই। ফর্মালিটিস পালন করে আপার গোসলের ব্যবস্থা করলাম। গোসল করানোর জন্য একজন নারী ছিলেন। আপা অনেক স্বাস্থ্যবান, একজনের পক্ষে গোসল করানো সম্ভব ছিল না। আমার দুই ভাগ্নি এবং ছোটবোনও গোসল করানোর কাজে অংশ নিলো। শেষে কবরস্থানে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করলাম। করোনাকালে আমরা উপস্থিত ১২/১৫ জন মিলে জানাজায় অংশ নিলাম। কবরস্থ করতে সহায়তা করলাম। একযুগ আগে আমার দুলাভাইকে যেখানে কবর দেওয়া হয়েছে সেই কবরেই আপাকে রেখে এলাম। মরতে তো সবাইকে হবে, কিন্তু রহমতের মাসে মৃত্যু ক’জনের কপালে জোটে! সারা জীবন তিনি চেয়েছেন বিছানায় পড়ে থেকে যেন কষ্ট না পান। আল্লাহ তা-ই শুনেছেন। কাউকে কষ্ট দেননি আপা। করোনাকালে তার মৃত্যুতে লাশ নিয়ে যত ঘঞ্জনা সইতে হলো—সব ভুলে গেলাম মনের এইটুকু সান্ত্বনাতে।

জানা গেছে, করোনাকালে যারা স্বাভাবিক মৃত্যু পাচ্ছেন শহর এলাকায়, তাদের স্বজনরা লাশ নিয়ে প্রতিদিন এমন নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আবার এদের যারা সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনে পুনরায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হতে পারেনি, কিন্তু মেয়াদ শেষ না হওয়ায় এখনও গদিতে আছেন, তারা কোনও প্রত্যয়নপত্রই দিচ্ছেন না। প্রত্যয়নপত্র পেতে লোকজন তদবির করছে মেয়র অফিসের লোকদের কাছে।

দিনশেষে মনে হচ্ছে, করোনাকাল আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভীতি এবং ক্ষেত্রবিশেষ মনুষ্যত্বহীন করে তুলেছে। রোগীকে ফেলে চলে যাচ্ছে আপন সন্তান, স্বজন। স্বাভাবিক মৃত্যুতেও লাশের মুখ দেখতে চাচ্ছে না প্রতিবেশী, আগের মতো মৃত ব্যক্তির বাড়িতে খাবার পাঠানোর প্রশ্ন তো আসেই না। স্বাভাবিক মৃতুকেও করে তুলছি ভীতিকর। যেন আমাদের কারও মৃত্যু হবে না। আর এখন মরে যাওয়াও একটি অপরাধ।
ক’দিন আগে ফেসবুকে সাংবাদিক এবং আইনজীবী আলী আসগর স্বপন ভাই তার একটি কবিতা পোস্ট করেছিলেন। ভীষণ মনে ধরেছিল কথাগুলো। ক’টি লাইন এরকম—‘মরার আর সময় পেলো না! শেষমেশ কিনা এই অবেলায়। যদি এই অবেলায় মরে যাই, বড়ই লজ্জা পাবো।’

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

anisalamgir@gmail.com