কবে আবার আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো, এমন এক ভাবনায় যখন আমরা প্রায় হতাশ তখনই এক আশার বাণী শোনা গেছে। সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (এসইউটিডি)-এর ডাটা ড্রিভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকরা আভাস দিয়েছেন আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে এই ভাইরাস পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে। তারা বলছেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশ থেকে আগামী ১৯ মে’র মধ্যে ৯৭ শতাংশ এবং ৩০ মে’র মধ্যে ৯৯ শতাংশ বিলীন হয়ে যাবে। গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২৯ মে’র মধ্যে বিশ্ব থেকে করোনাভাইরাস ৯৭ শতাংশ দূর হবে এবং পুরোপুরিভাবে বিলীন হবে এই বছরের ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে। গত রবিবার এসইউটিডি’র ডাটা ড্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাব নিজস্ব ওয়েবসাইটে ১৩১টি দেশের করোনাবিষয়ক এই তথ্য তুলে ধরে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশ্য কোনও সুখবর দিতে পারছে না। তারা বলছে, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ দীর্ঘায়িত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যা-ই বলুক এখন বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছে, সিঙ্গাপুরের রিপোর্ট যেন সত্যি হয়, যেন অভ্রান্ত হয় বিজ্ঞানীদের হিসাব। সারা পৃথিবীর মানুষই চাচ্ছে যেন করোনাভাইরাস দ্রুত বিদায় নেয়। এই ভাইরাস বিদায় একদিন নেবেই, কিন্তু কেমন হবে সেই করোনা উত্তর পৃথিবী, সেই ভাবনাও বেশ জোরালো হতে শুরু করেছে।
বেশি আলোচনা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই। এরই মধ্যে আমাদের অনেকের আলোচনায়, লেখায়, বিশ্লেষণে নানা কথা এসেছে বহুবার। বলা হচ্ছে, এই করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে সর্বনাশ ডেকে এনেছে কোটি কোটি মানুষের জীবনে, কত সহস্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে যেগুলো আর ফিরবে কিনা জানা নেই। কিন্তু কোনও কোনও ব্যবসার জন্য ইতিবাচকও হয়েছে এই করোনার আক্রমণ।
পৃথিবীতে মহামারি বারবারই মহামন্দা ডেকে এনেছে এবং বারবারই মানুষ বিজয়ী হয়েছে। তবে এর জন্য মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। আর সেজন্যই বাজার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি নিয়ে এক ধরনের মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা স্তরে। বলা হচ্ছে, বাজার থেকে যদি ছোট কোম্পানি বিদায় নেয়, তবে সেই জায়গা দখলে নেবে বড় কোম্পানিগুলো।
নিশ্চিত করেই সবাই বলছে, করোনাভাইরাসের আঘাতে পাল্টাবে চিত্র। বদলে যাবে মানুষের ক্রয় অভ্যাস আর ব্যবসার চরিত্র।
ভাইরাস কখনও পুরোপুরি যায় না, সংক্রমণও থামে না, কারণ পৃথিবীতে কোটি কোটি ভাইরাস ঘুরছে। অর্থনীতি যেহেতু চরম ক্ষতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তাই সরকার এবং বাণিজ্য জগতের নেতৃত্ব চাচ্ছে ধীরে ধীরে কাজ শুরু করতে। দেশের সামনে এখন দুটি জিজ্ঞাসা–কতদিন পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বা লকডাউন চালালে ভাইরাসে প্রাণহানি কম হবে, আর কতদিন পর্যন্ত লকডাউন চালালে অর্থনৈতিক ক্ষতি কম হবে? এই দুইয়ের মাঝে একটা জায়গায় আসতে হচ্ছে সরকারকে, ব্যবসা-বাণিজ্যের জগৎকে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, ভাইরাসের প্রকোপ অনেকদিন চললে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো চ্যালেঞ্জে পড়বে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে। ফোরাম বলছে, এই দেশগুলোর সমাজের ভেতরে যে দারিদ্র্য আছে, যে বৈষম্য আছে তা আরও বাড়বে এবং এমন বাস্তবতায় কৌশল কী হবে সেটা নিয়ে এখনই ভাবতে শুরু করতে হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এও বলছে, আইসোলেশন শুধু নয়, প্রয়োজন সহযোগিতারও।
সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে যে ত্রাণ তৎপরতা চলছে, তার প্রয়োজন চটজলদি শেষ হয়ে যাবে না। সেটি চালু রাখতে হবে, আবার উৎপাদনমুখী কাজও শুরু করতে হবে। গত ২৫ এপ্রিল ফেডারেশন চেম্বারের উদ্যোগে একটি সংলাপে প্রথম বলা হয় কারখানা খুলবে। বলা হয়েছে, প্রাণসংহারি ভাইরাস করোনায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে সীমিত আকারে পোশাক কারখানা চালু হবে। আপাতত ঢাকার বাইরের শ্রমিক আসতে পারবে না। তবে ধাপে ধাপে সব কারখানা খোলা হবে।
এই সিদ্ধান্তটা কতটা যৌক্তিক হয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, কিছুটা দিন অপেক্ষা করা প্রয়োজন ছিল। আর যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হলো, সেটি আমরা প্রথম দিন, অর্থাৎ ২৭ এপ্রিল থেকেই দেখলাম তার কোনও নজির নেই। দল বেঁধে, জটলা করে শ্রমিকরা ঢুকছে কারখানায় এবং দূর-দূরান্তের শ্রমিকরা চলেও আসছে ঢাকা, গাজীপুর আর নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে।
রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হোটেল রেস্তোরাঁর ইফতার বেচাও শুরু হয়েছে সরকারি নির্দেশে। ফলে বলতেই পারি, এই ভাইরাসকে আর পাত্তা দিচ্ছি না আমরা। ভাইরাস থেকে প্রাণ রক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেলে, একটা একটা করে ভাইরাসমুক্ত অঞ্চল ঘোষণা করে সেখানে খুব সতর্কতার সঙ্গে আর্থিক কর্মকাণ্ড চালু করা যেতো।
শিল্প বাণিজ্যের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা আর রোজগার শূন্য থাকতে চান না। ছাঁটাই করবেন না, বেতন ঠিকমতো দেবেন—এমনসব অনুরোধ তারা আর শুনতে রাজি হচ্ছেন না।
বাস্তবতা হলো, মন্দা চলছে এবং চলবে। এর হাত থেকে বাঁচতে কত ছোট-মাঝারি ব্যবসা বড় ব্যবসার কাছে বিকিয়ে যাবে তার কোনও হিসাব নেই। অনেকটা যেন সেই ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্বের মতো—বড় ব্যবসা পারবে, তার পৌষ মাস সবসময়ই, তা হোক সেটা মন্দা বা ভালো সময়। ছোট ব্যবসার জন্য এমন মন্দা, মহামারির চেয়ে সর্বনাশ আর কী হতে পারে?
লেখক: সাংবাদিক