সাকার পক্ষে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাবি করা যায় না

Golam Mortozaএদের কারও সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই। তাদের মুখে কথাগুলো বহু বছর ধরে শুনছি। বইয়ে পড়েছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জেনেছি। একই কথা বারবার শোনা-জানা-পড়ার পর প্রতিক্রিয়া একই রকম হয় কেন? চোখ কেন ভিজে যায় এখনও? শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের কথা বলছি। আজ যারা কথা বলছেন, একাত্তরে তারা প্রায় সবাই ছিলেন শিশু। পিতার স্নেহ বঞ্চিতভাবেই বেড়ে উঠেছেন। প্রতিবছর নিয়ম করে ১৪ ডিসেম্বর আসে। শহীদ সন্তানরা কাঁদেন, পুরো জাতিকে কাঁদান। একই কথা বারবার বলেন, শরীর শিউরে ওঠে।

তাদের কাছে ‘বিজয় দিবস’ আর আনন্দ-উদযাপনের থাকে না। এবারের ভিন্ন প্রেক্ষাপটের ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ এবং ‘বিজয় দিবস’ নিয়ে কিছু কথা।

১. এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ এবং বিজয় দিবস উদযাপন কেন ভিন্ন? ভিন্ন এই কারণে যে, যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল তারা ছিল চিহ্নিত। তাদের আমরা চিনতাম, জানতাম। তাদের আমরা চিনি, জানি। শহীদের স্ত্রী-সন্তানেরা তাদের চেনেন, জানেন। এই অপরাধী হত্যাকারীদের দেখা গেছে দাপটের সঙ্গে পদচারণা করতে। বিচার তো বহুদূরের কথা।

অপরাধী-হত্যাকারী কারও বিচার সম্পন্ন হয়েছে, কারও বিচার প্রক্রিয়া চলছে। শহীদের স্ত্রী-সন্তানরা তো বটেই দেশের খুব কম সংখ্যক মানুষই বিশ্বাস করেছেন যে, এই অপরাধীদের কোনওদিন বিচার হবে। সেই অবিশ্বাস্য কাজটি সম্পন্ন হয়েছে, হচ্ছে। সাধারণভাবে এটাই এবারের বুদ্ধিজীবী দিবস এবং বিজয় দিবসের ভিন্ন প্রেক্ষাপট, ভিন্ন তাৎপর্য।

২. কোন বাংলাদেশের জন্যে মানুষ যুদ্ধ করেছিল, আর কোন বাংলাদেশ মানুষ পেয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন ‘দৈনিক বাংলা’র প্রথম পাতায় ছবিসহ সংবাদ ছাপা হয়েছিল, ‘এই জল্লাদকে ধরিয়ে দিন’ ।  জল্লাদ কে? এই ‘জল্লাদ’ মাওলানা মান্নান। শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর হত্যাকারী।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। জল্লাদ মান্নানদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এরশাদ এই জল্লাদ মান্নানকে মন্ত্রী বানিয়েছে। কী দাপটেই না জল্লাদ মান্নান পতাকাওয়ালা গাড়িতে ঘুরেছে! মাদ্রাসার অর্থ আত্মসাৎ করে ‘ইনকিলাব’সহ আরও অনেক কিছুর মালিক হয়েছে। খালেদা জিয়া মানবতাবিরোধী অপরাধী নিজামী-মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়েছে। সাকা চৌধুরীর মতো কুখ্যাত মানবতাবিরোধী অপরাধীকে দলে আশ্রয় দিয়েছে, মন্ত্রীর পদমর্যাদা দিয়েছে এবং ওআইসির মহাসচিব প্রার্থী করেছে। সেই অপরাধীদের এখন বিচার করছেন শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সরকার।

৩. প্রসঙ্গ আনা হয়, আওয়ামী লীগও তো মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়েছে। আওয়ামী লীগেও তো মানবতাবিরোধী অপরাধী আছে। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগেও দু 'একজন  মানবতাবিরোধী অপরাধীকে আছে। এ কথা সত্য। এই দায় আওয়ামী লীগকে নিতে হয়, নিতে হবে। এ কথাও তো সত্য যে, আওয়ামী লীগ দলে থাকা সেই মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার করছে। সুতরাং ‘আওয়ামী লীগেও মানবতাবিরোধী অপরাধী আছে’- এ কথা বলে কি জাতীয় পার্টি, বিএনপির মন্ত্রী বানানোর কাজকে জায়েজ করা যায়? যায় না। আওয়ামী লীগেও মানবতাবিরোধী অপরাধী আছে বলতে মূলত বোঝানো হয়, শেখ হাসিনার মেয়ের শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসেনের পরিবারকে। ইতিহাস বলে, খন্দকার মোশারফের পিতা শান্তি কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। শান্তি কমিটির সদস্য থাকা কোনও ভালো কাজ নয়। কিন্তু শান্তি কমিটির সদস্য আর মানবতাবিরোধী অপরাধীও এক বিষয় নয়। এটা না বুঝেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘আওয়ামী লীগেও মানবতাবিরোধী অপরাধী আছে’- অভিযোগ করা হয়।

তার পিতা শান্তি কমিটির সদস্য হওয়ার কারণে খন্দকার মোশারফের সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু বিচার তো শান্তি কমিটির সদস্যদের হচ্ছে না। বিচার হচ্ছে, হত্যা-অগ্নিসংযোগ-ধর্ষণ-লুণ্ঠনকারীদের। এটা আওয়ামী লীগের পক্ষে সাফাই গাওয়া নয়, ইতিহাসের সত্য কথন।

৪. শেখ হাসিনার সমালোচনা, আওয়ামী লীগের সমালোচনা, আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা আর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কু-যুক্তি দিয়ে সমালোচনা- কোনওভাবেই এক বিষয় নয়। রাজনৈতিক দল বিএনপি তা পুরোপুরি ভুলে গেছে। সাকা চৌধুরী কত বড় মানবতাবিরোধী অপরাধী, তা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রাহমান জানতেন। জানেন বিএনপি নেতারাও। বিএনপি যখন আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে সাকার পক্ষে অবস্থান নেয়, তখন আর বলার সুযোগ থাকে না যে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের -অনেক মুক্তিযোদ্ধা দলে থাকা সত্ত্বেও।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অনেক সমালোচনা আছে। দুর্নীতি, গুম-খুন, বিচার না করা, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে বিনা ভোটের নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা... ইত্যাদি। এই সমালোচনা অবশ্যই হওয়া উচিত। বিএনপি সমালোচনা করবে, আন্দোলন করবে- তা নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। সরকার সমালোচনা সহ্য করে না, আন্দোলন-মিছিল-মিটিং করতে দেয় না, অকারণে গুলি করে, এসব অভিযোগও মিথ্যা নয়। এসবের বিরুদ্ধে বিএনপির অবস্থান থাকবে, সমালোচনা থাকবে। দেশের মানুষ যারা বিএনপি করে না, তারাও এসব ক্ষেত্রে সরকারের উপর ক্ষিপ্ত-বিরক্ত। বিএনপি সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে, সরকারের অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতি-হত্যা-গুমের সমালোচনা করতে গিয়ে, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। বিএনপির ভেতরে থাকা জামায়াতি মদদপুষ্টরা এ কাজ করেছে, করছে। তারা খালেদা জিয়াকে এভাবেই বুঝিয়েছেন অথবা খালেদা জিয়া জামায়াতের সংস্পর্শে থেকে এভাবেই বুঝেছেন।

৫. আওয়ামী লীগ পুরোপুরি বিশুব্ধ কোনও রাজনৈতিক দল নয়। তার অনেক দুর্বলতা আছে। ভিন্ন মত সহ্য না করার একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির সঙ্গেও আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে পড়ছে। সরকার দলীয়দের আচরণে দাম্ভিকতার প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ভয়াবহ অনিয়ম বৈধ করতে চাইছে। এসব কারণে তাদের জনসমর্থনের অবস্থা খুব বেশি রকমের খারাপ। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সমালোচনা, আন্দোলন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেই আন্দোলন করতে গিয়ে যদি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়ে যায়, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাঁচানো যদি আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে যায়, সেটা কোনওভাবেই মানা যায় না।

৫. রাজনৈতিক দল বিএনপির আন্দোলন দেখে মনে হয়, তাদের অবস্থান যতটা না সরকারের বিরুদ্ধে তার চেয়ে বেশি জামায়াতের পক্ষে। তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাঁচানোর প্রচেষ্টা। যারা একাত্তরে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, অপরাধ করেছিল, তারা জঘন্য অপরাধী। আইনে সেই অপরাধ প্রমাণ হয়েছে। ‘মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে লঘুদণ্ড দিন’- বলে নিজামীরা অপরাধ স্বীকারও করেছে। এই অপরাধীদের যারা পুনর্বাসন করেছে, এমপি, মন্ত্রী বানিয়েছে, এখনও অপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে- আইনের দৃষ্টিতে তারাও কিন্তু অপরাধী।

মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পুনর্বাসন করার দায় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী স্বৈরাচার এরশাদের এবং খালেদা জিয়ার। শেখ হাসিনাকেও কিছুটা দায় নিতে হবে জামায়াতের সঙ্গে কৌশলগত ঐক্যের কারণে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত রাষ্ট্রপতি প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে কুখ্যাত গোলাম আযমের কাছে পাঠানোর দায়ও তাকে নিতে হয়, হবে। ইতিহাস থেকে কখনও এ কথা মুছে দেওয়া যাবে না। জল্লাদ মান্নানের সন্তানের সঙ্গে শেখ হাসিনার সখ্যতাও মেনে নেওয়া যায় না। সাকাচৌ পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণেও শেখ হাসিনা সমালোচিত হয়েছেন। শেখ হাসিনা তার দায় মোচন করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করে। এই বিচারের পর কোনওভাবেই শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে, খালেদা জিয়া বা বিএনপির সঙ্গে এই ইস্যুতে তুলনা করা যাবে না। বিচার করার অসম্ভব সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে, শেখ হাসিনা এখন প্রশংসিত হচ্ছেন, ইতিহাস এই কারণে তাকে আরও বড়ভাবে মূল্যায়ন করবে। আবার নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস, আর্থিক দুর্নীতি প্রশ্রয়, সুশাসনের অভাব, দাম্ভিকতার কারণে সমালোচিতও হবেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রেক্ষাপটে, এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস অন্য যে কোনওবারের চেয়ে একটু অন্যরকম, রাজনৈতিক দল বিএনপি তা উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা নিয়ে, সাকার পক্ষে অবস্থান নিয়ে, নিজামীদের দায় বহন করে- আমরাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, এই দাবি করা যায় না। 

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।