জিনোম সিকোয়েন্সিং করে যে লাভগুলো হতে পারে তা যদি সহজভাবে বলি তা অনেকটা নিম্নরূপ: ১) রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং করে রোগ নির্ণয়কারী kit তৈরি সম্ভব, ২) প্রতিষেধক ড্রাগ ও ভ্যাকসিন তৈরি সম্ভব, ৩) জীবাণুর সেরোটাইপ (serotype ) করা সম্ভব, ৪) জীবাণুর উৎস সম্পর্কে তথ্য জানা সম্ভব, ৫) জিনোম অ্যাসোসিয়েশন স্টাডি করে ব্যক্তির জন্যে নির্দিষ্ট ওষুধ (customized medicine) দেওয়া সম্ভব, ৬) স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির জিনোম সিকোয়েন্সিং করে জানা সম্ভব কোন বয়সে তিনি কোনও কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন, জেনে নেওয়া যায় কোন জেনেটিক ভেরিয়েশনের কারণে কখন তার ক্যানসার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ সৃষ্টি হতে পারে। ওপরের কারণগুলো ছাড়াও আরও কারণ আছে যা সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং করে জানা সম্ভব। যখন জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয় তখন কিন্তু পুরো জিনোমকে একসঙ্গে সিকোয়েন্সিং করা হয় না। বরং জিনোমকে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে যে DNA খণ্ডগুলো হয় সেগুলোকে সিকোয়েন্সিং করে পরে তাদের সঠিকভাবে পর্যায়ক্রমে জোড়া দিয়ে গোটা সিকোয়েন্সটি পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে এই বিশাল বহরের তথ্য এনালাইসিস করার জন্য বায়োইনফরম্যাটিকসের সাহায্য নিয়ে নির্ভুলভাবে জোড়া লাগানোর কাজটি সম্পন্ন করা যায়।
ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করার কৌশলের এখন তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। প্রথম প্রজন্মে সিকোয়েন্সিং করা হতো Sanger ও Gilbert সিকোয়েন্সিং প্রণালীতে। ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে Pyrosequencing নামে দ্বিতীয় জেনারেশন সিকোয়েন্সিং শুরু হয় আর বর্তমান তৃতীয় প্রজন্মে Illumina (কোম্পানির দেওয়া বাণিজ্যিক নাম ), shotgun প্রভৃতি প্রণালীর সাহায্যে ডিএনএ/জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়ে থাকে। তবে নতুন নতুন আরও কার্যকর, স্বল্প সময় ও স্বল্প ব্যয়সাপেক্ষ অত্যাধুনিক সিকোয়েন্সিং মেথডস বাজারে আসার প্রহর গুনছে। আধুনিক এই জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রণালীগুলোকে বলা হয় Next Generation Sequencing (NGS) methods।
একটি সার্থক জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের পর সচরাচর সেই সিকোয়েন্সটিকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশের জন্যে সংগ্রহশালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৮ সাল থেকে GISAID (Global Initiative on sharing all influenza data) ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সিকোয়েন্স ডাটা সংরক্ষণ করা শুরু করে। এবং পরবর্তীতে তারা SARS-COV-2-এর সিকোয়েন্স ডাটাও সংরক্ষণ শুরু করেছে। এপ্রিল ০১, ২০২০ পর্যন্ত পৃথিবীতে ৩ হাজারের অধিক SARS-COV-2 -এর জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে এবং তা GISAID-এ জমা পড়েছে । ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোগীর নমুনা থেকে ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করেছে। ইদানীং বাংলাদেশও প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করার। তুলনামূলক জিনোম এনালাইসিস (comparative genome analysis) থেকে জানা যায় যে SARS-COV-2 , বিটা করোনা (Betacorona virus) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ভাইরাস। Rhinolopus গোত্রের বাদুড়ে এই ভাইরাসের বসবাস। তাছাড়া Palm Civet নামের ক্ষুদ্রকায় মাংসাশী প্রাণীতেও এর অস্তিত্ব বর্তমান। উল্লেখ্য, বাদুড় অনেক ধরনের বিটা করোনাভাইরাসের পোষক (Host) হিসেবে কাজ করে। এরমধ্যে RaTG13 ভাইরাস ও SARS-COV-2-এর মধ্যে জিনোম সিকোয়েন্সের ৯৬% মিল আছে । ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২০, আমরা জানতে পারি যে বনরুই (Pangolin)-তে এক ধরনের ভাইরাস আছে, যা SARS-CoV-2-এর জিনোম সিকোয়েন্সের অনেক কাছাকাছি। বনরুইতে পাওয়া ভাইরাসের ৯৯% মিল রয়েছে করোনাভাইরাসের ‘S -Protein’ কোডিং সিকোয়েন্সের সঙ্গে। এখানে উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের ক্রাউন গঠনের জন্যে এই স্পাইক বা S-প্রোটিনগুলো দায়ী। এই S- প্রোটিন দিয়ে করোনাভাইরাস মানুষের ACE 2 (Angiotensin Converting Enzyme-2) রিসেপ্টর (এক প্রকার ধারক)-এ সংযোজিত হয়ে এন্ডোসাইটোসিস (endocytosis) অথবা ব্যাপন (diffusion) প্রক্রিয়ায় মানব কোষে প্রবেশ করে। তাই বনরুইতে পাওয়া ভাইরাসটিও যে মানুষকে আক্রান্ত করতে পারবে তা বলা বাহুল্য। জিনোম সিকোয়েন্সিং তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা অনুমান করা যায় যে SARS-nCOV-2 ন্যূনতম দুটি ভাইরাসের সমন্বয়ে গঠিত একটি নতুন ভাইরাস । এই দুটি ভাইরাসের একটি RaTG13 বা তার নিকট গোত্রের কেউ, আরেকটি হচ্ছে বনরুইতে পাওয়া করোনাভাইরাস। এই প্রকারে সৃষ্ট SARS-nCOV-2 নতুন পোষকের (host) সন্ধানে মানুষকে বেছে নিয়েছে। তবে এটি বলা যায় যে এই প্রকারের ভাইরাস তৈরির সময় হয়তো সৃষ্টিকারী দুটি ভাইরাসই একসঙ্গে একটি পোষক (host)-এ সংক্রামিত হয়ে SARS-nCOV-2-এর জন্ম দিয়েছে। এরপরেও অন্তত দুটি প্রশ্ন রয়েই যায়: ১) এই পোষকটি কে, যাতে SARS-nCOV-2 জন্ম লাভ করেছিল, এটা কি বনরুই, বাদুড় না অন্য কেউ?, ২) এই ভাইরাল রিকম্বিনেশন প্রক্রিয়ার অনুঘটক ও নিয়ামকেরই বা কী পরিচয়?
লেখক: অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, গ্রাজুয়েট বায়োকেমিস্টস অ্যাসোসিয়েশন (GBA)।