করোনার ছোবলে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে বড় ক্ষতি হয়েছে, প্রবৃদ্ধি দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে, সে কথা সবাই জানি। এই বাস্তবতাকে মাথায় নিয়েই প্রথমে রফতানিকারক কারখানা, এরপর আরও কিছু জরুরি সেবা, এবং সবশেষ ঈদকে সামনে রেখে শপিং মল, দোকানপাট খুলে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সরকার। ঢাকাসহ সারা দেশে দোকানপাট খুলে গেছে গত ১০ মে থেকে। অনেক দোকান মালিক প্রথমদিকে কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও এখন ক্রেতার আগমন দেখে আর বন্ধ রাখতে পারেনি দোকানের সাটার। অফিস আদালত খোলেনি। তবে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো চলছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা বাড়ি থেকে অফিস করার পদ্ধতি মেনে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেলিভিশনের টকশো চলছে আলোচকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল সংযুক্তিতে। এই ধারায় সবশেষ যুক্ত হলো আদালত এবং একটা রায়ও এলো গতকাল।
কিন্তু এখনও খোলেনি গণপরিবহন। গণপরিবহন শ্রমিকদের দাবি দ্রুত খুলে দেওয়া হোক, কারণ তারা আর পারছেন না রোজগারবিহীন থাকতে। কিন্তু দাবির পরিপ্রেক্ষিতে খুলে দিলে কি পরিণতি হবে সেটা নিয়ে বড় ভাবনার প্রয়োজন। ইউরোপে, কানাডায় কিছু কিছু করে খুলছে, এমনকি ভারতেও ট্রেন সার্ভিস খুলে দেওয়া হয়েছে। খুলে দিলেও গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার যেসব কৌশল ও বাধ্যবাধকতা দেখছি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে, বাংলাদেশে তার বিন্দুমাত্র মানা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আমাদের শপিং মল, দোকানপাটে স্বাস্থ্যবিধি ও ক্রেতা-বিক্রেতার দূরত্ব মানার লক্ষণ নেই বললেই চলে। পোশাক কারখানার ভেতরে মোটামুটি বিধিসম্মত ব্যবস্থা থাকলেও, কারখানা ছুটির পর যে মিছিল দেখি তা ভয় ধরিয়ে দেয়।
এ কারণেই গণপরিবহন নিয়ে শঙ্কা অনেক। ছুটি শেষের পর অনেক বদলে যাবে মানুষের গণপরিবহন ব্যবহারের ধরন-ধারণ। ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে ছুটির পর গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করা নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। এটা এ কারণেই যে, মহামারির কারণে দৈহিক দূরত্বের যে স্বাস্থ্যবিধি বহুল প্রচারিত হচ্ছে, তাতে গাদাগাদি করে, একজন আরেকজনের ঘাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে, ট্রেনে বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে, টেম্পুতে পাঁচ জনের সিটে দশ জন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে মানুষ আবার চলাচল শুরু করবে, এটা ভাবলেই আমাকে অসুস্থ হয়ে যেতে হয়।
চীনসহ বেশ কিছু দেশে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে মানুষ আগের চেয়ে কম গণপরিবহন ব্যবহার করবে। হাঁটা এবং সাইকেল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে। ইউরোপ আমেরিকার যে ছবি পাচ্ছি, তাতে দেখছি, কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে বাস ও ট্রেনের ভেতর কোন সিটে বসা যাবে, কোনটিতে নয়। এসব পরিমাপ করা হয়েছে শারীরিক দূরত্ব কতটুকু হলে ড্রপলেটের ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকা যাবে সেটা পর্যবেক্ষণ করে। সংক্রমণের আশঙ্কায় ট্যাক্সি বা শেয়ার ট্যাক্সিতে উঠা কমবে সেই সব দেশে।
আমাদের সমস্যা হলো আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরও একটা জনবান্ধব ও বৈজ্ঞানিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের পরিবহন পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষকে কখনও গুরুত্ব দিয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে ঘিঞ্জি শহরে মানুষের জীবন। উন্নত দেশের মতো পরিবহনের ভিন্ন ভিন্ন পছন্দের সুযোগ সীমিত। আর সিট পরিকল্পনা করা তো দূরের কথা। সুযোগ থাকলেও সরকারি কর্তৃপক্ষ সেটা করবে না, করলে পরিবহন মাফিয়ারা সেটা মানবে না, আর না মানলে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। বাধ্য হয়েই দরিদ্র, নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তকে আগামী দিনেও দেখবো একে অন্যের ওপর ঝুলে গণপরিবহন ব্যবহার করছে।
সরকার মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-সহ কতকিছুর স্বপ্ন দেখালো, কাজও শুরু হয়েছিল। করোনার অভিঘাতে সেগুলো কবে সমাপ্ত হবে সে ধারণা আর করা সম্ভব হচ্ছে না। এই করোনাকালে বাড়ি থেকে অফিস করার যে পদ্ধতি শুরু হয়েছে তা মেনে চলুক সেসব অফিস, যাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব। এতে রাজপথে যাত্রীসংখ্যা কমবে, তাদের কর্মীরা সুস্থও থাকবে। আর যারা পারছেন না, তারা নিজের কথা ভাবুন, সাইকেল কিনুন যদি অফিস সাইকেল দূরত্বের কাছাকাছি হয়। মোটরসাইকেলও কিনতে পারেন অনেকে। নিজের পরিবহন নিজের মতো করে জীবাণুমুক্ত রাখা অনেক সহজ।
লেখক: সাংবাদিক