বিষয়টা কেমন যেন সব আধাআধি কাজ কারবার। সরকারের ভাবনার মধ্যে আছে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে হবে। কিন্তু সে আবার ভাবে জীবন বাঁচাতে হবে। তাই ছুটি বাড়ে। কিন্তু ছুটি বাড়িয়েও আবার তাকে জীবিকার কথা মাথায় এনে কত কী খুলে দেওয়া হয়। মানুষও বাঁচতে চায়, ছোঁয়াচে করোনা থেকে দূরে থাকতে চায়। কিন্তু বাণিজ্যের মালিকরা নিজেরা কর্মস্থল থেকে নক্ষত্র মাইল দূরে থেকে শ্রমিকদের নিয়ে টানাহেঁচড়া করে। যে মধ্যবিত্ত এত সোচ্চার জনস্বাস্থ্য নিয়ে, জনসচেতনতা নিয়ে, তাদেরই একটা অংশ আবার মার্কেটে আর দোকানে ছুটে যায় ঈদের কাপড় কিনতে। পুরোটাই একটা অর্ধ-বিশ্বাসের খেলা। ভাবনার জগতে একদিকে আছে করোনা থেকে দূরে রাখতে হবে, থাকতে হবে, আবার সেই মগজেই ভাবনা আসে, ‘আমাদের কিছু হবে না’।
নভেল করোনাভাইরাসের হানায় বিধ্বস্ত বিশ্বের এখনকার লড়াই হলো মানুষের জীবন বাঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো। করোনা সংকটকালে আমাদের তৃতীয় পর্যায়ের সাধারণ ছুটির সময় এসে দেখছি আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ, আগের চেয়ে পরীক্ষা কিছুটা বেশি হচ্ছে। আমরা ভাইরাসের পিক টাইম বা আসল উচ্চতর সময়ে পৌঁছেছি কিনা জানি না, তবে এরমধ্যেই এর প্রাদুর্ভাবে আর্থ-সামাজিক অবস্থা গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। এরমধ্যেই ভাবনা বাড়াচ্ছে চীন, আমেরিকা আর ইউরোপের গবেষকরা। তারা বলছেন মানুষ যেমন ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, এই ভাইরাসও ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং তখন পরিস্থিতি হবে আরও মারাত্মক।
স্প্যানিশ ফ্লু-কে স্মরণ করে গবেষকরা বলছেন, ১৯১৮ সালের সেই মহামারি চলেছিল ১৯২০ সাল পর্যন্ত। ভ্যাকসিন বা অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ কোনোটাই এখনও আমাদের হাতে আসেনি। যদি ছয় মাসও লাগে তাহলে পরিস্থিতি কোথায় যাবে তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবলে আমরা হয়তো এই অর্ধ-বিশ্বাসের জায়গায় এত হামাগুড়ি দিতাম না।
অর্ধ-বিশ্বাস অন্য জায়গায়ও আছে। যারা ঘরে আছেন নিশ্চিন্তে, তারা ফেরিঘাটের ছবি দেখে বেদনাহত হলেও, ভয়ে আতঙ্কিত হলেও এর চেয়ে বড় সত্যও যে আছে সেটা বড় করে দেখছেন না। এই ভিড় শুধু তাদের নয়, যারা সানন্দে আর আনন্দে গ্রামে ছুটছেন ঈদ করতে। টেলিভিশন সংবাদে দেখলাম, কোলে ছোট শিশুকে নিয়ে ফেরি থেকে ফেরত আসা নারী বলছে, ‘ঢাকায় আর পারছি না, ঘর ভাড়ার টাকা নাই, ঘরে বাজার নাই, গ্রামে গেলে জীবনটা তো বাঁচবে’। এটাই আমাদের অর্ধ-বিশ্বাস। আমরা সবাইকে ভাবছি ঈদের মানুষ।
আমরা ভাবছি এই মানুষগুলো কিছু মানছে না, পথে নেমে পড়ছে। এমন অসংখ্য উৎসবমুখর মানুষের মাঝে আছে অসংখ্য সব হারানো মানুষ, যাদের পথে নামা ছাড়া পথ নাই। শহুরে দরিদ্রের আছে অনিশ্চয়তা। আর শহুরে অনেক সরব মানুষ ভুগছে এখন লকডাউন সৃষ্ট একাকিত্বে। আমরা অনেকেই হিসেব করছি ছুটি শেষে দেখবো কত শত চাকরি হারাবে মানুষ, কত ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কত মানুষের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে, কত ব্যবসা যে আর খুলবেই না, সেই হিসেবটা করছি না। এই অর্ধ-ভাবনার কবল থেকে মুক্তি মিলবে কবে সেটাও করোনার মতোই অনিশ্চিত।
সরকার প্যাকেজ দিয়ে সহায়তা করছে ব্যবসা-বাণিজ্যকে। নগদ অর্থ দিচ্ছে হতদরিদ্রদের। চাল, ডাল আর তেলের ত্রাণতো আছেই। এসব নিয়ে আমরা অনেকেই উদ্বেলিত। মনে রাখা দরকার, সরকারের আয় আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া কর। কর দেওয়ার সময় বাড়ানো মানে কিন্তু আমরা করের দায় থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছি তা নয়। অর্থাৎ নিজের রোজগারের রাস্তায় কোনোভাবে বন্ধ করবে না সরকার। তাই আগামীতে আমাদের মাথার ওপর করের বোঝা কেমন হতে চলেছে সেটা ভেবে নিজেকে প্রস্তুত করাই হবে আসল কাজ।
একটা ভাইরাস আমাদের সবাইকে গত প্রায় তিন মাসে কেমন অসহায় একাকিত্বে ভরে দিয়েছে। একটা ভয়ংকর নিরাপত্তাহীনতা আজ গ্রাস করেছে ধনী দরিদ্র সব অংশের মানুষকে। একটা জিনিস সবার কাছে খুব পরিষ্কার, এই মারণ ভাইরাস সহজে যাওয়ার নয়। ভ্যাকসিন আসতে অনেক দেরি আছে। তাই ক্রমে ক্রমে আমাদের জীবনযাপনের ধারাকে, ভাবনার জগতকে অনেকটা বদলে ফেলতে হবে। কোনও স্তরেই কোনও আধাআধি সিদ্ধান্ত বা কোনও বিষয় নিয়েই অর্ধ-বিশ্বাস থাকলে পরিণতি হবে ভয়াবহ।
লেখক: সাংবাদিক