প্রতিটি সংক্রমণকারী রোগের জন্যে একটি Ro ও একটি HIT মান আছে। যেমন, হাম বা Measles-এর জন্যে Ro হলো ১২ -১৮ ও HIT মান হচ্ছে ৯২ -৯৫%। আবার পোলিও (Polio) ক্ষেত্রে এই মানগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ৫ -৭ ও ৮০-৮৬ %। কোভিড-১৯-এর জন্যে এই মান মোটামুটি গড় হিসেবে যথাক্রমে ৫.৭ ও ৮২%। এই মান থেকে এটা বলা বাহুল্য যে করোনার ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে গেলে আমাদের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ করোনা আক্রান্ত হতে হবে এবং সেটা আমাদের স্বাস্থ্য খাতের জন্যে বড় রকমের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবে। কারণ, এই বিশাল অংকের আক্রান্ত জনগণের জন্যে যেই সংখ্যক আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, ডাক্তার, টেকনোলজিস্ট দরকার তা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এই যখন করোনা নিয়ে আমাদের অবস্থা তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে তাহলে কি লকডাউন উঠিয়ে নেওয়া আমাদের পক্ষে ভুল করা হবে? প্রশ্নটি যত সহজে করা গেলো উত্তরটি কিন্তু ততই কঠিন। তবে এটা ঠিক যে লকডাউন এ ভাইরাসটির বিস্তৃতি কমে, তবে তাই বলে যতদিন অবধি একটি কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত না হচ্ছে ততদিন লকডাউন করে রাখাও সম্ভব নয়।
লকডাউনের মূলত উদ্দেশ্য থাকে দুটি । প্রথমত জনসাধারণের মধ্যে রোগের বিস্তার ধীরলয় করা ও দ্বিতীয়ত জনসাধারণের মধ্যে একটি জনগোষ্ঠী বা গুচ্ছ (cluster) আবিষ্কার করা যেখানে এই রোগের বিস্তার লকডাউনের মধ্যেই সংঘটিত হয়েছে। পরবর্তীতে এই আবিষ্কৃত ও আক্রান্ত জনগুচ্ছকে সহজেই একটি কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় আনা যাবে। এবং পরবর্তীতে যখন লকডাউন তুলে নেওয়া হবে তখন সেই জনগুচ্ছ থেকে চেইন ট্রান্সমিশন (chain Transmission) শনাক্ত করা সহজ হবে। তবে লকডাউন তুলে নেওয়ার ফলে যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হবে এবং তার জন্যে যে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাবে সে সম্পর্কে জনগণকে বুঝতে হবে। আতঙ্কিত হলে চলবে না। তবে এই কথা বলা বাহুল্য যে হার্ড ইমিউনিটি, লকডাউন অবস্থায় (ভ্যাকসিন ছাড়া) অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। ইদানীংকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে করোনাভাইরাস হয়তো দুনিয়া থেকে কোনোদিনই আর যাবে না এবং যেসব দেশে ভাইরাসটি এখনও ব্যাপকভাবে সঞ্চারনশীল সেখানে যদি লকডাউন তুলে নেওয়া হয় তাহলে দ্বিতীয়বার এই ভাইরাসের উত্থান ঘটবে (virus resurgence )। দ্বিতীয়বার ভাইরাসের উত্থান ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে লেবানন, আলজেরিয়া, জাপানের হক্কাইডোতে অবস্থিত কিছু দ্বীপে, এমনকি চীনের উহানেও। বাংলাদেশে আমরা কখন লকডাউন তুলে নেবো? বা কখন লকডাউন তুলে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত সময়? এক কথায় বলতে গেলে, আমাদের টেস্টের পরিমাণ বাড়িয়ে আমরা যখন জানতে পারবো যে ভাইরাসটি দুৰ্বল হয়ে পড়েছে তখনি লকডাউন তুলে নেওয়ার উত্তম সময়। তাছাড়া সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, নিয়মিত স্বাস্থ্য বিধিগুলো মেনে চলা আমাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে রপ্ত করতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে আমরা হয়তো আর কখনোই আমাদের হারানো দিনগুলোকে আগের মতো করে ফিরে পাবো না। তবে সবাই একসঙ্গ চেষ্টা করলে, ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করলে হয়তো বিরাট ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হবে।
তবে এরইমধ্যে যে দুটি ব্যাপার আমাদের মনে আশার সঞ্চার করেছে তার একটি হলো করোনার জিনোম সিকোয়েন্সিং বাংলাদেশে শুরু হয়েছে আর ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক সিকোয়েন্স জমা পড়েছে। এই জিনোম সিকোয়েন্স থেকেই জানা যাবে নানান প্রশ্নের উত্তর, যেমন: কোভিড-১৯-এর কোন প্রকারটি বাংলাদেশে ছড়িয়েছে, এটি কি একই প্রকারেরই ভাইরাস, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে শনাক্ত হয়েছে, না সামান্য পরিবর্তন হয়ে আমাদের দেশে এসেছে প্রভৃতি। জানা যাবে বিশ্বের কোন দেশের করোনাভাইরাসের সঙ্গে আমাদেরটির মিল আছে, আর মিল না থাকলে সেটা কতটুকু পরিবর্তিত (Mutated)। তবে সেই তথ্যগুলোর জন্যে আমাদের সর্বোচ্চ কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস অপেক্ষ করতে হতে পারে। এই তথ্যগুলো জানা হয়ে গেলে তখন ভাইরাসটির প্রতিকার ও প্রতিরোধ অপেক্ষাকৃত সহজতর হয়ে উঠবে। দ্রুততম সময়ে ওষুধ ও বাংলাদেশি করোনারভাইরাসটির জন্যে ভ্যাকসিন উৎপাদনের কথাও বিবেচনা করা যাবে। দ্বিতীয় আশার ব্যাপারটি হলো প্লাজমা থেরাপি, যা ইদানীং উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চালু হয়েছে কোভিড-১৯ চিকিৎসায়। এই থেরাপিটির পুরো নাম কনভেলেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি (Convalescent plasma therapy)। এই থেরাপি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে বিভিন্ন ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায়। যেমন, ইবোলা ভাইরাস, মার্স, H1N1 ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লু (swine flu) প্রভৃতিতে বিভিন্ন রোগে প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যেসব ব্যক্তি কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন তাদের রক্ত থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করে সেখানে ভাইরাসের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা অ্যান্টিবডির পরিমাণ নির্ধারণ (assay titer) করে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে প্লাজমা সঞ্চালন করা হয়, বলা বাহুল্য রক্তের ম্যাচিংও এক্ষেত্রে করা হয়। তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে কিছু বিষয় সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করা হয়, নতুবা নতুন বিপদ হতে পারে। যে বিষয়গুলোর দিকে বিশেষ নজর দিয়ে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তা মূলত নিম্নরূপ :
১) প্লাজমাদাতার কোনও সংক্রামক ব্যাধি আছে কিনা তা নিশ্চিত করে থেরাপি শুরু করা।
২) যদি প্লাজমা থেরাপি অকৃতকার্য হয় তাহলে রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়ে যেতে পারে, সেই দিকটির প্রতি লক্ষ রাখা।
৩) রোগীর ইমিউনিটির প্রতি লক্ষ রাখা, যাতে উল্টো ইমিউনিটি কমে গিয়ে রোগীকে আরও দুৰ্বল না করে ফেলে।
লেখক: অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, গ্রাজুয়েট বায়োকেমিস্টস অ্যাসোসিয়েশন