ঈদকে সামনে রেখে গত ১০ মে থেকে শপিং মল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বলা ছিল, সব দোকান ও মলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কিন্তু মানুষের ভিড়ে সব বিধি উড়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষ কোনোরকমে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শিশুসহ সপরিবারে শপিংয়ে গেছেন। ভিড়ের ঠেলায় সেখানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাও সম্ভব ছিল না। ভিড়ের কারণে দেশের অনেক এলাকায় শপিং মল বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে দোকানের শাটার নামিয়ে বেচাকেনা হয়েছে। পুলিশের অভিযানে দৌড়ে পালানো বা শপিং মলের টয়লেটে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শপিং তো নয়, যেন দারুণ ‘এক্সাইটিং চোর-পুলিশ খেলা’। অনেকের বেপরোয়া আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, এটাই বুঝি শেষ ঈদ, শেষ শপিং।
শপিংয়ের পর আসে নাড়ির টান। বাড়ি ফেরার জন্য প্রায় পাগল হয়ে যান অনেকে। অথচ সরকার আগে থেকেই বলছিল, এবার যেন সবাই নিজ নিজ অবস্থানে ঈদ করেন। এ কারণে সাধারণ ছুটির পাশাপাশি ঈদের সময় ৭ দিন যান চলাচলে কঠোর কড়াকড়ি আরোপের কথা বলা হচ্ছিল। পুলিশের আইজি ঢাকা থেকে তো দূরের কথা, বাসা থেকেই বের হতে নিষেধ করেছিলেন। ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, কেউ পায়ে হেঁটে যেতে চাইলেও যেতে দেওয়া হবে না। ঈদ পর্যন্ত রাস্তায় বসিয়ে রাখা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ জেনে গেছে, সরকার আর পুলিশের এসব হুমকি ফাঁকা আওয়াজ মাত্র। গত দুই মাসে সরকার সবচেয়ে নরম, মানবিক, মানবাধিকার সচেতন। তাই তো ঈদের আগে বাড়ি ফেরার বেপরোয়া স্রোত শুরু হয়। পণ্যবাহী ট্রাক, মাইক্রোবাস, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, সিএনজি, রিকশা, ভ্যান, পায়ে হেঁটে- যে যেভাবে পেরেছেন; ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করেছেন। মহাসড়কে, ফেরিঘাটে ছিল জনস্রোত। সরকারের বজ্র আঁটুনির চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ফস্কা গেরো হয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া মানুষগুলোকে কোনও একটা গন্তব্যে পৌঁছে দিতে প্রাইভেট গাড়ির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তারপর মহাসড়কে গাড়ির ঢল নামে। অনেকে বলেন, আমরা তো সরকারি নির্দেশনা মেনেই গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। এটা আসলে এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। হঠাৎ আপনারা সরকারের নির্দেশ মানা বাধ্য নাগরিক হয়ে গেলেন। কিন্তু সরকার যখন ঘরে থাকতে বলেছিল, তখন তো আপনারা ঘরে থাকেননি। সবসময় সরকারের সব সিদ্ধান্ত আপনারা মানেন তেমনও তো নয়। সরকার শপিং মল খুলে দিয়েছে, প্রাইভেট গাড়ি চলাচল শিথিল করেছে। কিন্তু সরকার তো আপনাদের শপিং বা বাড়ি যেতে বাধ্য করেনি। আর সরকার বললেই আপনাকে সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে, তেমনও তো কথা নেই। নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে, আপনি বুঝবেন না কেন। এরপর করোনায় আক্রান্ত হলে আপনি তো সেই সরকারকেই গালি দেবেন। সরকার কেন ভালো হাসপাতালের ব্যবস্থা করলো না, হাসপাতালে কেন ডাক্তার নেই, পুলিশ কেন বাধা দিলো না, সাংবাদিক কেন সঠিক খবর দিলো না- আপনার গালি দেওয়ার লোকের অভাব নেই। অথচ নিজে নিয়ম মেনে চললে আপনার কাউকেই গালি দিতে হতো না। আগে বাঁচুন, তারপর প্রাণখুলে গালি দিয়েন।
ঈদের দিন এবং পরদিন ঢাকার রাস্তার অবস্থা দেখে সেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শঙ্কাটা আমার মধ্যেও চেপে বসেছে। নিছক শঙ্কা নয়, রীতিমতো আতঙ্ক। দুই ঈদ, দুর্গাপূজা, পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইনস ডে’তে ঢাকার রাস্তায় রংবেরঙের পোশাক পরা আনন্দে উচ্ছল নারী-পুরুষ শিশুদের দেখতে আমার দারুণ লাগে। অফিসে যাওয়া-আসার পথে আমি মন ভরে দেখি। এক রিকশায় পাঁচ জন, মোটরসাইকেলে তিন জন, রাস্তায় হল্লা করে আড্ডা মারার ছবি সত্যি মন ভরিয়ে দেয়। ভেবেছিলাম এবার সেই দৃশ্য দেখা হবে না। কিন্তু বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার পথে চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনের রাস্তায় রীতিমত জ্যাম দেখে চমকে গেলাম। অফিসে গিয়ে শুনলাম এবং দেখলাম হাতিরঝিল, মিরপুর বেড়িবাঁধ, মানিক মিয়া এভিনিউ, পূর্বাচল- সব উন্মুক্ত স্থানেই উপচেপড়া ভিড়। নতুন কাপড় পরা, ঝলমলে সব মুখ দেখে আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তাদের হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা কান্নাটা দেখতে পাচ্ছি আমি, যা মন খারাপ করে দিয়েছে। সেই চিরচেনা দৃশ্য যেন। গাদাগাদি করে রিকশা বা ভ্যানে চড়া, মোটরসাইকেলে তিন জন, মুখে মাস্ক নেই, দূরত্বের বালাই নেই; যেন সব স্বাভাবিক। অথচ এখন সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি ছাড়া করোনাভাইরাসের আর কোনও প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি। আমি খালি দেখি আর ভাবি এই ছেলেমেয়েগুলোর কি কোনও অভিভাবক নেই? তারা কোন সাহসে সন্তানদের অমন বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারলেন? সরকারই বা কেন সেটা হতে দিলো।
সরকারের এক আদেশেই তো থার্টিফার্স্ট নাইটে রাস্তা শূন্য থাকে। তাহলে ঈদের দিনে উন্মুক্ত স্থানগুলো বন্ধ করা হলো না কেন?
সবাই যে অসচেতন তা কিন্তু নয়। ঢাকার একটা বড় অংশের মানুষ এখনও ঘরেই আছেন। আমাদের বিল্ডিংয়ে আমি ছাড়া আর কেউ বের হয় না। আমার কলেজপড়ুয়া ছেলে প্রসূন ১৭ মার্চের পর থেকে আজ পর্যন্ত শুধু একদিন ৮ মিনিটের জন্য বেরিয়েছিল। তাও তার মায়ের কাছে অনেক আবেদন নিবেদন করে। তাও আমি তাকে নিয়ে গাড়ি দিয়ে একটা চক্কর দিয়েছি, কোথাও নামতে দেইনি। কিন্তু ঘরে থেকেও কিন্তু আপনি বিপদে পড়তে পারেন। ধরুন আপনার বাসায় ১০ জন সদস্য। ৯ জনই ঘরে থাকেন। একজন তরুণ কারও কথা শোনে না, ঘুরে ফিরে বেড়ায়। সে করোনা আক্রান্ত হলেও তিন দিন জ্বরে ভুগে হয়তো ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু তার বয়ে আনা ভাইরাস বাসার প্রবীণ সদস্যটিকে তিন দিনের মধ্যে আইসিইউতে নিয়ে যেতে পারে। তাই সাবধানতাটা সবার জন্যই জরুরি, সবাই মিলেই জরুরি।
ঈদের ঘোরাফেরা নিয়ে এটিএন নিউজের শিরোনাম ছিল, ‘করোনা আতঙ্কেও উন্মুক্ত স্থানে উপচেপড়া ভিড়; উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি।’ অনেক রিপোর্ট এবং রাস্তার ছবি দেখে আমার ভয় হচ্ছে। সেই ডাক্তারের পরামর্শ মতো বেসরকারি হাসপাতাল নিয়েও হয়তো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। এদের জন্য হয়তো উন্মুক্ত স্থানেই হাসপাতাল বানাতে হবে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ