শেষে রাশিয়াও সেই পথ ত্যাগ করেছে, চীন তো আগেই করেছে। ১৯৭২ বা ’৭৩ সালে, আমার সঠিক মনে নেই, চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে এক সুধী সমাবেশে ভারতের স্বনামধন্য বাঙালি চিন্তাবিদ, দার্শনিক শিবনারায়ণ রায়ের একটা বক্তৃতা শুনছিলাম। তিনি বলেছিলেন সুখের আশায় পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্লক গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা সবকিছু ত্যাগ করেছে বহুদিন আগে, কিন্তু সুখের মুখ তারা দেখেনি। অথচ পশ্চিম ইউরোপ কিছু ত্যাগ না করেই তাদের চেয়ে শতগুণ সুখে আছে। তিনি বলেছিলেন পূর্ব ইউরোপের এই ব্যবস্থা আর বেশিদিন টিকবে না, অচিরেই ভেঙে পড়বে। ঠিক তাই হয়েছিল। শিবনারায়ণ রায় ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদি পুরুষ এম এন রায়ের অনুসারী ছিলেন।
যাহোক, এবারের বাজেটের আগে কিছু কথা আলোচনা করতে বসে এত কথা লিখলাম। উত্তরাধুনিক উদারনৈতিক বাজার ব্যবস্থায় অগ্রগতির পথ সম্ভবত দেখাতে পারেন মিল্টন ফ্রিডম্যান এবং জন মেনার্ড কেইনস। তারাই বাজার ব্যবস্থার পথ পরিদর্শক। মিল্টন ফ্রিডম্যান একজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ। তিনি তার ব্যয় বিশ্লেষণ, অর্থের ইতিহাস ও তত্ত্ব এবং স্থায়িত্ব নীতির জটিলতা বিষয়ক গবেষণার জন্য ১৯৭৬ সালে অর্থনীতিতে নোবেল স্মারক পুরস্কার লাভ করেন। জন মেনার্ড কেইনস ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ছিলেন, যার মতামত মৌলিক অর্থনীতির তত্ত্ব এবং অনুশীলনের এবং সরকারগুলোর অর্থনৈতিক নীতিগুলো পরিবর্তন করে। ২০তম শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ এবং আধুনিক ম্যাক্রো-ইকোনমিক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং জীবনে অর্থমন্ত্রী হিসেবে বহু বাজেট পেশ করেছেন। তিনি জন মেনার্ড কেইনসের একান্ত ভক্ত, অনুসারী। তিনি তার প্রেসক্রিপশন মতো বাজেট তৈরি করতেন। আবার অনেক অর্থমন্ত্রী মিল্টন ফ্রিডম্যানকে অনুসরণ করতেন। অনেকে মিক্সড পদ্ধতি অনুসরণের পথ বেছে নিয়েছেন।
আমাদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থনীতির মানুষ নন, তবে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সাইফুর রহমানও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। তিনিও দীর্ঘ সময়ব্যাপী অর্থমন্ত্রী ছিলেন, বহু বাজেট পেশ করেছেন। তবে কখনও গণবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি। মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হিসেবে একটিমাত্র বাজেট পেশ করেছিলেন, তাও সম্পূর্ণ বাজেট তার অসুস্থতার জন্য পেশ করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পক্ষে বাজেট পেশ করেছিলেন।
এবারও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল আগামী ১১ জুন বেলা সাড়ে তিনটায় জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করোনার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এবারের বাজেট অধিবেশনে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার থাকছে না। সংসদ ভবনের বাইরে পশ্চিম দিকে মিডিয়া সেন্টার থেকে ওই দিন বেলা সোয়া তিনটা থেকে বাজেট ডকুমেন্টস বিতরণ করা হবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্দিষ্ট স্থান থেকে বাজেট ডকুমেন্টস সংগ্রহ করতে হবে। দেশে এমন বাজেট পেশ সম্ভবত প্রথম।
এবার বাংলাদেশে তথা সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। লকডাউনের কারণে জীবন প্রবাহ গত পাঁচ মাস ধরে বিধ্বস্ত। সুতরাং অসুস্থ পরিবেশের কথা চিন্তা করে বাজেট তৈরি করতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সর্বাবস্থায় প্রবৃদ্ধিকে মাথায় রেখে কাজ করার পক্ষে। অবশ্য গত ১১ বছরে তার সময়ে প্রবৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান ছিল। কখনও কমেনি। করোনার কারণে রাজস্ব আয় চাপে পড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছু স্থবিরতা দেখা দেবে। সুতরাং গত বছরের প্রবৃদ্ধি এবার অর্জন করা সম্ভব নাও হতে পারে।
সরকার চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। গত অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে যেই হারে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে সেই হারে চাকরির সুযোগ হয়নি। প্রবৃদ্ধির সুফল দেশের মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য হ্রাসে বেশি বেশি কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তিন বছরের বাস্তবায়নযোগ্য প্রণোদনা প্রকল্পের জন্য এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই এই টাকা বাজেটে বরাদ্দ রাখা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র দিয়ে পত্রিকায় খবর এসেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার হতে পারে পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এটি চলতি বাজেটের তুলনায় ৫১ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বেশি। তবে বাজেটের আকার চূড়ান্ত করা হয় বাজেট ঘোষণার কয়েক দিন আগে। তাই এ আকারে পরিবর্তন আসতে পারে।
আগের মতো এখন এইড কনসোর্টিয়াম নেই। তবে বাংলাদেশ লেনদেনে স্বচ্ছতার পরিচয় দিয়ে আসছে দীর্ঘদিনব্যাপী। কোনোখানে কোনোভাবে বাংলাদেশ খেলাপি হয়নি। দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে ঋণ দিতে উৎসাহ বোধ করে। টাকার কোনও অভাব হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ১০০ ইপিজেড তৈরি করছে, আবার সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির বহির্বিশ্বে বেড়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৬ নম্বর বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তা ২৭ নম্বরে উঠে আসতে পারে।
বাংলাদেশের অগ্রগতিতে করোনাভাইরাস বিরাট আঘাত সৃষ্টি করেছে, কিন্তু এর মধ্যেও বাংলাদেশ থেমে নেই। গত পাঁচ মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে মাল খালাস একদিনের জন্যও বিরত নেই। বিদেশি জাহাজ অব্যাহতভাবে মাল খালাস করে যাচ্ছে। অবশ্য কন্সাইনমেন্ট বন্দরের বাইরে ডেলিভারিতে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। যে কারণে কনটেইনার জট দেখা দিয়েছে। সম্ভবত এখন দ্রুত মালামাল ডেলিভারি হবে, কারণ কাস্টম হাউস গত ৩১ মে থেকে খোলা হয়েছে।
যেহেতু করোনাকালের বাজেট, তাই আশা করবো বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা যেন বাস্তবসম্মত রাখা হয়। করোনার প্রভাবে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বড় লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ার কোনও মানে হয় না।
এবারের বাজেটে নিশ্চয়ই কৃষি ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বেশি হবে। প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন যেন পতিত কোনও জমি অনাবাদি না থাকে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু অনুরূপ আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে একটি কথা স্মরণে আসছে যে আমরা দেখেছি ’৭৪ সালে স্কুল-কলেজের মাঠেও চাষাবাদ হয়েছিল। এখন অনুরূপ উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীকে তা ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। সমগ্র দেশে স্কুল-কলেজের মাঠও কম হবে না। আউশ-আমনের প্রতি খুব কড়া দৃষ্টি দিতে হবে এবং পর্যাপ্ত উপকরণ কৃষকদের সরবরাহ করতে হবে। কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া আমন-আউস ঘরে উঠলে আল্লাহ চাইলে খাদ্যের টান পড়বে না। গ্রামে একটি কথা আছে—ঘরে চাউল থাকলে লবণের ছিটা দিয়ে হলেও ভাত খাওয়া যায়।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com