কোভিড নিয়ন্ত্রণে দ্রুত শনাক্তকারী কিট ও আমাদের করণীয়

ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দারবর্তমান পরিস্থিতিতে টেস্ট শুধু করার জন্য করা নয়, বরং অতি দ্রুত ‘সর্বোচ্চ সংখ্যক ও মানসম্পন্ন টেস্ট’ করতে হবে। করোনা রোগী শনাক্ত করতে হবে। শনাক্ত রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা, নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ বা আইসোলেশন সেবায় রাখতে হবে। আর বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিড সংক্রমিত রোগী শনাক্ত করতে ‘অ্যান্টিজেন টেস্ট’-এর বিকল্প নেই। জনস্বাস্থ্যের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ এই জরুরি মুহূর্তে সেটাই বলে।
আমরা তথ্য-উপাত্তের দিকে একটু নজর দিলে দেখবো সেগুলো কিন্তু শুধুই কিছু ‘সংখ্যা’ নয় একেবারেই। বরং এক একটি সংখ্যা এক একটি তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার আর্তনাদ, এক একটি সংসারের আশ্রয় হারানোর হাহাকার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র হতে এক এক করে চালিকাশক্তি তথা বুদ্ধিজীবী হারানোর মাধ্যমে সৃষ্ট প্রকট শূন্যতার উপহাস। এমনই কিছু উপাত্ত আমাদের বলছে, কোভিডের প্রকোপ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বেড়েই চলেছে। গত কয়েক সপ্তাহের সংক্রমণের তথ্য অনুসন্ধান করলে পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাবে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে নতুন সংক্রমণের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আক্রান্ত মানুষের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মৃত মানুষের সারি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রসহ আমাদের সবার চোখ-কান বন্ধ করে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা ছাড়া ফলপ্রসূ তেমন কিছুই যেন করার নেই। নিয়তির হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চারদিকে শুধুই অসহায়ত্ব বিরাজ করছে!
কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। সম্ভবত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ বাংলাদেশ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল। যাহোক, যেমনটি শুরুতেই বলছিলাম, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বপ্রথম দরকার ছিল সঠিক পরীক্ষার মাধ্যমে মানবদেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা, যা কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ ও হাতিয়ার হতে পারতো। যেসব দেশ ওই প্রথম পদক্ষেপটি যত দ্রুততার সঙ্গে ও বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে, সে দেশগুলোই এই যুদ্ধে ততটা এগিয়ে আছে।
এবার আসা যাক মানবদেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করার টেস্টিং প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে। মানবদেহের শ্বাসতন্ত্রে করোনাভাইরাস শনাক্তে সবচেয়ে সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য পরীক্ষা করা হয় ‘আরটি-পিসিআর’ (RT-PCR)-এর মাধ্যমে, যা বৈজ্ঞানিক ভাষায়  ‘গোল্ডেন স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে পরিচিত। যদিও এই টেস্টটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল বিধায় বিশ্বের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে কোভিড-১৯ লক্ষণ পরীক্ষায় ‘দ্রুত শনাক্তকারী কিট’ অথবা র‌্যাপিড টেস্ট কিট আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। এই দ্রুত শনাক্তকারী পরীক্ষাগুলো মানবদেহের শ্বাসনালিতে করোনাভাইরাস সৃষ্ট প্রোটিন মলিকিউল (অ্যান্টিজেন), অথবা রক্তে করোনাভাইরাস সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডি শনাক্ত করে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এ ধরনের ‘দ্রুত শনাক্তকারী কিট’  যথাযথ গবেষণা ছাড়া সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক হারে ব্যবহারের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সংস্থাটির মতে, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কোনও দ্রুত পরীক্ষা পদ্ধতিই সঠিকভাবে গবেষণালব্ধ নয়, যার ভিত্তিতে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ তা ব্যাপক হারে জনগোষ্ঠীর ওপর প্রয়োগ করে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় আনতে পারে। তাই আপাতত র‌্যাপিড টেস্ট কিটগুলোকে শুধু গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ ধরনের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনে অন্যতম যুক্তিসঙ্গত কারণের মূলে রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠীর ‘স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত’ করা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যেকোনও টেস্টের বেলায় ‘সেনসিটিভিটি’ (প্রকৃত রোগ শনাক্তের ক্ষমতা) একটি বহুল প্রচলিত পরিভাষা। একটি টেস্টের সেনসিটিভিটি বলতে বোঝায়, ওই টেস্টটি একটি নির্দিষ্ট রোগে প্রকৃতভাবে আক্রান্ত কতজনকে নিশ্চিত রোগী হিসাবে শনাক্ত করতে পারছে। যেমন, কোভিডে আক্রান্ত ১০০ জন প্রকৃত রোগীর মধ্যে ৯০ জনকে যদি কোনও টেস্ট কোভিড রোগী হিসাবে শনাক্ত করে তাহলে ওই টেস্টটির সেনসিটিভিটি হলো ৯০ শতাংশ। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ‘দ্রুত শনাক্তকারী কিটগুলোর’ সেনসিটিভিটি মাত্র ৩৪ থেকে ৮০ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, টেস্ট কিটগুলোর নিম্ন ও উচ্চমাত্রার সেনসিটিভিটির মাঝে ব্যবধান অনেক বেশি। তার ওপর যে দ্রুত শনাক্তকারী কিটটি সর্বাধিক সংখ্যক কোভিড আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করতে সক্ষম তার মাত্রাও মাত্র ৮০ শতাংশ, যা গোল্ডেন স্ট্যান্ডার্ড  হিসাবে খ্যাত RT-PCR টেস্টের সাথে তুলনীয় নয়। এখানে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আরও লক্ষণীয়, যে টেস্ট কিটের সেনসিটিভিটি ৮০ শতাংশ সেটি যদি ব্যাপকভাবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে ১০০ জন প্রকৃত সংক্রমিতদের মধ্যে ২০ জন রোগীই কোরোনার নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে সমাজে আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়াবে এবং রোগ ছড়াবে। জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি অত্যন্ত ভয়াবহ এবং নেতিবাচক।
সম্প্রতি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত র‍্যাপিড টেস্ট কিটের মাধ্যমে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন টেস্ট করার সম্ভাবনা সম্পর্কে সঙ্গত কারণেই খুব আশান্বিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে একটি দেশি প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত সকল গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেই তাদের টেস্ট-কিট দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের জন্য সরকারের অনুমতি চেয়েছে। কিন্তু আদতে সেটি সেনসিটিভিটির বিভিন্ন স্তরে আশানুরূপ ও গ্রহণযোগ্য ফল প্রদর্শনে সক্ষম হয়নি। তাই অগণিত অপেক্ষমাণ জনগণের মতো আমিও আশাহত হলাম যখন জানলাম, ল্যাবরেটরির বাইরে কোনও ধরনের প্রায়োগিক গবেষণা এবং এর সেনসিটিভিটি ফলাফল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়াই গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো একটি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা তাদের উদ্ভাবিত কিটটি ব্যাপকভাবে ব্যবহারের জন্য গণমাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত প্রচারণা চালিয়েছিল। অথচ এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত সরকার অথবা জাতির সামনে খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেনি।

তাহলে হয়তো কোভিড সৃষ্ট এই ক্রান্তিলগ্নে ব্যাপারটি নিয়ে জাতিকে কালক্ষেপণ করতে হতো না, বিভ্রান্ত হতেও হতো না।
তবে হতাশার পুনরাবৃত্তি নয়, বরং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সময় খুবই কম। মৃত্যু ঠেকাতে কোভিড রোগী শনাক্ত করতে হবে অতি দ্রুত। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি নয়, বরং ‘অ্যান্টিজেন টেস্টের’ প্রতিই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে উচ্চমানের সেনসিটিভিটি প্রদর্শন করে এমন গবেষণালব্ধ ‘দ্রুত শনাক্তকারী কিট’ অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য অতিসত্বর আমদানি করা যেতে পারে। এছাড়া সরকারের কোভিড নির্ধারিত আর্থিক বরাদ্দ ও দাতা সংস্থার আর্থিক সহযোগিতার সদ্ব্যবহার করে উপজেলা পর্যায়েও RT-PCR মেশিন বসানো যায়, প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার অপেক্ষমাণ তালিকা হতে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট ও স্বাস্থ্যকর্মী দ্রুত নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তেমন মেধা, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা নিশ্চয়ই আমাদের রয়েছে। মনে রাখতে হবে, জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশ যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সঠিক তথ্য প্রকাশ, পর্যালোচনা এবং সম্ভাব্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে প্রশাসনিক কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার কোনও বিকল্প পথ জাতির সামনে এখন খোলা নেই।
আমরা চাই বাংলাদেশ তার গুণী জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সকল স্তরে যোগ্য নেতৃত্ব, আইনের সময়োচিত প্রয়োগ এবং সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক সক্ষমতা ও লোকবল অতি দ্রুততার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে অচিরেই নিজেদের করোনামুক্ত করবে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণেরই অপেক্ষা এখন।

লেখক: স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা, বিশ্বব্যাংক