জিডিপির প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই একটা রাষ্ট্রের জনগণের সঠিক অবস্থা নির্দেশ করে না। একটা রাষ্ট্রের উৎপাদন বাড়ার চেয়ে সেই উৎপাদনের বণ্টন কীভাবে হচ্ছে সেটা আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বণ্টনের ওপরই নির্ভর করে উন্নয়নের সুফল সমাজের বেশিরভাগ মানুষের কাছে যাবে নাকি হাতেগোনা অল্প কিছু মানুষের কাছে যাবে। এই দেশে চালু থাকা ভয়ঙ্কর দুর্নীতির ফলে করোনার আগেই প্রায় ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমা আর প্রায় ২ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো। অথচ ওয়েলথ এক্স-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা গেছে গত এক দশকে সারা বিশ্বে ধনীর সংখ্যা (৫০ লাখ ডলার বা ৪৫ কোটি টাকা) বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ প্রথম। দশকব্যাপী দুর্নীতির এর চেয়ে ভালো প্রমাণ আর কিছুই হতে পারে না।
সবকিছুর পরও এই সরকারের জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে উন্নয়নের এক বিরাট নির্দেশক হিসেবে দেখানোর প্রবণতা আছে। সে জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশে জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় সেটা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো, এটা এখন প্রমাণিত। জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা এখন এমন পর্যায়ে গেছে এবারকার বাজেটে এটা একটা ভয়ঙ্কর অসুস্থতা হিসেবে এসেছে আমাদের সামনে।
বর্তমান অর্থবছরে শেষ তিন মাস করোনার প্রভাব পড়ার কারণে চলতি অর্থবছরের জিডিপি ১.৬ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, কিন্তু অর্থমন্ত্রী বলছেন এটা ৫.২% হবে। এটা শুনে চমকে গিয়ে থাকলে আমাদের হতভম্ব করে দেওয়ার মতো তথ্য এরপরই এসেছে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা তিনি নির্ধারণ করেছেন ৮.২ শতাংশ।
করোনার আক্রমণের পর থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিবিদরা প্রত্যেকেই একমত করোনার কারণে ঘটতে যাওয়া মন্দা ১৯২৯-এর মহামন্দার পর্যায়ে যাবে তীব্রতায়। ২০০৮ সালের মন্দার পূর্বাভাস দিতে পেরেছিলেন হাতেগোনা যে দুই-তিনজন, তাদের একজন নরিয়েল রুবিনি বরং এক কাঠি বেড়ে বলছেন এবারকার মন্দা সেই মহামন্দাকেও ছাড়িয়ে যাবে। মন্দার ধরন নিয়ে ‘V’ বা ‘U’ প্যাটার্ন নয়, রুবিনি বলছেন এটা হবে ‘L’ প্যাটার্নের। অর্থাৎ পতন খুব দ্রুত হবে এবং মন্দা চলতে থাকবে পুনরুত্থানের কোনও সুনির্দিষ্ট পুর্বানুমান ছাড়াই। সব বিবেচনায় এই অনিশ্চয়তায় চীনের মতো দেশও ইতিহাসে প্রথম এবার তাদের বাজেটে কোনও জিডিপির প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেনি। এরকম পরিস্থিতিতে ৮.২% জিডিপির প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা অকল্পনীয়।
প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা বাজেটের একেবারে ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করে। কারণ সেই প্রবৃদ্ধির নিরিখেই নির্ধারিত হয় দেশের রাজস্ব আয় কতটা হবে এবং সেটার ভিত্তিতেই ব্যয় কতটা হবে, ঘাটতি হবে কী পরিমাণ এবং সেটা মেটাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে এনবিআর এর লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৪৮ হাজার কোটি টাকা নন-এনবিআর এবং অন্যান্য খাত থেকে।
চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের পরিস্থিতিটা দেখলেই বোঝা যাবে এই লক্ষ্যমাত্রা কতটা হাস্যকর। এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা, পরে সেটা সংশোধিত হয়ে হয়েছিল ৩ লাখ কোটি টাকা। এই বছরের মে মাসে এনবিআর চেয়ারম্যান অর্থ সচিবকে চিঠি দিয়ে জানান, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে রাজস্ব আহরণ বড় জোর ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে এনবিআর-এর আদায় কমবে ১ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, আর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে আদায় কমবে ৮০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
করোনার কারণে এখনও পরিস্থিতি যেমন আছে, সেটা অনেকটা সময় প্রলম্বিত হবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই ভবিষ্যতে মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট হবে। তাতে মানুষের আয় কমবে, অভ্যন্তরীণ ভোগ কমে যাবে বিপুল পরিমাণে। তাহলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুই রকমের করই কমে যাবে উল্লেখযোগ্যভাবে। তাহলে এই অর্থবছরে এনবিআর এবং অন্যান্য রাজস্ব আয়ে কীভাবে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা যায়?
এই বাজেটের চূড়ান্ত আকার (ব্যয়) ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার অর্থাৎ এই বাজেটে ঘাটতি হবে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ জিডিপি’র ৬ শতাংশ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। যে অকল্পনীয়, উদ্ভট রাজস্ব আয়ের ওপর ভিত্তি করে এই ঘাটতি দেখানো হয়েছে সেটা এর আশপাশেও যাবে না, অর্থাৎ সরকার প্রস্তাবিত বাজেটে যে ঘাটতি দেখাচ্ছে, ঘাটতি হবে কমপক্ষে তার দ্বিগুণ।
ঘাটতি মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি। এছাড়াও সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
চলতি অর্থবছরে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্থবছরের ১৩ মে পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ৮১ হাজার কোটি টাকা। খুব সহজ অংকে বলে দেওয়া যায় অর্থবছর শেষ হতেই সরকারের ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ নির্ধারিত পরিমাণের দ্বিগুণের বেশি হবে। এদিকে এই অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৬৮ হাজার কোটি টাকা থাকলেও সেটা পরে সংশোধিত হয়ে হয়েছে ৫৬ কোটি টাকা। করোনার পরিস্থিতিতে যখন সারা পৃথিবী অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি, তখন এই বছর বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার পরিমাণও হবে অতি নগণ্য। সবকিছু বিবেচনা করে এটা যৌক্তিকভাবেই বলা যায় এই বছরের বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা।
ঘাটতির ক্ষেত্রে সরকার প্রতি বছরের মতো সংশোধিত এডিপি প্রস্তাব করবে, এবং বরাবরের মতো স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রগুলোর প্রকল্প বরাদ্দ কমাবে। অথচ এবারের করোনা সংকটে এই খাতগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণ অতি তুচ্ছ যা দিয়ে এই সংকট মোটামুটিভাবে মোকাবিলার কথা কল্পনাও করা যায় না। ঘাটতি কমানোর জন্য কল্যাণ বাজেটের এই হ্রাস এমনিতেই তলানিতে থাকা জনগণের জীবনমানকে আরও অনেক নিচে নামিয়ে দেবে, করোনার মতো সংকটে জনগণের জীবনকে একেবারেই বিপর্যস্ত করে ফেলবে।
ঘাটতি মেটানোর জন্য মূল পদক্ষেপ হবে ঋণ করা। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের টাকা ধার করার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এটা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহকে অনেক কমিয়ে দেয়। যার ফলে বিনিয়োগ কমে গিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না। এদিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ সুদ দিয়ে ৯ শতাংশে ঋণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি করার ফলে ব্যাংকগুলো এখন আর বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে আগ্রহী না।
সরকারের তথাকথিত করোনা প্রণোদনার জন্য যেসব নীতিগত পরিবর্তন করে (যেমন, রেপোর সুদ হার হ্রাস) সরকার ব্যাংক খাতে তারল্য বৃদ্ধি করেছে, সেগুলোর মাধ্যমে ব্যাংকের হাতে যাওয়া অর্থ ব্যাংক আবার সরকারকেই ঋণ দেওয়ার জন্য ট্রেজারি বিল/বন্ডের নিলামে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো।
এদিকে এবার ঘাটতি যে অকল্পণীয় পরিমাণ হতে যাচ্ছে, সেটা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়িয়েও পূরণ করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ সরকারকে বিপুল পরিমাণের নতুন টাকা ছাপাতে হবে। সরকার প্রয়োজন মতো যেকোনও পরিমাণ টাকা ছাপাতে পারে এবং সরকারের সেটা করাই উচিত এটা বলে মডার্ন মনিটরি থিওরি (এমএমটি)। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে এই তত্ত্ব যে যুক্তিতে সরকারকে প্রয়োজন মতো টাকা ছাপাতে বলে, সেই যুক্তি বাংলাদেশের একেবারেই প্রযোজ্য না। কারণ, এই দেশে শিল্পে-ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য নেওয়া টাকা বিনিয়োগ না হয়ে লুট হয়, সেই লুটের টাকা আবার পাচার হয়। ওদিকে করোনার এই সময়ে এবং করোনা উত্তরকালে রফতানি আয় বড়মাত্রায় কমে যাবে এবং রেমিট্যান্সেও ধস নামবে; ফলে ব্যালান্স অব পেমেন্ট-এ নিশ্চিত ঋণাত্মক অবস্থা তৈরি হবে। সব বিবেচনায় রাখলে এই টাকা ছাপানো উচ্চ মূল্যস্ফীতি তৈরি করে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে প্রচন্ডভাবে দুর্বল করে দেবেই।
অথচ সার্বিক সংকট বিবেচনা করে সরকারের উচিত ছিল এই বছর শুধু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা। এই সময়ে করোনাক্রান্ত এবং করোনায় আক্রান্ত না হয়েও মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। তাই দ্রুততম পদক্ষেপে মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য সব রকম বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল করোনার অভিঘাতে যে কোটি কোটি মানুষ তাদের উপার্জন হারিয়ে অনাহারে/অর্ধাহারে আছে, তাদের খাবার এবং অন্যান্য জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অনেক বেশি বরাদ্দ করা। আর সর্বোপরি করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী ধেয়ে আসা খাদ্য সংকটের মুখে কৃষিতে অনেক বেশি পদক্ষেপ নেওয়া। এজন্য এই অর্থবছরে অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে দেওয়াই হতো কল্যাণমূলক এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। কিন্তু সেটা করা হয়নি, ওসব বরাদ্দ আছে একই। চরমতম বিপদের দিনেও এই দেশের নাগরিকদের কল্যাণের পদক্ষেপ এই সরকার নেবে এই আশা এখন কোনও সচেতন মানুষ আর করে না।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য