আদমজী এশিয়ার বৃহত্তম জুটমিল। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে বিশাল জায়গা নিয়ে আদমজী জুটমিল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বর্তমানে ওই জায়গায় আদমজী ইপিজেড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মিলগুলো পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত ছিল। উপার্জন নিয়ে পাকিস্তানের সময় বিবাদের সূত্রপাত। বিবাদের পরিণতিতেই পাকিস্তানের অবসান। আজ সেই জুটমিলগুলোর পরিসমাপ্তির কথা বলছে সরকার।
ব্রিটিশের সময়ে প্রথম জুটমিল গড়ে ওঠে হুগলি নদীর তীরে। অর্থাৎ কলকাতা কেন্দ্রিক কাঁচা পাট যেতো পূর্ব বাংলা থেকে। ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলায় একটি জুটমিল গড়ে উঠেছিল সিরাজগঞ্জে। তাও আসামের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়। ভারতের বাইরে ব্রিটিশরা জুটমিল গড়ে ছিল তাদের ড্যান্ডি নামক স্থানে। আদমজী, করিম, লতিফ বাওয়ানী ইত্যাদি সারিবদ্ধ জুটমিলের অবস্থান নারায়ণগঞ্জে হওয়ায় তাকে বাংলার ডান্ডি বলা হতো। পাকিস্তানের করাচিতেও কয়টি জুটমিল রয়েছে।
বর্তমানে বিজেএমসির কাছে জুটমিল রয়েছে ২৫টি। এই জুটমিলগুলোতে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা হলো ২৫ হাজার ৮৮৬ জন। চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান চায়না টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশন অ্যান্ড টেকনিক্যাল করপোরেশনের সঙ্গে কারিগরি সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল আমাদের। তারা জরিপ চালানোর পর বলেছে বর্তমানে মিলগুলোর বিদ্যমান যন্ত্রপাতি সংস্কার করে কোনও লাভ হবে না। এই মিলগুলোর সবকিছুই পরিবর্তন করতে হবে। সুতরাং সরকারের পক্ষে মিল বন্ধ করে নতুনভাবে বসানোর পরিকল্পনা ভিন্ন অন্য কোনও চিন্তার অবকাশ নেই।
পাটকলগুলোর বয়স হয়েছে ৬০-৬৫ বছর। অপরদিকে বিদেশে পণ্য বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত ২০১৭-১৮ সালে যেখানে পাট পণ্য বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা, সেখানে ২০১৮-১৯ সালে বিক্রি হয়েছে ৫৯২ কোটি টাকা। ২০১৩ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৮ হাজার ৯৫৪ জন স্থায়ী শ্রমিক অবসরে গেছেন। তাদের কাউকেও অর্থ সংকটের কারণে রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট দেওয়া যায়নি। প্রতি বছর নিয়মিত বেতনভাতার জন্য শ্রমিকদের ধর্মঘটে যেতে হয়। অর্থাৎ মিলগুলো স্থায়ী সমস্যার আধার হিসেবে বিরাজমান। এটা তো চিন্তা করা দরকার।
স্থায়ী শ্রমিকদের তাদের রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট দিয়েই বিদায় করার যে সিদ্ধান্ত বিজেএমসি নিয়েছে উল্লিখিত কারণে মনে হচ্ছে এটাই উত্তম সিদ্ধান্ত। বিজেএমসির সর্বমোট ৬ হাজার কোটি টাকা সরকারের কাছে চেয়েছে। সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছে। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করবো এই সমস্যাটা যেন একসঙ্গে সমাধানের ব্যবস্থা করে। দফায় দফায় করা উচিত হবে না। দফায় দফায় করলে টাকাটা দিয়ে শ্রমিকরা অন্য কিছু করতে পারবে না। রাষ্ট্রের জন্য ৬ হাজার কোটি টাকা বিরাট কিছু নয়। আর শ্রমিকরা যদি টাকাটা এককালীন পায়, তবে কেউ তাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে বলে মনে হয় না। হেসে খেলে তারা তাদের সম্মতির কথা জানাবে। নতুন জীবনের পরিকল্পনা করতে পারবে।
আর শ্রমিক নেতা এবং দলীয় নেতাদের অনুরোধ করবো মিলগুলো যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় চালানোর ব্যবস্থা করলে কপালের দুঃখ কপালেই থাকবে। এর চেয়ে মিলগুলোকে নতুনভাবে নতুন মেশিনপত্র দিয়ে চালু করার সুযোগ দেওয়া উচিত সরকারকে। যারা অবসরে যাবে তাদের মধ্য থেকে দক্ষ শ্রমিকদের নতুন মিলেও চাকরি দেওয়ার সুযোগ থাকছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। দেশে এতো দক্ষ শ্রমিক কোথায়!
পত্রিকায় দেখছি কিছু কিছু ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বলেছেন শ্রমিকদের বিদায় করার জন্য যে ৬ হাজার কোটি টাকা বিজেএমসি সরকারের কাছে চেয়েছে সেই টাকা দিয়ে নাকি মিলগুলো রিপেয়ারিং করলে মিলগুলো চলবে। এটা সম্ভবত সম্পূর্ণ এক অলীক স্বপ্ন। শ্রমিকদের বক্তৃতা দিয়ে বিভ্রান্ত না করে বেনিফিট নিয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া উচিত হবে বলে মনে হয়।
আরেকটি কথা স্মরণ করা উচিত, পাকিস্তানের সময় মিলকে এক্সপোর্ট-এর বরাবরে বোনাস ভাউচার দিয়ে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করা হতো। ব্যাপক এমপ্লয়মেন্ট-এর ব্যবস্থা ছিল বলে সরকার মিলগুলোকে রক্ষা করার ব্যাপারে যত্নবান ছিল। আগাগোড়া ইতিহাস পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, যেন কোনও ভুল সিদ্ধান্তে এতগুলো শ্রমিকের ভোগান্তির কারণ না হয়ে পড়ে। সমগ্র বিশ্ব করোনা আক্রান্ত। সুতরাং দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি করা কারও উচিত হবে না।
প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন প্রথমবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন ফোর্ড গাড়ি কোম্পানি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য কোর্টের অনুমতি প্রার্থনা করেছিল। বিরাট এমপ্লয়মেন্ট-এর কথা চিন্তা করে ওবামা রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রদান করে ফোর্ড গাড়ি কোম্পানিকে জীবিত রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তাতেও ফোর্ডকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দেখা যাচ্ছে বিএমআরইতে কাজ হবে না। তার শতাব্দী প্রাচীন সব মেশিনের পরিবর্তন না করলে ফোর্ড তার গতি ফিরে পাবে না। লাভজনক পর্যায়ে আসতে পারবে না।
বাংলাদেশ আমেরিকার মতো ধনী রাষ্ট্র নয় যে, জনসাধারণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে পাটকলগুলো চালু রাখার বিলাসিতায় মগ্ন হবে। সুতরাং বন্ধ করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নই উত্তম হবে। তবে শ্রমিকদের বেনিফিট এককালীন পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে, নয়তো এই সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য নয়।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com