বর্তমানে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বঞ্চলীয় দু’টি উপজেলা উখিয়া এবং টেকনাফে নির্মাণ করা প্রায় ৩৪টি অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১৩ লাখ, কারও কারও মতে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এর মধ্যে ৫১% শিশু, ৪৫% প্রাপ্ত বয়স্ক, ৪% বৃদ্ধ এবং বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জড লোক রয়েছে। এতো বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ব্যবস্থাপনা এবং তাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় উপাদান (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, সেনিটেশন, সুপেয় পানি, জ্বালানি সরবরাহ, এবং নিরাপত্তা বিধান প্রভৃতি) সরবরাহ করা বাংলাদেশের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল, যা জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনসহ বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি দেশি এবং বিদেশি সাহায্য সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ বিগত তিন বছর মোটামুটি সফলতার সঙ্গে এবং দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছে। কিন্তু চতুর্থ বছরে এসে বাংলাদেশের জন্য আরও কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়াবে। এখানে তার কয়েকটির সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
চতুর্থ বছরে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে তৃতীয় দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা। আমরা গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে রোহিঙ্গাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটা সন্তোষজনক প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৮ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ প্রথম দফা এবং ২০১৯ সালের আগস্টে ২২ তারিখ দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার সমস্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল, কিন্তু উভয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়েছিল কেননা রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। অবশ্য এজন্য রোহিঙ্গাদের দোষ দেওয়া যাবে না, কেননা রোহিঙ্গারা যে রাখাইনে ফিরে যাবে কীসের ভিত্তিতে, কীসের আশ্বাসে, কীসের বিশ্বাসে, কোন প্রতিশ্রুতির বদৌলতে? মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনও নির্ভরযোগ্য আস্থা, গ্রহণযোগ্য প্রতিশ্রুতি এবং দীর্ঘস্থায়ী কোনও বিশ্বাসের জন্ম দিতে পারেনি। মিয়ানমারের নিন্দাযোগ্য অনাগ্রহ, ক্রমাগত অসহযোগিতা, এবং দৃশ্যমান প্রস্তুতিহীনতা দুই দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। মিয়ানমারের এ ধরনের আচরণের কারণেই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা নিজেদের এখনও অনিরাপদ ও ঝঁকিপূর্ণ বলে মনে করে। তাই, তৃতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের যৌথসভা অনিবার্য কারণে হয়নি কিন্তু পরবর্তীতে করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে মে মাসে নির্ধারিত বৈঠকও করা সম্ভব হয়নি। তৃতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার আলোচনাই যেখানে শুরু হয়নি এখনও, সেখানে কবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি একটি সহনীয় পর্যায়ে আসবে এবং কবে তৃতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে তা নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা রয়েই গেলো। ফলে, চতুর্থ বছরে এটা হবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কেননা রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটছে। বিভিন্ন ছোট ছোট দল ও উপদলের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই আছে। এসব উপ-দলীয় শত্রুতা কিছুটা রাখাইনে থাকতেই ছিল আর কিছু বাংলাদেশে আসার পর নতুন করে তৈরি হয়েছে। আবার এ দ্বন্দ্ব-সংঘাত ক্যাম্পের পাশাপাশি ক্যাম্পের বাইরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেও কোনও কোনও সময় অস্থিতিশীল করে তুলছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যার ঘটনা সেখানে ঘটেছে। ইয়াবা চোরাচালানিসহ মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, চোরাই কাঠ ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ সীমান্ত ব্যবসার সঙ্গে কিছু কিছু রোহিঙ্গার যোগাযোগ আছে বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা উখিয়া-টেকনাফের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেও হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে টার্গেট করে নারী ও শিশু পাচারকারী সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা নানান ধরনের রিক্রুটমেন্টের কাজে অর্থ বিনিয়োগ করছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ফলে, চতুর্থ বছরে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে ক্যাম্পের ভেতরে এবং বাইরে উখিয়া-টেকনাফের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা।
একটা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে উখিয়া এবং টেকনাফের স্থানীয় জনগণের জীবনের ওপর একটা ব্যাপক প্রভাব পড়েছে এবং এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষ করে, এলাকার পরিবেশ এবং প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে; বনাঞ্চলগুলো প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে; গবাদি পশুর চারণক্ষেত্রগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে; হাজার বছরের পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে; ধানি জমির মাটির উর্বরতা শক্তি ক্রমান্বয়ে লোপ পাচ্ছে; এলাকার জীববৈচিত্র্যেও একটা ব্যাপক প্রভাব পড়েছে; এবং সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থার হাজার হাজার লোকদের উপস্থিতি এবং নিত্য যাতায়াতের ফলে উখিয়া-টেকনাফের ভৌত-অবকাঠামোর মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের কারণে এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, শ্রমবাজার সংকুচিত হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে এবং আশ্রয়-প্রদানকারী সমাজের প্রতি (হোস্ট সোসাইটি) বিদেশি সাহায্য সংস্থার ঔদাসীন্য স্থানীয় জনগণের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে যা ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে বেশ কয়েকটা দ্বন্দ্ব সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। তাছাড়া, রোহিঙ্গা বিরোধী কিছু সামাজিক প্রতিরোধ ইতোমধ্যে ছোট আকারে উখিয়া ও টেকনাফে এবং এমনকি কক্সবাজার শহরেও লক্ষ করা যাচ্ছে, যা যে কোনও সময় বড় আকার ধারণ করতে পারে। তাই, চতুর্থ বছরে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে স্থানীয় জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকে প্রশমিত করা এবং রোহিঙ্গা-বাঙালির সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখা।
প্রায় তের লাখ রোহিঙ্গার নিয়মিত ভরণপোষণ করা বাংলাদেশের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। যেহেতু জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিয়ে আসছে, সেহেতু এটা বাংলাদেশকে তেমন কোনও সমস্যায় ফেলেনি এতদিন। কিন্তু আন্তর্জাতিক এ সহযোগিতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ব্যাপক প্রকোপের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং পড়বে, তাতে করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতার পরিমাণও হ্রাস পাবে এটা সহজেই অনুমেয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকেই এতো বড় শরণার্থীর বোঝা বহন করতে হবে যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা বড় চাপ তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক সাহায্যের বাইরে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনা প্রায় ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে নিজস্ব কোষাগার থেকে। তাই, চতুর্থ বছরে বাংলাদেশের জন্য আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের চ্যানেলগুলো থেকে যাতে সহযোগিতা অব্যাহত থাকে সেটা নিশ্চিত করা।
পরিশেষে বলবো, রোহিঙ্গারা যখন ২৫ আগস্টকে ‘জেনোসাইড ডে’ হিসেবে পালন করে, তখন বাংলাদেশ এ দিনটিতে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ কী কী ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং প্রতিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তার একটি শ্বেতপত্র তৈরি করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে উপস্থাপন করতে পারে। নানান তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশ এদিনটিকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মনে করিয়ে দিতে পারে যে, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের সৃষ্টি নয়, অথচ বাংলাদেশ এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। কিন্তু বাংলাদেশকে কেন একা এ চাপ বহন করতে হবে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে সবচেয়ে বড় দায়-দায়িত্ব আছে, সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য একটা মুখ্য দিন হচ্ছে ২৫ আগস্ট। আজ রোহিঙ্গা ঢলের তিন বছর পূর্তি। আমরা আশা করবো, রোহিঙ্গা ঢলের চার বছর পূর্তিতে কিছু উল্লেখযোগ্য এবং ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে, যা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানকে ত্বরান্বিত করবে। আমরা চাই, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে, এবং নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ইজ্জতের সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যাক।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।