একটি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধা নামধারী একটি সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যখন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বক্তব্য দেন, তখন কি ক্ষুব্ধ না হয়ে পারা যায়? প্রতিবাদ না করে পারা যায়? তাই আজকের এই লেখাটির পেছনে তীব্র ক্ষোভ আছে, আছে প্রতিবাদও। এই ক্ষোভ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার বিরুদ্ধে, এই প্রতিবাদ ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানকে অবমাননার বিরুদ্ধে।

সোমবার (২১ ডিসেম্বর ২০১৫) রাজধানীতে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বলেন, 'আজকে বলা হয়, এত লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত লাখ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নানা বই-কেতাবে নানারকম তথ্য আছে।'

লক্ষণীয় বিষয়, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার শাসনামলে কিন্তু এ নিয়ে নিজে থেকে কোনও প্রশ্ন তোলেননি। তিনি এখন এমন এক সময় এই প্রশ্নটি তুললেন, যখন পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যাকে অস্বীকার করছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করছে। বিএনপি নেত্রীর বক্তব্যে দেশজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। উল্টা প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের নামে আয়োজিত যে অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া এরকম বক্তব্য রাখলেন, সেখানে প্রকৃত কোনও মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন কি না।

একাত্তরে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের দেওয়া এই তথ্যটি সর্বজনগ্রাহ্য এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত। ইতিহাস বলছে, গণহত্যার সংখ্যা সবসময়ই প্রাপ্ততথ্য এবং পারিপার্শিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ধারণা করা হয়। এপ্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী জানান, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর জেনোসাইড স্কলার্স-এর সভাপতি ড্যানিয়েল ফেরস্টেইন বাংলাদেশ সফরকালে বলেছেন, 'বিশ্বের কোনও গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এটা ধারণাগতভাবেই নির্ধারণ করতে হয়।' বাংলাদেশে একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়ার ধারণাগত সংখ্যাটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনও সন্দেহ বা অবিশ্বাস না থাকলেও গণহত্যাকারী পাকিস্তান সব সময়ই এই তথ্য অস্বীকার করে এসেছে। খালেদা জিয়ার বক্তব্যেও আমরা শুনলাম পাকিস্তানের সুর। এর মাধ্যমে তিনি একাত্তরের গণহত্যাকে প্রকারান্তরে অস্বীকারই করলেন, শহীদের আত্মদানের অবমাননা করলেন। এ ধরনের বক্তব্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের ভয়ঙ্কর অপরাধকে খাটো করে দেখানোর সামিল। যেখানে দেশজুড়ে অসংখ্য গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে, আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে আরও অনেক, সেখানে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এ ধরনের বক্তব্য জাতির জন্য খুবই  দুর্ভাগ্যজনক। 

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক বিবৃতিতে মঙ্গলবার বলা হয়েছে, যেকোনও দেশে গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ‘সে দেশের সরকারের দাবি অনুযায়ী নির্ধারিত হয়’। বিবৃতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি গণহত্যায় নিহতের পরিসংখ্যানের উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়, 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি দাবি করে, হিটলারের নাৎসি বাহিনী ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করেছে। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় তাদের আইনজীবীরা এবং পরবর্তীকালে নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিশীলরা এই পরিসংখ্যান অস্বীকার করলেও ইতিহাসে ৬০ লাখ মানুষ নিহত হওয়ার সরকারি পরিসংখ্যানই বিবৃত হয়েছে।'

ইতিহাস বিকৃতি প্রতিহতকরণের উদ্দেশ্যে গণহত্যার ভিকটিম ইউরোপের ১৪টি দেশ ‘হলোকস্ট অস্বীকৃতি আইন’ প্রণয়ন করেছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। যে আইনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার পরিসংখ্যান অস্বীকার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই আদলে বাংলাদেশেও আইন করার দাবি জানিয়েছে নির্মূল কমিটি।

এতে সন্দেহ নেই যে, খালেদা জিয়ার আলোচিত বক্তব্যটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। এই বক্তব্য প্রমাণ করে আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপি যে ভাবেই হোক, কূটনৈতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মিত্র হিসেবে এবার পাকিস্তানকে পাশে চায়। না হলে যখন পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কসহ সব সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি উঠেছে, তখন বিএনপি নেত্রীর মুখ থেকে এই বক্তব্য কোনওভাবেই আসত না। এটা একেবারে সাদা চোখেই বলে দেওয়া যায়, পাকিস্তানকে পাশে নিয়ে এদেশে কোনও শুভ রাজনীতি হতে পারে না। নিজেরা যেখানে ব্যর্থ রাষ্ট্র সেখানে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত সামনে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের কল্যাণ চাইতে পারে না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে এটা অনুধাবন করতেই হবে, দলীয় রাজনীতির স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে কোনওভাবেই বিসর্জন দেওয়া যাবে না। আর যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই দেশ,  তাদের সব সময় রাখতে হবে মাথার ওপরে। কোনওভাবেই তাদের অবমাননা করা যাবে না। এটা দেশদ্রোহিতার শামিল।

লেখক:  কবি ও সাংবাদিক। নির্বাহী সম্পাদক দৈনিক সমকাল।   

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।