পেঁয়াজ যে আদা-রসুন-মরিচের মতো আম-মসলা নয়, তার যে রাজনৈতিক খুঁটির জোর কতদূর, এমনকি ছোট্ট চকচকে হালকা বেগুনি রঙের একটি পেঁয়াজ যে সরকার ফেলে দিতে পারে, তার প্রমাণ ভারত পেয়েছে কয়েকবার। শুধু কর্তা-গিন্নি নয়, ঘাগু রাজনীতিবিদদেরও নাকের জলে, চোখের জলে এক করে ছেড়েছে এই হতচ্ছাড়া পেঁয়াজ। দিল্লিতে তো অন্তত দুই দুই বার সরকার পতনের পেছনে এই পেঁয়াজের কারসাজিকেই দায়ী করছেন সবাই।
১৯৯৮ সালে সুষমা স্বরাজ যখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন পেঁয়াজের কেজি ৫০ রুপিতে পৌঁছেছিল, যেটা সেই সময়ের বিবেচনায় অনেক বেশি। তার কিছুদিন পরেই নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করে কংগ্রেস জিতে যায় এবং সুষমা স্বরাজকে হটিয়ে শিলা দিক্ষিত দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হন। তাতে অন্তত ভারতের রাজনীতিবিদরা টের পান পেঁয়াজের তেজ কাকে বলে। কারণ সেই নির্বাচনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছিল পেঁয়াজের দাম। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো এর ১৫ বছর পর ২০১৩ সালে শিলা দিক্ষিতকেও ঠেলে ফেলে দিয়েছিল ঝাঁজালো পেঁয়াজের উচ্চমূল্য। সে বছর পেঁয়াজের মূল্য সেই সময়ের সর্বোচ্চ ৮০ রুপিতে পৌঁছেছিল। ধারণা করা হয়, কংগ্রেসের পরাজয় আর অরবিন্দ কেজরিওয়াল-এর জয়ের পেছনে দুষ্টু পেঁয়াজের হাত আছে। এই কারণেই সম্ভবত ভারতের রাজনীতিতে পেয়াজকে সমীহ করে ‘ওনিয়ন বম্ব’ নামে ডাকা হয়।
ভারতে রাজনীতি করতে হলে পেঁয়াজ-তোষণ অনিবার্য, নচেৎ গদি হেলতে দুই মিনিট। এই যেমন ধরেন, গত বছরই ভারত পেঁয়াজ রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল পেঁয়াজের দাম ঠিক রাখতে, কারণ ওই সময় দুইটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানায় বিধান সভা নির্বাচন ছিল। এবারও ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে বিহারের বিধান সভা নির্বাচন। ভারতের রাজনীতির পেঁয়াজের নিবিড় গভীর প্রেমের কথা এত বিশদভাবে লেখার কারণ হলো বাংলাদেশে বহু বছর ধরে ভারত পেঁয়াজের একক রফতানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত। তাই ভারতে পেঁয়াজ চটলে তার অনিবার্য আঁচ এসে পড়ে আমাদের গায়ে।
দুই-একবারের ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে গত কয়েক বছর ধরে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এসেই পেঁয়াজের ‘দাবড়ানি’তে পড়ি আমরা। এই যেমন গত বছর ‘ফুড়ুৎ’ করে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিতে ‘বিশ্বরেকর্ড’ করে ফেললো বাংলাদেশ। যেখানে গত ২০১৮-১৯ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল গড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ, তখন বাংলাদেশে বেড়েছিল ৩৫২ শতাংশ। ৩৫২ শতাংশের হিসাব যখন হয়েছিল তখনও পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ১৭০ টাকা কেজিতে। এরপর পেঁয়াজকে আর পায় কে? তাকে আর ভুলেও পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি– লাফিয়ে লাফিয়ে ২৫০ টাকা কেজি পেরিয়ে পেঁয়াজ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০০-এর ঘরে। এ এমন এক বিশ্বরেকর্ড যা কোনোদিন বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনও দেশ ভাঙতে পারবে বলে মনে হয় না।
যে দেশে আকাশে বিমান উড়লে ছোট শিশুরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সেদেশে কিনা বিমানে চড়লো পেঁয়াজ। কোনও কালে কোনও মশলার এই সৌভাগ্য হয়েছে বলে জানা যায় না; কপাল বটে একখানা। গত বছর এই সংকট শুরু হয়েছিল ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিলে। অথচ ভারতের এই পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত কিন্তু হঠাৎ ছিল না। ভারতের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনকারী রাজ্য মহারাষ্ট্র বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছিল। এতে পেঁয়াজের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। এরপর পেঁয়াজের দাম যখন কোনও দিকে না তাকিয়ে কেবল বেড়েই চললো তখন মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানার নির্বাচনকে সামনে রেখে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়। আর ভারতের নির্বাচনের সঙ্গে পেঁয়াজের নিবিড় সম্পর্কের কথা কে না জানে। একটির দাম বাড়লে অন্যটির ভরাডুবি সুনিশ্চিত। সুতরাং পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করতে বাধ্য হলো ভারত।
কন্সাস কনজুমারস সোসাইটি নামের একটি সংগঠন গত বছর ২ নভেম্বর হিসাব করে দেখিয়েছিল মাত্র ৪ মাসে পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করে, অনেক কম দামে আমদানি করা পেঁয়াজ অনেক বেশি দামে বিক্রি করে জনগণের পকেট থেকে ৩১৭৯ কোটি টাকা লোপাট করেছিল (যখন পেঁয়াজের দাম ছিল ১৭০ টাকা)। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী যার ব্যর্থতা আর উদাসীনতার দায় সরকার কিছুতেই এড়াতে পারে না।
কেউ দেখে শেখে, কেউ শেখে ঠেকে। কিন্তু শেখার ইচ্ছাটা অন্তত থাকতে হয়, অন্ততপক্ষে শেখার প্রয়োজনীয়তাটা উপলব্ধি করতে হয়। আর সেই কারণেই গত ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ এক জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে ১৮ দিনের পেঁয়াজ কারসাজিতে অসাধুদের পকেট ভারি, লোপাট ৪২৪ কোটি টাকা। মাত্র ১৮ দিনে ৬ বার পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। অজুহাত আবারও সেই একই, ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করা।
বলা হচ্ছে, গত বছর পেঁয়াজের সরবরাহ ও মজুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার পরও অস্বাভাবিক গতিতে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। সে বছর কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করলেও কোনও ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া বাজার বিশেষজ্ঞরা পেঁয়াজের বাজারে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে সংকট তৈরির পেছনে মূলত সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করেছেন।
গত কয়েক বছরে এই বিষয়ে দুটি গবেষণা সংস্থা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর গবেষণায় উঠে এসেছে একই ধরনের চিত্র। একক দেশ হিসাবে ভারতের ওপর অতি নির্ভরশীলতা, সমন্বয়হীনতা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, মূল্য নিয়ন্ত্রণে তদারকির অভাব সহ আরও নানা দুর্বলতার কথা। একই কথার পুনারাবৃত্তি দেখা যায় বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে। বাজার তদারকির অভাব আর ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার প্রবণতাই পণ্যের মূল্যকে অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া বাজার বহুমুখীকরণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ অতি সহনশীল, আর একটা শ্রেণি পথে-বিপথে অতি ধনী। এই ধনিক শ্রেণির কাছে পেঁয়াজের কেজি ৫০ না ৫০০ টাকা সেটি কোনও গুরুত্ব বহন করে না। বিশ্বে অতি ধনী (সম্পদের পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকার ওপরে) বৃদ্ধির হারে প্রথম আর ধনী (সম্পদের পরিমাণ ৮ কোটি থেকে ২৫০ কোটি) বৃদ্ধির হারে তৃতীয় স্থানে থাকা দেশের মানুষের পেঁয়াজের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন হলে চলে না। আর দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ৪ কোটি মানুষের সেই আওয়াজ কোথায়, যা সরকারের কান পর্যন্ত পৌঁছতে পারে?
ভারতে পেঁয়াজ ‘অনিয়ন বম্ব’ হয়, সরকারের গদি উল্টে ফেলে, সেখানে তার দাপটই আলাদা। আমাদের এখানে এর ক্ষমতা বড় জোর পেঁয়াজবিহীন নতুন স্বাদের রান্না, সরকারের গতানুগতিক আশ্বাস, প্রতি বছরের একই সমন্বয়হীনতা আর কিছু লোকের ভাগ্য পরিবর্তন।
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য