‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজাকরোনাভাইরাস চলে যায়নি। আছে, এবং সদর্পেই আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছুদিন ধরেই সবাইকে সতর্ক করছেন। এই বাস্তবতায় এখন থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোয় কেউ মাস্ক ছাড়া গেলে তারা সেবা পাবেন না– এমন একটা নির্দেশনা এসেছে সরকারের দিক থেকে। সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে একথা জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের এই সিরিয়াসনেসকে স্বাগত জানাই। তবে প্রশ্ন হলো এই নির্দেশনা মানা হবে কতটা এবং এর তদারকি করা হবে কীভাবে? ঘরের বাইরে মাস্ক পরার বিষয়টি সরকারি নির্দেশনায় আগে থেকেই ছিল। কিন্তু বেশ অনেকদিন হয় মানুষের মধ্যে এই নিয়ম মানার ক্ষেত্রে শিথিলতা চলছে। মাত্রই শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব। উদ্যোক্তারা এবার প্রচারে কোনোরকম গুরুত্ব দেননি। বরং জাঁকজমককে অনেক কমিয়ে, অনুরোধ করছেন ভিড় না করতে। অন্য বছর ভিড়ের আহ্বান, এবার উল্টো। বারবার বলা হয়েছে দূরত্ব বিধি যথাসম্ভব মেনে চলার জন্য। মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কথাও বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। করোনার সুরক্ষা বিধি মেনে আয়োজনে অনেক কাটছাঁট ছিল। কিন্তু তবু উৎসবপ্রিয় বাঙালি মণ্ডপে গেছে। কোথাও কোথাও জনসমাগমের ঘনত্ব অনেক ছিল এবং খুব স্বাভাবিকভাবে অনেককেই দেখা গেছে মাস্ক না পরে ঘুরছে পূজার অনুষ্ঠানে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা তুলনামূলক কমে এলেও আসন্ন শীতকালে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ আসতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে চলেছেন। এ কারণে আগাম সতর্কতা হিসেবে নতুন করে এই নির্দেশনা এসেছে সরকারের দিক থেকে। মাস্ক না পরলে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও সেবা দেওয়া হবে না– এই যে নির্দেশনা, তার মধ্যে দিয়ে মূলত সরকারি বেসরকারি অফিস, হাট-বাজার, শপিং মল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও ধর্মীয় সম্মেলনে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সরকারের দিক থেকে সিরিয়াসনেস আনার চেষ্টা হলেও মানুষ মনে হচ্ছে করোনার কথা ভুলে গেছে। হাট, বাজার, রাস্তাঘাট, পরিবহন, অফিস আদালতে কোথাও করোনার আলাপ আর নেই। করোনা শুধু আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আমরা ভুলে গেছি ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা বছরের অর্ধেকটারও বেশি সময় দিন-রাত এক করে লড়ছেন, আমাদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। চিকিৎসকসহ অনেক স্বাস্থ্যকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকেই সংক্রমিত হয়েছেন। আমাদের সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও করোনায় নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, এখনও করছেন।
সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো দায়িত্ব পালনকারীদের একটু স্বস্তি দেওয়া। তাদের কম বিপদে ফেলা। আট মাসের নিষ্ঠায় তাদের নিশ্চয় এই সহমর্মিতা প্রাপ্য হয়েছে। আমরা হয়তো মনে রাখতে পারছি না আমাদের অসাবধানতা সবার ঘরে অন্ধকার নিয়ে আসতে পারে আবার। শিগগিরই অতিমারি কেটে যাবে না। আগামী দিনগুলোতেও যেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সুস্থ থেকে কাজ করে যেতে পারেন, তার জন্য সংযত থাকতে হবে আমাদেরই।
সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তার জন্য কড়াকড়ি তদারকি প্রয়োজন। বিভাগীয় কমিশনারদের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সব অফিসে এই নির্দেশনার কথা জানিয়ে বলা হয়েছে তারা যেন অফিসের বাইরে এ সংক্রান্ত পোস্টার টানিয়ে দেন। যেকোনও গণপরিবহনে উঠতে গেলে মাস্ক পরতে হবে, সরকারি বিভিন্ন অফিস, যেমন- ডিসি অফিস, ইউএনও, এসি ল্যান্ড কিংবা ব্যাংকের কোনও সেবা নিতে হলেও তাদের মাস্ক পরতে হবে।
নির্দেশনা তো এসেছে, কিন্তু মানুষ মানবে কতটা? না মানলে ব্যবস্থা কী? বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা থাকায় করোনার শুরুর দিকেই আমরা দেখেছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। একপর্যায়ে হালই ছেড়ে দিতে হলো।
করোনাভাইরাস একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। কিন্তু শুরু থেকেই যত পদক্ষেপ এসেছে সবই ছিল প্রশাসনিক। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলেছেন যে, জন সম্পৃক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে শুধু নির্দেশনা জারি করে কোনও লাভ হবে না।
সরকারি হিসেবেই করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়েছে। করোনা রুখতে তিনটি হাতিয়ার– জনসচেতনতা বৃদ্ধি, স্পষ্ট নির্দেশের সঙ্গে তথ্যের স্বচ্ছতা এবং দ্রুত পদক্ষেপ– কতটা হয়েছে সে নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। বিপদ তো রয়েছেই, এখন বলা হচ্ছে বড় করে এই শীতে আবার আসবে বিপদ। আমরা আর বলবো না টেস্ট কম না বেশি হয়েছে। আমরা ভ্যাকসিন নিয়েও ব্যাপক আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু শ্যাডো ভ্যাকসিন তথা মাস্কই যে রক্ষা দেবে, সেটাই যেন আলোচনা থেকে সরে গিয়েছিল। ভ্যাকসিনের আলোচনা এমন একপর্যায়ে গিয়েছিল যে মানুষ ভাবতে শুরু করলো- এসে যাচ্ছে টিকা, আর কিছু লাগবে না। তাই বাইরে বেরোলেই গলায় বা থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে রাখা কিংবা মাস্ক ছাড়াই অকুতোভয় হয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষের দেখা মিলছে শহরের পথঘাটে। নিয়ম করে নাক ও মুখ ঢেকে মাস্ক পরছেন না অনেকেই।  
মাস্কের ব্যাপারে জনসাধারণকে সন্দিহান করার পেছনে কার কী ভূমিকা সেই আলোচনাকে দূরে রেখে নতুন করে মাস্ক নির্দেশনা আমাদের কিছুটা হলেও আশাবাদী করে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনাটা যেন সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত হয়।

লেখক: সাংবাদিক