বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য এবং ওলামায়ে কেরাম

আনিস আলমগীরবঙ্গবন্ধুর অমরত্বকে রক্ষা করার জন্য ভাস্কর্যের প্রয়োজন নেই। কিন্তু একটি রাষ্ট্র যদি মনে করে তার জাতির পিতার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভের জন্য তার নান্দনিক একটি ভাস্কর্য থাকা দরকার, তখন সেটা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি কতটা যৌক্তিক—প্রশ্ন উঠতে পারে। রাজধানীর ধোলাইপাড় চত্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ ঠেকাতে গত কিছুদিন ধরে হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামি আন্দোলনসহ কয়েকটি ইসলামি দল আপত্তি করছে। রাস্তায় শক্তি প্রদর্শনও করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার করছে তাদের অনুসারীরা। আমিতো বরং আশা করেছিলাম সবাই মিলে আমরা আপত্তি করবো জাতির পিতার ভাস্কর্য পুরনো ঢাকার ধোলাইপাড়ে হবে কেন, সেটিতো হওয়া উচিত নতুন ঢাকার পূর্বাচল এলাকায়। পূর্বাচল শহর তৈরির সঙ্গে দ্রুত গতিতে গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধু সুদৃশ্য ভাস্কর্য, যা দেখতে যুগে যুগে দেশ বিদেশ থেকে পর্যটক ভিড় করবে।

ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়—এই নিয়ে অনেকে বুঝাচ্ছেন ওলামায়ে কেরামকে। আমার ধারণা ভাস্কর্য আর মূর্তি যে এক কাজে ন—এই কথাটি ইসলামি দলের নেতারা ভালো করেই জানেন। ভাষাগত দিক থেকে মূর্তি আর ভাস্কর্যের কোনও পার্থক্য না থাকলেও দেব-দেবীর মূর্তিকে পূজা করা হয় আর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মূর্তিকে পূজা করা হয় না—এটাও তারা ভালোভাবেই জানেন। জাতির স্মরণীয় বরণীয় বীরপুরুষদের মূর্তি বা ভাস্কর্য তৈরি করা হয় তাদেরকে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানাতে। আমার মনে পড়ছে, এর আগেও শেখ হাসিনার সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন তৈরি করতে গেলে মুফতি ফজলুল হক আমিনী, শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকসহ কওমি ঘরানার আলেম ওলামারা শোরগোল তুলেছিলেন। তখনও তারা জানতেন শিখা চিরন্তন অগ্নি পূজার জন্য করা হচ্ছে না। আর জাতিতো এত বছর ধরে দেখে আসছে শিখা চিরন্তনে কেউ পূজা করতে যায় না। বঙ্গবন্ধুর মূর্তি বা ভাস্কর্য বা স্ট্যাচু যেটাই বলি সেখানেও যে পূজা হবে না, তারা জানেন।

এই আলেম ওলামাদের উত্তরসূরিরা পাকিস্তান আমলে শহীদ মিনারকে, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে ইসলামবিরোধী বলেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতে আপত্তি করেছেন। তারা আরও যা যা আপত্তি করেছেন— সবটার সঙ্গে দ্বিমত করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস বলে স্বাধীনতা অর্জনে আলেম ওলামাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নগণ‌্য এবং বিভ্রান্তিকর। আলেম ওলামাদের সিংহভাগ হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিলেন আমি এ কথা বলবো না কিন্তু চোখ বন্ধ করে বলবো যে তাদের সিংহভাগ পাকিস্তানপন্থী ছিলেন এবং ভুল করেছেন। সুতরাং ১৯৭১ সালেই পাকিস্তানপন্থীদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি হবে সেক্যুলার। এখানে ভাস্কর্য থাকবে, মূর্তি থাকবে, রবীন্দ্র সঙ্গীত থাকবে, গজল থাকবে, জারি-সারি পালা গান থাকবে। নাটক-সিনেমা, যাত্রা থাকবে; ওয়াজও থাকবে। এখানে নামাজ থাকবে, পূজাও থাকবে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা–আরও যা যা উপাসনালয় দরকার সব থাকবে। আবার কোনও ধর্ম পালন না করার অধিকারও থাকবে।

বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক রাষ্ট্র থেকে ক্রমেই অর্থনৈতিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য লড়াই করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্ব আমাদের কারও কারও অপছন্দ হতে পারে কিন্তু বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান বলছে ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। আজ সেই দুই রাষ্ট্রের নাগরিকরা বাংলাদেশকে এখন ভিন্নচোখে দেখছে। পরবর্তী উদীয়মান ১১টি মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে স্থান করে নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের ভাবতে হবে ধর্মান্ধ কোনও রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্র ছাড়া জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার মানোন্নয়ন, শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি—কোনও কিছুর অগ্রগতি সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন না করলে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি রাষ্ট্রগুলো আমাদেরকে আজ ‘মিসকিন’ বলে যে অবজ্ঞা করে পশ্চিমা উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে যেভাবে সম্মান করে—সে ধারার পরিবর্তন হবে না। আমরা যখন স্বাধীনতা অর্জন করি পাকিস্তান ছিল উপমহাদেশের সবচেয়ে উন্নত রাষ্ট্র। আজ মৌলবাদের চক্করে পড়ে তারা তৃতীয় স্থানে। নরেদ্র মোদির শাসনে হিন্দু মৌলবাদের আস্ফালনে ভারতও চলছে পেছনের দিকে। বাংলাদেশকে আমরা ধর্মান্ধ-মৌলবাদী রাষ্ট্র বানালে পরিণতি কী হবে তার উদাহরণতো আমাদের সামনেই আছে।

এটা সত্য যে সমাজে ইসলামবিরোধী কিছু দেখলে ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে তার বিরোধিতা করা বা আপত্তি জানানো। কিন্তু ভাস্কর্য ইসলামবিরোধী কিনা এটা যেমন ইসলামে মীমাংসিত বিষয় না, তেমনি বাংলাদেশও ইসলামি রাষ্ট্র না যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী ট্যাগ দিয়ে ওলামায়ে কেরামরা রাষ্ট্রের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন। ওলামায়ে কেরামদের এটাও চিন্তা করা উচিত এটা আখেরী জামানা। এই জামানায় ভাস্কর্য না মূর্তি- এই বিতর্কের দরকার নেই। ইসলামে ভাস্কর্য আছে নাকি নেই—সেই বিতর্কেরও প্রয়োজন নেই। এই সময়ে ভাস্কর্যকে ইসলামি দৃষ্টিতে না দেখে আপনারা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখেন, বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি রাষ্ট্রকেও দেখেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কিনা সেটা দেখেন। বাংলাদেশ যেহেতু কোনও ইসলামিক রাষ্ট্র নয় সে কারণে ইসলামি আইন কানুন মেনে চলতে বাধ্য নয়। তাই ইসলামিক না অনৈসলামিক, এই নিয়ে বিতর্ক করতে গেলে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

আবার, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরাম যে আপত্তি করছেন সেটি যতটা না ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে করছেন, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক দৃষ্টিতে করছেন বললে কি ভুল হবে? ভাস্কর্যের আড়ালে তারা একটি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। হেফাজতে ইসলামের সভাপতি জুনায়েদ বাবুনগরী বলেছেন যারাই ভাস্কর্য সৃষ্টি করবে টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেওয়া হবে। এই বাবুনগরীর এবং হেফাজতের মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমির সমস্ত কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। এরা নিজেদেরকে অরাজনৈতিক এবং নিরপেক্ষ দাবি করলেও সেটা প্রমাণিত না। তারা যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কথা বলেন না। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য দেশে আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু তৈরি করেন, সেটা আমরা দেখেছি।

অনৈসলামিক কাজের বিরোধিতার নামে ‘শাপলা চত্বর’-এর ঘটনা তৈরি করে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টির সহযোগিতায় শেখ হাসিনার সরকারকে গদিচ্যুত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাও দেখেছি।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের একজন ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী অবস্থানের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, উচ্চ শিক্ষিত লোকদের দলে নিয়ে ইসলামি আদর্শের একটি বড় রাজনৈতিক দল গঠনের ফাঁকা মাঠ পেয়েছিল তার দলটি। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে এর একটু সম্ভাবনাও তারা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগটি ফেলে হঠাৎ এই দলটিও স্বাধীনতাবিরোধীদের পদাঙ্ক অনুসরণে নেমেছে।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের আরেকজন খেলাফত মজলিসের নেতা এবং হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেছেন, ‘আমাদের বক্তব্য ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে, কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নয়।’ ভাস্কর্য যেন বাংলাদেশে নতুন কিছু, বঙ্গবন্ধু বা অন্যান্য নেতার পূর্ণ এবং আবক্ষ মূর্তিও যেন দেশে এখন নেই! তার বাবা মরহুম শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকও দ্বিমুখী কাণ্ড করেছেন। সারা বছর নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন কিন্তু ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে ২৯ মিন্টু রোডে বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবনে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সে বৈঠকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ, জামায়াতের গোলাম আযমকে নিয়ে চার দলীয় জোটের ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা। খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে স্বৈরাচারী এরশাদ ও রাজাকার গোলাম আযমকে পাশে বসিয়ে ওই প্রথম তাদের জায়েজ করেন।

সেদিন সেই অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহের জন্য আমি উপস্থিত ছিলাম। আমার মনে আছে যে ছবি তোলার সময় শাইখুল হাদিস খুবই হাস্যকর পরিস্থিতির অবতারণা করেছিলেন। তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে বসেছেন সত্য কিন্তু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিলেন। শাইখুল হাদিসের আচরণ ছিল ‘নাচতে নেমে ঘোমটা দেওয়া’র মতো।

যা হোক, আমরা দীর্ঘদিন দেখেছি যে ওলামায়ে কেরাম নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা করেছেন। নারী নেতৃত্বকে হারাম বলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই সেটা মেনে নিয়ে রাজনীতি করেছেন। এখনও তারা সেটা মেনে নিয়ে রাজনীতি করছেন। নারী নেত্রীদের সঙ্গে মঞ্চে বসছেন। এখন নারী নেতৃত্ব এতটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে যে, এটাকে হারাম-হালাল বলার আর কোনও অবকাশ নেই। আমি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে দেখি। প্রশংসা করি। সেইসঙ্গে ভাস্কর্য হালাল-হারাম এই সমস্ত কথা বলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনও প্রয়োজন আছে বলেও আমি মনে করি না। ধর্মের সঙ্গে সংমিশ্রণ না করে নারী নেতৃত্বকে যেভাবে ওলামায়ে কেরাম স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছেন ভাস্কর্যকেও সেভাবে নিলে সবকিছু উত্তম হয়।

রাষ্ট্রের মূলনীতির সঙ্গে কারও দাবি অসঙ্গতিপূর্ণ হলে রাষ্ট্র তা নাও রাখতে পারে। তাই বলে মাদ্রাসা বা এতিমখানার কিশোর-তরুণদের, রাজনীতি-অবুঝ ছাত্রদের বিভ্রান্ত করে, বাধ্য করে রাজপথে এনে হুংকার দেওয়া ঠিক না। দ্বীনের খেদমত করতে হলে ওলামায়ে কেরামের উচিত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের যুগ উপযোগী শিক্ষা দেওয়া। এই শিক্ষার্থীরা আরবিতে কোরআন হাদিস শিখছে। মাতৃভাষা শিখছে। উর্দু ও ফার্সিকে প্রাধান্য না দিয়ে তাদেরকে ইংরেজির মতো আন্তর্জাতিক ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে শিখানো উচিত। তাদেরকে বিজ্ঞান শিখান, অংক শিখান, কারিগরি শিক্ষাও দেন। আর সবচেয়ে জরুরিভাবে অনুরোধ করবো– শিশু-কিশোরদের ওপর মাদ্রাসার শিক্ষক ও সিনিয়রদের দ্বারা যে অনাচার হচ্ছে তাকে কঠিন হস্তে দমন করার জন্য সম্মিলিত পদক্ষেপ নেন। কারও মূর্তি তৈরিতে ইসলাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, মাদ্রাসায় চলমান অনাচারে ওলামায়ে কেরাম চোখ বন্ধ করে রাখলে ইসলাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই অনাচারে লিপ্ত হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

anisalamgir@gmail.com