২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল। সে অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আমি লিখেছিলাম ‘পদ্মা সেতু: শেখ হাসিনার গোঁয়ার্তুমির প্রতীক’। পরদিন ১৩ ডিসেম্বর বাংলা ট্রিবিউনে তা ছাপাও হয়েছিল। এই পাঁচ বছর পরও আমি বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনার গোঁয়ার্তুমির কারণেই পদ্মা সেতু সকল দোলাচল, অনিশ্চয়তা, ষড়যন্ত্রের কুয়াশা ভেদ করে বাস্তব রূপ পাচ্ছে। নইলে বাস্তবতা নয়, পদ্মা সেতু হতে পারতো জাতির জন্য দুঃস্বপ্ন, কলঙ্কতিলক। কোনও টাকা ছাড় হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে শেখ হাসিনা ছাড়া বাকি সবাই ভেবেছিলেন, পদ্মা সেতু আপাতত হচ্ছে না। এমনকি তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত নিজেও বারবার বিশ্বব্যাংক-নির্ভরতার কথা বলছিলেন। আসলে আমাদের ভাবনাটাই ছিল পরনির্ভর, বিদেশনির্ভর। ছেলেবেলা থেকেই আমরা দেখে আসছি, বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্যনির্ভর। খাদ্যসহ সবকিছু আমদানি নির্ভর। দাতাসংস্থা ও পশ্চিমা দেশগুলোকে আমরা হুজুর হুজুর করে চলতাম। আগে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ মানেই ছিল ঝড়-ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস, দারিদ্র্য-মঙ্গা। কিন্তু আস্তে আস্তে আমরা বদলে যেতে থাকি। অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। আমদানির বদলে খাদ্য আমরা রফতানি করি। তৈরি পোশাক, রেমিট্যান্স, ইদানীং তথ্যপ্রযুক্তিও হয়ে উঠছে আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। দারিদ্র্য কমেছে, মঙ্গা শব্দটিই এখন ডিকশনারিতে ঠাঁই নিয়েছে। অর্থনীতির সব সূচকেই ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। দারুণ চমক দেখিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, স্যানিটেশন—নানা সূচকে রীতিমতো উদাহরণ মানা হয় বাংলাদেশকে। এমনকি করোনায় বিশ্ব অর্থনীতিই যেখানে বিশাল ধাক্কা খেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের ইতিবাচক অগ্রগতি বিস্ময়করই বটে। এমনকি গড় মাথাপিছু আয়ে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে ভারতকেও ঘাবড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
অনেকদিন খাঁচায় বন্দি পাখিকে ছেড়ে দিলেও সে যেতে চায় না। খাঁচার পাশেই ওড়াওড়ি করে। মুক্তিটা সে বিশ্বাসই করতে পারে না আসলে। অনেকদিন নতজানু হয়ে থাকলে মানুষের মেরুদণ্ডও বাঁকা হয়ে যায়। আমাদের অবস্থা হয়েছিল তেমনি। নানান ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতির পরও আমাদের মাইন্ডসেটে পরনির্ভরতা রয়েই গিয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টেক্কা পদ্মা সেতু করে ফেলা সম্ভব, এটা কেউ ভাবেননি। শুধু একজন ভেবেছিলেন—শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দিয়ে শেখ হাসিনা আমাদের সেই দীর্ঘ লালিত নতজানু মানসিকতায় প্রচণ্ড আঘাত করেন। আমরাও যে পারি সেটা বুঝিয়ে দিলেন। আসলে জমানা অনেক আগেই বদলে গেছে। আমরা টের পাইনি। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করে শেখ হাসিনা সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ বদলে গেছে। সবার টনক নাড়িয়ে দিলেন তিনি। অনেকে বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংককে চটানো যাবে না। নইলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিপদে পড়বে। কিন্তু সক্ষমতা এবং নৈতিক জোর থাকলে বিশ্বব্যাংককেও কাবু করা যায়। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ছেড়ে তো যায়ইনি, বরং এরপর বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের উচ্ছ্বাস আরও বেড়েছে। এখন এটাই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ছবি।
পদ্মা সেতু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেতু নয়, তবে অবশ্যই সবচেয়ে আলোচিত সেতু। পদ্মা সেতুই একমাত্র সেতু যার প্রতিটি স্প্যান বসানো খবর হয়েছে। পদ্মার বুকে ৪২টি খুঁটির ওপর ৪১টি স্প্যানে সংযুক্ত পদ্মার দুই পাড়, আসলে আমাদের স্বপ্ন। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যানটি। আজ ১০ ডিসেম্বর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর ৪১ নম্বর স্প্যানটি বসানোর পর মন ভরে তাকিয়ে দেখুন, একাকার হয়ে গেছে এপার ওপার।
বিশ্বব্যাংক তো ছিলই, ছিল নানামুখী ষড়যন্ত্র, গুজব। তারচেয়ে বড় কথা হলো বিশ্বের আর কোথাও পদ্মার মতো খরস্রোতা নদীর ওপর সেতু নেই। সেই অসম্ভব আজ সম্ভব হয়েছে। স্বপ্ন দেখতেও আসলে সাহস লাগে। শেখ হাসিনার সেই সাহস আছে, তিনি সেই সাহসীযাত্রায় সঙ্গী করেছেন গোটা জাতিকেই। ৬.১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো। এই সেতু হলে কাজের সুযোগ হবে ২ কোটি মানুষের। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, সেতুর কারণে সরাসরি উপকৃত হবে তিন কোটি মানুষ। আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি বলছে, দেশের অর্থনীতির আকার বা জিডিপি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ। প্রতি বছর দারিদ্র্য কমবে ১.৯ শতাংশ হারে। সেতু শুধু পদ্মার দুই পারকে সংযুক্তই করবে না, বদলেও দেবে। দুই পারে সিঙ্গাপুর আর চীনের সাংহাই নগরের আদলে আধুনিক শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে। গড়ে উঠবে আধুনিক মানের হোটেল রিসোর্ট, যা পর্যটনেও যোগ করবে নতুন মাত্রা। তাছাড়া এই সেতু দিয়েই বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে। পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাকে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করবে। অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চল একলাফে এগিয়ে যাবে অনেকদূর। স্থাপিত হবে শিল্প, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। আর শুধু অবহেলিত ২১ জেলা নয়, পদ্মা সেতু আসলে বদলে দেবে বাংলাদেশকেই।
তবে এতসব পরিসংখ্যান নয়, আমার কাছে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব অন্য জায়গায়। বিশ্বব্যাংকের টাকায় হলে হয়তো এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম। কিন্তু পদ্মা সেতু আমার কাছে নিছক একটি সেতু নয়। পদ্মা সেতু আমাদের সক্ষমতার প্রতীক, স্বাবলম্বিতার প্রতীক। অনেক সময় টাকা থাকলেও অনেক কিছু করা যায় না, মানসিকতা আটকে রাখে। পদ্মা সেতু আমাদের সেই পরাধীনতার, ভৃত্য মানসিকতার অর্গল থেকে মুক্তি দেবে। বিশ্বের সবাই দেখেছে, বিশ্বব্যাংককে মুখের ওপর না করে দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করতে পারছি। বাংলাদেশে মানে এখন ঝড়-ঝঞ্জা-জলোচ্ছ্বাস-দারিদ্র্য-মঙ্গা নয়। বাংলাদেশ এখন সম্ভাবনার নাম। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ইতিহাসে পদ্মা সেতুর আগে এবং পরে- এইভাবে ভাগ হবে। পদ্মা সেতুর পরের বাংলাদেশ সম্ভাবনার, সক্ষমতার দাপুটে বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে ভেবেই কবি লিখেছিলেন, জ্বলে পুড়ে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।
অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত। সবকিছুতে আমরা আওয়ামী লীগ-বিএনপি খুঁজি। কিন্তু পদ্মা সেতুকে আমি রাজনীতির বাইরেই রাখতে চাই। দয়া করে কেউ পদ্মা সেতুর সঙ্গেগণতন্ত্রহীনতা, মতপ্রকাশে বাধা, বিরোধী দলকে দমন ইত্যাদিকে মেলাবেন না। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে টিকে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ