পরে তিনি টুইটার বার্তায় লিখেন দুপুরে তিনি লাহোরে নওয়াজ শরীফের সঙ্গে দেখা করতে মরিয়া। দিল্লি যাওয়ার পথে তিনি লাহোরে নামবেন। নাওয়াজ শরীফের সঙ্গে তার বাড়িতে নরেন্দ্র মোদির দেখা হলো, কথা হলো। নওয়াজ শরীফ লাহোরে তার পৈতৃক বাড়িতে তার নাতির বিয়ে উপলক্ষে অবস্থান করছিলেন। বৈঠকটা এত তাড়াহুড়ার মাঝে অনুষ্ঠিত হলো যে ইসলামাবাদ থেকে পাকিস্তানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা এসে বৈঠকে অংশ নিতে পারেননি। নরেন্দ্র মোদি গিয়েছিলেন রাশিয়া। সেখানে তিনি পুতিনের সঙ্গে ৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেছেন। আসার পথে তিনি কাবুলে গিয়েছিলেন আফগানিস্তানের সংসদ ভবন উদ্বোধন করার জন্য। এ ভবনটা নির্মাণের সম্পূর্ণ অর্থের জোগান দিয়েছিলো ভারত।
তিনটি এম-আই ২৫ হেলিকপ্টারও হস্তান্তর করেছেন। হেলিকপ্টারগুলো সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণে সক্ষম। নরেন্দ্র মোদি আফগান সামরিক বাহিনীর শহীদ পরিবারের ৫০০ সদস্যকে বৃত্তিও প্রদান করেছেন। জহির শাহার সময় থেকে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুবই চমৎকার ছিল, এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তান কিন্তু এ সম্পর্কটা কখনও পছন্দ করেনি। ভারতের আর বাংলাদেশের কারণেই আফগানিস্তান সার্ক এ স্থান পেয়েছে অবশ্য তাতে পাকিস্তানের প্রকাশ্য অসম্মতিও ছিল না। বরং ঘটনা যখন অনিবার্য তখন পাকিস্তান আগ বাড়িয়ে আফগানিস্তানের নাম প্রস্তাব করে। আমেরিকা তার আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি সীমিত করে ফেলার পর থেকে ভারত আফগানিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করে। আফগানিস্তানের তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের আইএসআই-এর সম্পর্ক ভালই বলে মনে হয়। বর্তমান আফগানিস্তান সরকারের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হলো তালেবানে আফগান।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকেই ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভাল নয়। উভয় পক্ষের মাঝে তিনবার যুদ্ধ হয়েছে। কাশ্মির নিয়ে ১৯৪৭ সালে, ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নিয়ে ১৯৭১ সালে দুই দেশ যুদ্ধ করেছে। ছোট খাট যুদ্ধতো লেগেই আছে। আবার যুদ্ধ শেষে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু উভয়ের মাঝে ক্যানসারের মতো কাশ্মীর সমস্যাটা থাকার কারণে কখনও শান্তিপূর্ণ বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভব হয়নি।
পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বাইরে গিয়ে তাদের পক্ষে কোনও কিছু করা সম্ভব নয়। ভারতে অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নওয়াজ শরীফ। উভয়ের মাঝে ব্যাপক একটা বোঝাপড়া হয়েছিলো, সম্পর্কেরও উন্নতি হয়েছিলো। বাসে চড়ে বাজপেয়ী লাহোর গিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তা কখনও পছন্দ করেনি। যে কারণে নওয়াজকে উৎখাত করে জেনারেল মোশারফ ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং নওয়াজ শরীফকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ নয় বছর নওয়াজ শরীফ সৌদি আরবে নির্বাসিত ছিলেন। নেওয়াজ শরীফ এখন স্বেচ্ছায় ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের কোনও উদ্যোগ নেবেন বলে মনে হয় না।
১৯৬০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু যখন সিন্ধু নদীর পানি বন্টন চুক্তি সম্পাদনের জন্য করাচি গিয়েছিলেন। তখন পাকিস্তানের রাজধানী ছিল করাচি। পানি চুক্তি সম্পাদনের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান নেহরুকে পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে জয়েন্ট ডিফেন্স এর প্রস্তাব করেছিলেন। আইয়ুব খানের দেওয়া এই শান্তি স্থাপনের প্রস্তাবকে নেহরু কেন উপেক্ষা করেছিলেন জানি না। অথচ সে প্রস্তাব আর কখনও কেউ সাহস করে দেবেন বলে আশা করা যায় না। নেহরু জয়েন্ট ডিফেন্স-এর প্রস্তাব মেনে নিলে হয়তোবা অনেক সমস্যার অস্থিত্বই আজ থাকতো না।
আইয়ুব খান ছিলেন সামরিক বাহিনীর লোক। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লৌহ মানব। তার ওপর কথা বলার জন্য পাকিস্তান আর্মিতে কেউ ছিল না। নেহরু জয়েন্ট ডিফেন্স এর প্রস্তাব না মেনে সমস্যাগুলোকে স্থায়ী করে রেখে গেলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে জয়েন্ট ডিফেন্স হলে চীন ১৯৬২ সালে ভারত আক্রমণের সাহস পেত কিনা সন্দেহ ছিলো। জেনারেল আইয়ুব খান, জেনারেল আকবর খান, জেনারেল কারিয়াপ্পা, জেনারেল জে.এন. চৌধুরী- ভারতীয় ব্রিটিশ আর্মিতে এরাই ছিলেন উচ্চপদস্থ অফিসার। তাদের মাঝে মিল মহব্বত ছিলো। হয়ত জয়েন্ট ডিফেন্স সফলই হতো।
নরেন্দ্র মোদি সার্কভুক্ত দেশগুলোর সরকার প্রধানদের তার শপথ অনুষ্ঠানে গত বছর দাওয়াত দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া সবাই উপস্থিত ছিলেন। নওয়াজ শরীফও গিয়েছিলেন। উভয় দেশের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তও হয়েছিলো। কিন্তু পাকিস্তানের দিল্লিস্থ হাই কমিশনার কাশ্মীরের হুররিয়াৎ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করে ছিলো বলে শেষপর্যন্ত আলোচনার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। কিন্তু কয়েকদিন আগে নরেন্দ্র মোদি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুশমা স্বরাজকে পাকিস্তান পাঠিয়েছিলেন আলোচনা আরম্ভ করার জন্য। সুষমা স্বরাজ পাকিস্তান থেকে ফিরে যাওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি গেলেন রাশিয়া সফরে। সেখান থেকে কাবুল হয়ে আসার পথে তিনি আচমকা সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তান সফরের এবং নওয়াজ শরীফের সঙ্গে এক ঘণ্টা আলোচনা করে লাহোর সফর শেষে দিল্লী ফিরে গেলেন। এ সিদ্ধান্তের পেছনে নরেন্দ্র মোদি কোনও মতলব কার্যকরী ছিল কি-না তা নিয়ে এখন পর্যালোচনা চলছে।
ভারতে নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা দ্রুত পতনমূখ। কারণ তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তার অনেক কিছুই পূরণ করতে পারেননি। উপরন্তু সংঘ পরিবার নানাহ্ অহেতুক সাম্প্রদায়িক ইস্যু সৃষ্টি করে ভারতীয় বহুত্ববাদী সমাজের সৌন্দর্য্য ও ঐক্য বিনষ্ট করছে। তাতে মোদি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। অনেকে বলছেন ২৫ ডিসেম্বর থেকে তিনি তার নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে নিজস্ব চক আঁকা পথেই চলবেন। সংঘ পরিবারসহ সবাইকে এ বার্তাই তিনি দিলেন।
অপরপক্ষে আন্তর্জাতিক পরিসরে, বিশেষ করে আমেরিকা মনে করে দু’টি আনবিক শক্তির অধিকারী দেশ দীর্ঘ সময়ব্যাপী বৈরিতার মাঝে অবস্থান করা ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং তাদের মাঝে আলোচনা হওয়া উচিত। মোদির সফর সে প্রত্যাশার প্রতিও একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। ভ্লাদিমির পুতিন ন্যাটোর পাল্টা জোট গঠনের একটা তলে তলে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তার সম্ভাব্য সদস্য হবে- রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান এবং ইরান। সুতরাং এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ভারতের ভূমিকা কি হবে! সেটাই স্থির করার জন্য সবার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন মনে করেই মোদি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন বলে মনে করেন অনেকে। অবস্থা যাই হোক ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া খুবই কঠিন। সুতরাং মোদির পাকিস্তান সফরে কারও প্রত্যাশা সীমা ছাড়া হওয়া উচিত নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
anisalamgir@gmail.com
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।