নতুন বিশ্ববিদ্যালয় মানেই একটি নতুন প্রকল্প

রুমিন ফারহানাগত বেশ কয়েকটি সংসদ অধিবেশনের প্রায় সবকটিতে এক বা একাধিক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিল এসেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হতে পারে এই সরকার দেশের উচ্চশিক্ষা প্রসারে অসাধারণ কাজ করছে। কিন্তু বিষয়টি কি এমন? নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় মানেই কি শিক্ষার প্রসার? সার্বিকভাবে শিক্ষার মান, কর্মসংস্থান তৈরিতে তার ভূমিকা, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অভিঘাত মোকাবিলায় এর কার্যকারিতা এই সব কিছু বিবেচনায় নিলে বর্তমান উচ্চশিক্ষার উপযোগিতার বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়।

এই কলামের মূল আলোচনার বিষয়ে প্রবেশ করার আগে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আইনগুলো নিয়ে কয়েকটি কথা। নতুন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে নতুন নতুন আইন তৈরি করে। এই দেশের প্রথম চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং জাহাঙ্গীরনগর চলে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে যাতে এই  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন আছে। বর্তমান সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন পুরোপুরি নষ্ট করলেও সরকারের সেই কাজগুলোকে বেআইনি বলার সুযোগ আমাদের সামনে আছে, এমন কি চাইলে বিষয়টি  নিয়ে আদালত পর্যন্ত যাওয়া যায়। কিন্তু নতুন যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় এরপর থেকে হয়েছে সবগুলো আলাদা আইনে হচ্ছে, যাতে এগুলোর ওপর পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। এর ফল যা হয়েছে তা হলো এগুলো তাদের পাবলিক/রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চরিত্র থেকে সরে এসে অনেকটাই সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।   

ফলে, বর্তমানে প্রশাসনগতভাবে দেশে দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় আছে; একটি হলো অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত কিছুটা হলেও স্বায়্ত্বশাসন বজায় রাখা বিশ্ববিদ্যালয় আর অপরটি হলো নির্দিষ্ট আইনের অধীন পরিচালিত সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো সরকার যদি মনে করে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সরকারের জন্য ভালো হবে তবে ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ বাতিল করে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে এক একটি আইনের অধীনে আনাই কি সরকারের জন্য যুক্তিযুক্ত ছিল না? আর যদি সেই অধ্যাদেশের অধীনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়্গুলো ভালো চলে থাকে তাহলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন নতুন আইন না করে সেগুলোকেও কেন উক্ত অধ্যাদেশ সংশোধন করে তার অধীনে পরিচালনা করা হচ্ছে না?  

এদিকে একের পর এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় এমন সময় স্থাপন করা হচ্ছে যখন দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান একেবারে তলানিতে। এই দেশে বেকার সমস্যার নানা কারণের মধ্যে খুব উল্লেখযোগ্য একটি কারণ হচ্ছে গ্র্যাজুয়েটদের নিম্নমান। এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করে বেরোনো গ্রাজুয়েটরা যথেষ্ট যোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না বলেই এই দেশের অনেক ব্যবসা-মালিককে বলতে শোনা যায়, ভালো বেতনের অফার থাকলেও তারা অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট যোগ্য গ্র্যাজুয়েটের অভাবে বাংলাদেশিদের চাকরি দিতে পারেন না। এখন এই তথ্য আমরা অনেকেই জানি, দেশের বেশ কিছু সেক্টরের মধ্য থেকে উচ্চ পর্যায়ের চাকরিতে উচ্চ বেতনে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কয়েক লক্ষ কর্মী কাজ করছে যারা প্রতিবছর এই দেশ থেকে ব্যাংকিং এবং নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার তাদের দেশে নিয়ে যায়।

যে দেশ ন্যূনতম মানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারে না, সেই দেশের ভুলে যাবারই কথা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান বিতরণের জায়গা না, জ্ঞান তৈরি করার‌ও জায়গা। এই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬৯ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে গবেষণা খাতে বরাদ্দ মাত্র ৪০ কোটি টাকা। আবার এই টাকাও নাকি তারা পুরো খরচ করতে পারে না। বৈশ্বিক পর্যায়ে দূরে থাকুক আঞ্চলিক পর্যায়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তেমন কোনও সাফল্য নেই বলেই এই দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যকে ১০ টাকায় ‘চা-চপ-সিঙ্গারা এবং সমুচা’ পাওয়া নিয়ে গর্ব করতে হয়।

কিছুদিন আগে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশন যৌথভাবে ২০২০ সালের গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স (জিকেআই) প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২তম। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই সূচকে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান এমনকি পাকিস্তানও আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। 

সূচকটি তৈরিতে শিক্ষা, প্রযুক্তি, উন্নয়ন, উদ্ভাবনসহ সাতটি বিষয়কে বিবেচনা করা হয়েছে। এটি সাতটি সেক্টরের অধীনে ১৩৩টি চলকের (ভেরিয়েবল) ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এগুলো হলো প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সহায়ক পরিবেশ। 

বাংলাদেশ প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা সেক্টরে ৪৩ দশমিক ৯ স্কোর পেয়েছে। প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বাংলাদেশের স্কোর ৪৯। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা সেক্টরে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নাজুক, এই সেক্টরে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ২৪ দশমিক ১। এ ছাড়া গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন খাতে বাংলাদেশের স্কোর ১৬ দশমিক ৪, আইসিটি সেক্টরে স্কোর ৪৩ দশমিক ১, অর্থনীতি সেক্টরে বাংলাদেশের স্কোর ৩১ দশমিক ৫ এবং সাধারণ সহায়ক পরিবেশ ৪৬ দশমিক ৪।

টাইমস হায়ার এডুকেশনের সর্বশেষ র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার এক নির্মম প্রতিফলন ঘটেছে। বিশ্বের সেরা ১ হাজার ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আছে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। অথচ এই তালিকায় ভারতের ৫৬টি, পাকিস্তানের ১৪টি, মালয়েশিয়ার ১৩টি, শ্রীলঙ্কার ২টি ও নেপালের ১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আছে। কষ্ট হয় যখন দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১ হাজারের বাইরে, কিন্তু নানা কারণে সমালোচিত দেশ পাকিস্তানের ৭টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে এই ১ হাজারের মধ্যেই। এর মধ্যে কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৪০০ থেকে ৫০০ এর মধ্যে। 

দেশে কর্মক্ষেত্রের প্রকৃত চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে সরকার বেকার তৈরি করছে শুধু। আর এতে জনগণের টাকার অপচয় হচ্ছে। খুব বড় সমস্যা দাঁড়িয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার জন্য অনেকগুলো বছর পার করার পর নতুন করে অনেকের পক্ষে একেবারে ভিন্ন কোনও সেক্টরে নতুন করে দক্ষ হয়ে ওঠা খুব কঠিন হয়ে ওঠে। এদিকে আমাদের সমাজের ধরনের স্টেরিওটাইপ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়া একজন ছাত্র ডেস্ক জবের বাইরে কিছু ভাবতে পারে না। একারণেই প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে আমরা পত্রিকায় দেখি সেই পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা আগের বারের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এভাবে বছরের পর পর সরকারি চাকরির মহে পড়ে দেশের যুব শক্তির এক বিরাট অপচয় আমাদের নীতি নির্ধারকদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। 

সার্বিক বিচারে দেশকে খুব দ্রুত কারিগরি শিক্ষার পথে নিয়ে যেতেই হবে। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী মাঝে মাঝে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বের কথা বললেও সেটার ব্যাপারে অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর। বর্তমান বাংলাদেশে মাত্র ১৫ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে। আমরা অনেকেই খবর রাখি না এই ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পরিস্থিতি কী। অর্গানাইজেশন ফর ইকনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এর দেশগুলো হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত। এই দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষার অনুপাত ৫০ থেকে ৭০ পর্যন্ত। এসব দেশের এই অবস্থা বিরাজ করছে অতি দীর্ঘ সময় থেকে। ভেবে আমার খুব অবাক লাগে এই অতি সহজলভ্য তথ্য কি আমরা জানতাম না? না জেনে থাকলে এই অজ্ঞতা ক্ষমাহীন। আর জেনে থাকলে দশকের পর দশক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে আসা এক বীভৎস অপরাধেরই নামান্তর। 

উপরের আলোচনার সাথে আমরা যদি একমত হই, তাহলে ভবিষ্যতে আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয় না বাড়িয়ে সেই বাজেটে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়ন করাই কি সরকারের জন্য যুক্তিযুক্ত না? একই সাথে ভবিষ্যতে দ্রুত নতুন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি এবং যেসব নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়ে গেছে সেগুলোকে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কথা সরকার কেন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে না?

বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়ন করতে গেলে যেসব ক্ষেত্রে (যেমন – শিক্ষক নিয়োগ-প্রশিক্ষণ, গবেষণায় ব্যয় বরাদ্দ) সরকারকে ব্যয় করতে হবে সেসব যাবে রাজস্ব খাতে, অর্থাৎ এতে দুর্নীতির সুযোগ নেই। নতুন নতুন আইন করে একটির পর একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন আনতে না পারলেও কেন একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছে – উপরের তথ্যটি তার একটা ব্যাখ্যা দিতে পারে।

হ্যাঁ, এক একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন মানেই এক একটা নতুন প্রকল্প আর এই দেশে নতুন প্রকল্প মানে হচ্ছে হাজার কোটি টাকা নয়-ছয়ের নতুন সুযোগ। প্রকল্পে কত টাকার জিনিস কত টাকায় কেনা হয় সেগুলো কিছুদিন আগেও জনগণের মুখে মুখে ফিরত। এখন আর সেটা হয় না কারণ তারা জানে এই সরকারের প্রকল্প মানেই এসব চলবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে নীতি এবং প্রকল্পের এসব দুর্নীতি আরও অনেক দুর্নীতির চাইতে অনেক দিক থেকে আলাদা। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রভাব হয় অনেক বেশি দীর্ঘমেয়াদি। সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে যে মানুষটি হয়ে উঠতে পারত রাষ্ট্রের সম্পদ, ভুল এবং মানহীন শিক্ষার মাধ্যমে সেই হয়ে উঠে রাষ্ট্রের দায়। শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে নয়-ছয় বাংলাদেশে ঠিক তখন ঘটছে যখন আমরা পার হচ্ছি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রাচুর্যের (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) এর সময়। সবশেষ এবং ভয়ঙ্করতম হতাশাটি হচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটি জাতির ইতিহাসে কেবলমাত্র একবারই আসে।    

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য