নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর বিতর্ক

আনিস আলমগীর
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিবৃতি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। ২১ মার্চ ২০২১, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বিবৃতিতে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিরোধিতাকারীদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। মোদির যা ইমেজ তাতে তার বাংলাদেশ সফর নিয়ে কারও কারও আপত্তি থাকতেই পারে, তাই বলে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি কতটা হটকারী কথাবার্তা ইনু ভালো জানেন বলে আমার বিশ্বাস।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি মোদির ঢাকা সফর নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। মোদির জায়গায় অন্য কেউ হলে তিনিও আমন্ত্রণ পেতেন। পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের যে উৎসবে তিনি আসছেন সেখানে ভারতের অবদান রয়েছে। তবে ভালো হতো যদি আজ ইন্দিরা গান্ধী বা জ্যোতি বসুর মতো অসাম্প্রদায়িক কেউ ভারতের ক্ষমতায় থাকতেন। তারা যেহেতু নেই, করার কী আছে! তাই বলে বাংলাদেশ তো তার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইন্দিরার অবদান ভুলে যায়নি বা বন্ধুরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণের বাইরে রাখতে পারে না।

আরও ভালো হতো যদি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন থাকতেন। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন পাশে না থাকলে আমরা ভারতকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আগ্রাসী সমর্থনের জন্য পেতাম না। কিন্তু করোনার লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতিতে পুতিনকে কাছে পাওয়া সহজ নিশ্চয়ই নয়। নরেন্দ্র মোদি আসছেন এবং করোনার মধ্যে এটাই তার প্রথম বিদেশ সফর। তাতে তাকে অভিনন্দন জানাতে দ্বিধা কেন!

প্রতিবেশীর ঘটনা সবার বেশি আকৃষ্ট করে। মনে থাকে। নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে সত্য। ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই প্রমাণিত যে তিনি একজন সাম্প্রদায়িক নেতা। গুজরাট দাঙ্গার জন্য বিশেষ খেতাব পেয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ায়। মোদির শাসনামলে ভারতের সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত। তার দল প্রকাশ্যে মুসলিমদের সঙ্গে বৈষম্য করছে। তাদের নাগরিকত্বহীন করার চেষ্টা করছে। অনেক মানবাধিকার সংস্থা এখন জোরেশোরেই ভারতকে নির্বাচিত স্বৈরাচার আখ্যা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতকে এখন পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। দেশে-বিদেশে সর্বত্র মোদির কারণে ভারতের ইমেজ সংকটের মধ্যে।

দ্বিতীয়ত, মোদির ঢাকা সফর পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের আগে হিন্দুত্ববাদীদের মনোবল চাঙা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার চেষ্টা হচ্ছে। সফরকালে তিনি দুটি মন্দির পরিদর্শনে যাবেন, তার মধ্যে গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি মন্দিরটি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো এবং পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মীয় কারণে তিনি মন্দির পরিদর্শন করলে ঢাকেশ্বরী যেতেন, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যেতেন। নরেন্দ্র মোদি যেদিন ওড়াকান্দি সফর করছেন (২৭ মার্চ) সেদিনই পশ্চিমবঙ্গে আট পর্বের বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কয়েকটি বাম এবং ইসলামি দলের পক্ষ থেকে যদি নরেন্দ্র মোদির নিমন্ত্রণ বাতিল করার দাবি ওঠে, সেটা রাজনৈতিক দলের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। যারা এই দাবি করছেন তাদের অনেক বাম নেতা হাসানুল হক ইনুর প্রাক্তন কমরেড। আজ চিন্তাধারায় পরিবর্তন এসেছে বলে তিনি তাদের আইনের আওতায় আনতে বলা অগণতান্ত্রিক। নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনও রাজনৈতিক দলের মোদির সফরের বিরোধিতাকে আমি খারাপভাবে দেখি না।

আমি মোদির সফরে বড় উৎপাত হিসেবে দেখি হেফাজতে ইসলামকে। কারণ, তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে ২৮ হাজার কওমি মাদ্রাসা। গত বছর যখন মোদির ঢাকা আগমনের কথা উঠেছিল, মোদির রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ বাতিলের দাবি জানিয়ে হেফাজত নেতা আল্লামা শফী বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মুজিববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশের জনগণ দেখতে চায় না। মোদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে গুজরাট, কাশ্মির ও দিল্লিসহ অনেক রাজ্যের মুসলমানদের খুন করা হয়েছে। চরম নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়েছে। তাই যার হাতে এখনও মুসলিম গণহত্যার দাগ লেগে আছে, তার উপস্থিতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না।’

হেফাজত এবারও মোদির ঢাকা সফরের বিরোধিতা করছে। কিন্তু যারা মোদির সফরের বিরোধিতা করছে তাদের বোঝা উচিত, ভারত বড় দেশ, আমাদের সুখে-দুখের সঙ্গী, মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার। তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া নিমন্ত্রণ বাতিল করা অসৌজন্যতা। আগেই বলেছি বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদিকে নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এই দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। ভারত কেন, ক্ষুদ্র কোনও দেশের সরকার প্রধানকেও নিমন্ত্রণ জানিয়ে তা বাতিল করা অভদ্রতা। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বিরুদ্ধ কাজ।

তবে একটি অপ্রিয় সত্য কথা বলে লেখা শেষ করতে চাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আসছেন। দুই দেশের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের, বিশেষ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী নারী ইন্দিরা গান্ধীর অবদানকে ভুলে যায়নি। এটা তার নিদর্শন। বাংলাদেশ ভুলে যায়নি ভারতের সাধারণ মানুষের সহযোগিতার কথাও, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, বিহারের জনগণ লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি শরণার্থীকে আশ্রয়দানের কথা কখনও ভুলবে না। ভুলেনি ইস্টার্ন ফ্রন্টে যে ক’জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে তাদের আত্মত্যাগের কথাও।

কিন্তু ইতিহাসের স্বার্থে ইতিহাস শুধু এসব তথ্য দিয়েই রচিত হয় না। আরও কিছু কথা থাকে, যা সৌজন্যের খাতিরে কোনও কৃতজ্ঞ রাষ্ট্র বলে না। স্বাধীনতা উপহার দিয়েছি বলা আর কথায় কথায় তার জন্য খোঁটা দিলে ভারতের নিজের স্ট্র্যাটেজিক্যাল স্বার্থে স্বাধীন বাংলাদেশ কতটা দরকার ছিল- সেই প্রশ্নও জোরেশোরে উঠে আসবে।

ভারতীয় মিডিয়া আর তাদের কিছু নেতা এমন কথাবার্তা বলেন, যাতে বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। তাদের প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর একবার বলে বসলেন, ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে যদি স্বাধীনতা উপহার দিয়ে থাকে তবে বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ শহীদ আত্মত্যাগ করেছিলেন কেন! কেন মা-বোনদের ইজ্জত দিতে হয়েছে! পাকিস্তানিরা তাদের নতুন প্রজন্মকে ‘ভারত ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানকে ভেঙেছে’ বলে যে ইতিহাস পড়ায় - সেটাই কি সত্য প্রমাণ করতে চান এই মনোহর পারিকররা?
বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পালনকালে ভারতীয় মিডিয়া আর নেতাদের এটা মনে রাখা দরকার যে, সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হলে পরস্পরের আত্মমর্যাদাকে সম্মান করতে হবে। হিস্যা আদায় করতে হবে। নতুবা এমন সম্পর্কের ১০০ বছর পার হলেও তা লোক দেখানোতে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং মোদির মতো নেতাদের সফরে স্বাগত জানানোর পরিবর্তে বিতর্ক উঠবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

anisalamgir@gmail.com