হেফাজতি তাণ্ডব, নেপথ্যে জামায়াত-শিবির

আনিস আলমগীর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে আক্রমণ করছে ৬ যুবক। খুনতি দিয়ে, কুড়াল দিয়ে ম্যুরালটা নষ্ট করছে তারা। বেশভূষায় মনে হচ্ছে তারা মাদ্রাসায় পড়ুয়া তরুণ। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা আগমনের প্রতিবাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির কী সম্পর্ক– আমার মাথায় আসে না! আমি অবাক হয়ে ভিডিও দেখি। তাহলে কি ধরে নেবো বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে, স্বাধীনতা দিবসের দিনে, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে হায়েনাদের এই প্রতিনিধিরা?

নরেন্দ্র মোদি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেছেন, এটি প্রতিবাদ করার কিছুই নেই। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এসেছেন, হিন্দুত্ববাদী বিজেপির প্রতিনিধি না। তার জায়গায় অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকলে তিনি আসতেন। সিম্পল। ধরে নিলাম তাকে কারও পছন্দ না। হতেই পারে। তার প্রতিবাদও করা যায়। কিন্তু সেটা হওয়া তো উচিত নিয়মতান্ত্রিকভাবে। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক!

আর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা দেওয়াটা প্রশাসনেরও উচিত না। কিন্তু আমরা কী দেখলাম! একদল নরেন্দ্র মোদির কুশপুত্তলিকা দাহ করতে চাচ্ছে বলে সেটি ছিনতাই করছে আরেক দল এবং প্রতিবাদকারীদের পেটাতে পেটাতে নিজের জামা-কাপড় খুলে যাচ্ছে সেদিকে হুঁশ নেই তাদের। আবার এই হেফাজতি দল নরেন্দ্র মোদির ওপর ক্ষোভ মেটাচ্ছে জাতির জনকের ম্যুরালে আগুন দিয়ে, ভাংচুর করে।

এরা একদল শুক্রবারে জাতীয় মসজিদে নামাজের নাম করে ঢুকে ইটপাটকেল মারছে পুলিশকে, মসজিদকে করেছে রণাঙ্গন। তাদের পাল্টা ধোলাই দিতে নেমেছে সরকার সমর্থক আরেক দল। সংঘর্ষ থামানোর দায়িত্ব পুলিশের, পাল্টা মার দেওয়ার জন্য সরকারি সমর্থক দল নামা কতটা বুদ্ধিদীপ্ত আমার মাথায় আসে না। তবে এটা মনে করি যে তাতে ঘটনা আরও বাড়ে এবং পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্ত্রাস দমনের স্বতঃস্ফূর্ততা কমে।

বায়তুল মোকাররমের হামলাকে পুঁজি করে শুক্রবার শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মাদ্রাসা ছাত্রদের পাল্টা প্রতিবাদ। রাস্তা অবরোধ। পুলিশকে আক্রমণ। প্রতিবাদে ঝরে গেল চার জনের প্রাণ। আবার তার সূত্র ধরে আক্রমণ চলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে ঝরে যায় ক’জনের প্রাণ। এই পর্যন্ত কয়জন মারা গেছে সর্বমোট তারও হিসাব নেই। কেউ বলছেন তিন দিনের সহিংসতায় কমপক্ষে ১৪ জন মারা গেছেন। আহতের হিসাব নেই। মনে হচ্ছে প্রাণের কোনও মূল্য নেই এই দেশে।

যাদের প্রাণ গিয়েছে তারা সবাই বিক্ষোভে মরেছে, এমন নয় যে সুবোধ, নিরীহ কাউকে পুলিশ বাসায় গিয়ে গুলি করেছে। তবে সবাই মাদ্রাসার ছাত্র নয়। নিরীহ কেউ থাকলে তাদের রাস্তায় নামিয়েছে কারা? যেসব শিশুকে মাঠে দেখা গেছে তারা কি মাঠে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ করার বয়স হয়েছে? এদের ঢাল হিসেবে যারা রাস্তায় নামিয়েছে তাদের চিহ্নিত করবে কে? এমন কারও নামে মামলা হয়েছে এখনও শুনিনি।

যারা রাস্তায় নেমেছে কিংবা যারা তাদের নামিয়েছে তারাই তো আক্রমণ করে পুড়িয়েছে রেল স্টেশন, থানা, জমি রেজিস্ট্রি অফিস, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন। রবিবার (২৮ মার্চ) হরতাল চলাকালে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে তাণ্ডব চালিয়ে আবারও ধ্বংসের নগরীতে পরিণত করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়, জেলা প্রেস ক্লাবসহ অসংখ্য স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। সারা দেশে এমন ছোট-বড় তাণ্ডব চালিয়েছে হরতালের দিন।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে মিডিয়া বলছে, হরতাল চলাকালে রবিবার সকাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে তাণ্ডব চালানো হয়। এ সময় শহরের মুক্তবুদ্ধিচর্চার কেন্দ্রগুলোসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে জেলা পরিষদ ভবন, পৌরসভা ভবন, পৌর মিলনায়তন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, পুলিশ লাইন, সদর থানা, খাঁটি হাতা বিশ্বরোড হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, শহরের কেন্দ্রীয় মন্দির আনন্দময়ী কালীবাড়ি, দক্ষিণ কালীবাড়ি, রেলওয়ে স্টেশন, জেলা আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্যের কার্যালয়, সরকারি গণগ্রন্থাগার, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকারের কার্যালয়, তার নিজের ও শ্বশুরবাড়ি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগার চত্বর ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন।

এসব ফিরিস্তি শোনার পর কি মনে হয় সেখানে সরকারের অস্তিত্ব আছে? পুলিশ প্রশাসন সক্রিয়? এটি নতুন ঘটনা নয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসব ঘটনা নতুন হচ্ছে না। এর আগে ফেসবুকে ভুয়া স্ট্যাটাস দেওয়ার নাম করে তারা নাসিরনগরে হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে, গ্রামছাড়া ছিল সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকেরা হিন্দু পিটায়, কথায় কথায় রেল স্টেশনে আগুন দেয়, বারবার আলাউদ্দীন খাঁর স্মৃতি সংসদ পোড়ায়, লাইব্রেরি পোড়ায়, সরকারি নানা অফিস পোড়ায়– কোনও কিছুতে মনে হয় প্রশাসন আর তাদের কিছু যায় আসে না– নয়তো বারবার ঘটে কি করে! পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে এখানে।

হরতালের দিন কিছু হেফাজতি রাস্তায় চেয়ার টেবিল দিয়ে মাদ্রাসার ছেলেদের পড়াতে বসে গেছে। ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। কারও কারও হাতে লাঠি/তলোয়ার, যুদ্ধ ঢাল। একজন দেখলাম ঘোড়ায় চড়েছে। এদের মাথার মধ্যে মনে হয় কারবালা চলছে, কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যের কুখ্যাত আইএস বাহিনীকে স্বপ্নে পেয়েছে। দুনিয়া কোথায় যাচ্ছে আর এদের দেখলে বুঝা যায় বাংলাদেশ আজ কোথায় যাচ্ছে!

এদের আন্দোলনের তাণ্ডব নিয়ে কিছু বলার নেই। কারণ, সরকার না চাইলে এটা হতে পারে অনেকে বিশ্বাস করছে না। আর সরকারের মধ্যে থেকে কেউ যদি এদের খেলাফতের স্বপ্নে বিভোর করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়– সেটাও দেখার দায়িত্ব সরকারের। গোয়েন্দাদের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে তাহলে কোন কারণে! ফেসবুকে সরকারবিরোধী মন্তব্য করছে এমন দু’চার জন মুক্তমনা লোকদের গ্রেফতারে বাহাদুরির কিছু নেই। বাংলাদেশের আসন্ন বিপদ তো তারা নয়, এই ‘মূর্খ’ জনগোষ্ঠীই হচ্ছে আগামীর বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ। দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কহীন শিক্ষা, কঠিন প্রতিযোগিতার বাজারে এদের আরও হিংস্র করে তুলবে।

সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার কওমি মাদ্রাসায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী। এই কর্মঠ জনগোষ্ঠীকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার না করে দূরে ঠেলে সমাজকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এদের মূল স্রোতে আনার চেষ্টা অন্যায় নয়। সেই চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সরকার এদের সঠিক শিক্ষার পথে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এদের মগজে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিরোধিতা, ভিন্ন ধর্মীদের প্রতি বিদ্বেষ, আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশুদের মনে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এসব ঢুকাচ্ছে তাদের শিক্ষকরা, যারা একই চিন্তা নিয়েই বেড়ে উঠেছে।

প্রত্যেক কিছুর গ্রামার আছে, এমনকি যুদ্ধেরও। এরা রাজপথে আসে পঙ্গপালের মতো। ধ্বংসলীলা এরা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে করে। কার জান, কার মাল কোনও পরোয়া করে না। যে তাণ্ডব ওরা ২৬ মার্চ থেকে দেশে চালিয়েছে সেটি ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বর, বায়তুল মোকাররম, পল্টনে ঘটে যাওয়া তাণ্ডবকে আবার দেশবাসীর মনে করিয়ে দিয়েছে। হেফাজতি ওই তাণ্ডবে জামায়াত-শিবির প্রত্যক্ষ মদত দিয়েছে, অংশ নিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সরকার এই ‘পঙ্গপাল কার্যক্রম’ এখনই না থামালে দেশকে অনেক খেসারত দিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

anisalamgir@gmail.com