করোনার করুণ কাহিনি: হুকুমের দাস ও মানসিক দাসত্ব

মাকসুদুল হক
“কারে শুধাই মর্মকথা কে বলবে আমায়
যার কাছে যাই সে রাগ করে
কথার অন্ত না পাওয়ায়” - ফকির লালন শাহ

৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ করোনাভাইরাস ও তার উপসর্গ কোভিড-১৯ চীনের উহান নগরীতে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। তবে গেলো ১৬ মাসে সমগ্র পৃথিবী এই ভাইরাস সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে যতটুকু ধারণা পেয়েছি, তার চেয়ে যে খুব বেশি জানতে পেরেছে, এমন কোনও শক্ত প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না। এই বিভীষিকাময় সময়ে যে সকল ‘নতুন’ তথ্য উপাত্ত আমাদের সামনে এসেছে , তা সবই হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুক্তিগুলো ধোপে টেকেনি।

করোনা বিভিন্ন রূপে কয়েক হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে থাকলেও, মানব ইতিহাসে মানবকুলকে এতটা অসহায় করেছিল কিনা, বা মানসিকভাবে বিশ্বজুড়ে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলেছিল কিনা তা আমাদের অজানা। আমাদের দুর্ভাগ্য প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে অদ্ভুত সব খবর আসে, যা প্রমাণ করে বিজ্ঞান কেবল ব্যর্থ হচ্ছে না, সে সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তাকে পরিণত করেছে রোবটের মতো ননসেন্সিকেল হুকুমের দাস। ‘ক্রিটিকাল থিংকিং’-এর পরিসরটা ক্রমেই খুব সংকীর্ণ হয়ে আসছে।

বিজ্ঞান কেবল ব্যর্থ হয়নি, সে তার দায়িত্বহীনতার কারণে করোনার চেয়ে বহুগুণ ভয়াবহ ‘হতাশা’ নামের সমষ্টিগত ‘কাল্পনিক ভাইরাস’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। হতাশা থেকে কত রকম শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা মানব দেহে দানা বাঁধতে পারে, তা খুব সহজে অনুমেয়।

আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হচ্ছে অবিশ্বাসকে, অযুক্তিকে যুক্তি মানতে হচ্ছে এবং এমন সব অদ্ভুত রীতি উপস্থাপন করে হচ্ছে, যা ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, আমাদের পূর্ব পুরুষদের এরকম ভুতুড়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়নি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যার পিঠে সওয়ার হয়ে তথাকথিত ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ যাকে এই মুহূর্তে আমাদের ‘ত্রাতা সহ বেস্ট ফ্রেন্ড’ ধারণা করছি, মানব জাতিকে আর অকৃত্রিম রাখছে না। মানুষ যে প্রকৃতিরই সৃষ্টি সে চিন্তা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, বা ঝাঁটাপেটা করে আমাদের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কতটা  কৃত্রিম আমরা হয়ে গেছি, কতটা পাল্টে গেছি এই এক বছরে তা আমাদের আচার, আচরণ, ব্যবহার ও সর্বোপরি রুচি ও মেধাশূন্যতা ভয়াবহভাবে স্বাক্ষর রাখে। মানুষে মানুষে সরাসরি যোগাযোগ, এমনকি সৌজন্য সাক্ষাৎ আজকাল মনে হয় সোনালি অতীতের কোনও এক মরীচিকা।

এসবই নাকি ‘নতুন স্বাভাবিক’ বা ‘নিউ নরমাল’- এর বাইরের কোনও বিকল্প চিন্তা বিশেষ করে সাংঘর্ষিক চিন্তা হবে ‘পুরনো অস্বাভাবিক’ বা ‘ওল্ড অ্যাবনরমাল’। আপাত দৃষ্টিতে যা প্রখর ভাবে অশনি সংকেত বাজছে তা হলো এই ‘মনস্তাত্ত্বিক বিশ্বযুদ্ধে’ সমগ্র বিশ্ব উন্মাদ না হওয়া অবধি বা পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ আত্মহত্যা না করা পর্যন্ত, সহজ কোনও সমাধান যে মিলবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। খেয়াল করবেন, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা মার্চ ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত ছিল ৮,৪৬২ জন। অথচ ওই একই সময় আত্মহত্যা করেছে ১৪,৪৩৬ জন। কী ভয়াবহ অবস্থা! 

এর বেশ কিছু কারণ আছে।

এই তথাকথিত তথ্য প্রযুক্তির যুগে, সব বড় বড় যন্ত্র, মন্ত্র, তন্ত্র যেমন রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, এমনকি গণতন্ত্র সবই বিজ্ঞানের মতো ফেল করছে, বা ফেল করানো হচ্ছে।

মানুষ নিজেকে এতটাই ‘স্বাধীন এ মুক্ত’ মনে করা শুরু করলো যে সে তার দাম্ভিকতায় ভর করে সবকিছুর ওপরে ‘নিয়ন্ত্রণ’ চাইলো। সর্বনাশ তখনি শুরু হলো যেদিন সে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্ধত হলো। প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলে, মানুষের নিয়মে না। কোভিড-১৯ হলো প্রকৃতির প্রতিশোধ।

আমাদের প্রকৃতির ওপরে খবরদারি, প্রকৃতিকে ধ্বংস, খাল, বিল, নদী, নালা সব ভরাট করা, নিরীহ পশু প্রাণীর প্রতি নির্মমতা, বৃক্ষরাজির কর্তন ইত্যাদি শুধু মানব জাতি নয়- সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। এর জন্য তো আমাদের চড়া মূল্য দিতেই হবে। প্রকৃতি তার ‘রিফ্রেশ বাটন’ চাপ দিয়েছে মাত্র। আমাদের ‘রিবুট’ অবধি অপেক্ষা করতেই হবে- এটাই হলো প্রকৃতির প্রকৃতি বা ‘ন্যাচারাল জাস্টিস’।

এই বিশ্বায়নের ‘স্মার্ট যুগে’ কোভিড-১৯ হচ্ছে ‘বিশ্ব আধিপত্য’ বা ‘দানবতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ব্যবহৃত মোক্ষম অস্ত্র! দানবতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা ও চিন্তাধারা কায়েম করার জন্য প্রয়োজন সমগ্র বিশ্বের ‘সমষ্টিগত মস্তিষ্ক ধোলাই’ যা বস্তুত এখনকার চলমান প্রক্রিয়া। প্রয়োজন সমগ্র বিশ্ব একই কথা, একই চিন্তা, একই সুর, একই যুক্তি, একই বিশ্বাস ও একই অবিশ্বাস, একই সত্য, একই মিথ্যা তোতাপাখির মতো আওড়াতে থাকবে।

তোতাপাখি যখন পুরা বিষয়টা শিখে যাবে তখন তোতাপাখির বন্দনা হবে বিশ্বের বন্দনা। ইতোমধ্যে ঘটতে থাকা ব্যবসা সফল ‘কোভিড-১৯ জমদূত’-এর বন্দনা তারই ইঙ্গিত কি দিচ্ছে না? অস্বীকার কি করা যায় যে করুণ বাস্তবতার মাঝে আমরা এখনও বেঁচে আছি তা তার যথেষ্ট প্রমাণ?

আর জমদূতের চরিত্র?

কিছু দিন আগ অবধি বলা হয়েছিল এ এক ধরনের ছোঁয়াচে রোগ ও হাঁচি কাশি ইত্যাদি দিয়ে এর সংক্রমণ ঘটে। এখন শুনছি এটা বাতাসেও ছড়াচ্ছে। আগামীকাল পানি দ্বারা ছড়াচ্ছে শুনলেও অবাক হওয়ার কোনও কারণ নেই। দিনে দিনে, ঘণ্টায় ঘণ্টায়, মিনিটে মিনিটে তার চরিত্র যেভাবে পাল্টাচ্ছে বলে আমাদের ধারণা দেওয়া হচ্ছে, তা কতটা সত্য বা মিথ্যা সে বিচার আমরা না করতে পারলেও একটা কথা পরিষ্কার। এ ভাইরাস খুব সহজে আমাদের ছেড়ে দেবে না। এর আয়ুকাল বহু বছর, আর যতই আমরা বলি এ ‘বাঁদর, ইঁদুর, বাদুড়’ ইত্যাদি প্রাণী থেকে আমাদের সংক্রমণ করেছে- সত্যটা হলো কোভিড-১৯ ‘মানব সৃষ্ট’ ভাইরাস এবং মানুষই তার গতি বিধির নিয়ন্ত্রক। যে অবধি কে বা কাহারা তাকে কীভাবে, কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছে তা শনাক্ত করতে পারবো না- এই অদৃশ্য আততায়ী তার চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েই যাবে। যতই চেষ্টা করি না কেন, এই আততায়ী আমাদের পাশ কেটে দুই কদম এগিয়ে থাকবে সব সময়।

মাঝে মধ্যে সে যুদ্ধবিরতি বা ‘সিজ ফায়ার’ করতে পারে, যেমনটি সে করেছিল জুলাই ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১ অবধি, তবে তা করবে তার নিজের বিশ্রাম বা নতুন কৌশল ও রসদ জোগাড় করার জন্য। তারপর আবারও সে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এ ধারাবাহিকতার কিছুটা পরিবর্তন হলেও হতে পারে, কিন্তু মৃত্যুর মিছিল তাতে কমবে না- উল্টোটা - বেড়েও যে যেতে পারে, তার জোর সম্ভাবনা ‘তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া’ যায় না।

বিশ্বের চরম মাতব্বর আমেরিকার কথা আর কি-ই বা বলবো? হলিউডের প্রোপাগান্ডা যা সারা জীবনে দেখে বড় হয়েছি ও ‘অকুণ্ঠ ইমান’ সহকারে বিশ্বাস করেছি, আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে যে ‘পৃথিবীকে সর্বশেষ মুহূর্তে’ অলৌকিকভাবে এসে শুধু আমেরিকাই পারবে রক্ষা করতে! আমেরিকাই আমাদের শেষ ভরসা। অথচ নিয়তির পরিহাস, এই যুদ্ধে তাদের ৬ লক্ষের কাছাকাছি প্রাণহানি, মৃত্যুর সংখ্যায় তাদের বিশ্বের প্রথম স্থানে রেখেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী, সবচেয়ে যুদ্ধবাজ দেশ আমাদের মতোই, অসহায়ত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। হ্যালো... কোথাও কোনোরকম আশার আলো কি দেখা যাচ্ছে?

খেয়াল করে দেখবেন এই ভাইরাসের উৎস চীনের এ ধারণা প্রাথমিকভাবে আমাদের গিলতে দেওয়া হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দীর্ঘ অনুসন্ধানে এর সত্যতার প্রমাণ মেলেনি। এমনকি যে ল্যাবরেটরি থেকে এই ভাইরাস ‘লিক’ করে ছড়িয়েছে বলে জোর দাবি তোলা হয়েছিল, তাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে ‘প্রকারান্তরে অসম্ভব’। এখন প্রশ্ন হলো, ভাইরাসের সূত্র যেহেতু আমরা এখন পর্যন্ত বের করতে ব্যর্থ- কীভাবে আমরা তাকে নিয়ন্ত্রণ করবো? কোন ধরনের লড়াই করলে এই অদৃশ্য শত্রুর শেকড় আমরা উপড়ে ফেলতে পারবো?

বাড়তি প্রশ্ন: এমন কী প্রমাণ আছে যে ভাইরাসের নতুন সংস্করণ ও সংযোজন নতুন নতুন প্যাকেজে এঁটে পরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃত আবারও বিভিন্ন জায়গা থেকে ছড়ানো হচ্ছে না? ইউকে, সাউথ আফ্রিকান, ব্রাজিলিয়ান বা অতি সম্প্রতি ভারতীয় ‘ভ্যারিয়েন্ট’ যেগুলো মুখের ফেনা তুলে অনেকেই আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তার সূত্র যেহেতু চীন দেশে নয়, এগুলো এলো কোথা থেকে?

অবাক বিষয় হলো, এই ভাইরাস সমগ্র চীনে ছড়িয়ে যায়নি- আর উহানকে সরকারিভাবে ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ‘করোনামুক্ত’ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেখানকার নগরবাসীকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরতে হচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, ইতোমধ্যে তারা সপ্তাহব্যাপী ‘করোনা মুক্তি উৎসব’ শারীরিক দূরত্ব ছাড়াই পালন করেছে। এ ছাড়া উহানে করোনা জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে ৭৬ দিনের কঠোর লকডাউন নগরবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিতে।

করোনাভাইরাসের মূল উপাদান সে মানুষকে ভয়, ভীতি, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ও অনিশ্চয়তার মাঝে আটকে ফেলে। এসব কিছুই মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে ও আমরা সবাই কেবল হতাশাগ্রস্ত নই- আমরা আতঙ্কপীড়িত। এ এক ধরনের ‘মানসিক সন্ত্রাস’। মৃত্যুর ভয় ছাড়া বাড়তি চাপ আসে আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে।

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের সব মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের আত্মসম্মানবোধটা এতটাই তীব্র যে না আমরা কারও কাছে হাত পাততে পারি, না আমরা মুখ খুলে কিছু বলতে পারি। করোনার চিকিৎসা কতটা ব্যয়বহুল তা যারা ভুগছেন বা ভুগেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। প্রকাশ্যে না বললেও অনেকে এই খরচ পোষাতে পারছেন না বিধায় বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, এমনকি মারাও যাচ্ছেন! আর হতদরিদ্র মানুষের কী অবস্থা? সে কথা না হয় নাই বা বললাম। কারণ, সেটা অনুমান করতে কোনও বড় পণ্ডিত হতে হয় না। কোভিড-১৯ তাদের খরচার খাতায় এমনিতেই রেখে দিয়েছে পেটে লাথি মেরে... কী হৃদয়বিদারক!

করোনা সূত্র আমরা এ অবধি খুঁজে বের করতে পারিনি, তাই আত্মরক্ষার যেসব কৌশল আমরা অবলম্বন করছি তা মোটামুটি সবই ত্রুটিপূর্ণ, অনেক ক্ষেত্রে হাস্যকর ও আঁধারে ঢিল ছোড়ার শামিল।

মাস্ক, সামাজিক (যা বস্তুত শারীরিক) দূরত্ব, টেস্টিং কিট, স্যানিটাইজার, পিপিই, হাত ধৌত করা ইত্যাদি আমাদের আংশিক নিরাপত্তা দিতে পারে- তবে কাঙ্ক্ষিত  ‘মৃত্যুমুক্ত নিরাপত্তা’ দিতে পারে না, বা তা দেওয়া সম্ভবও নয়। ইতোমধ্যে যারা এসব তথাকথিত ‘উপকারী সামগ্রীর’ রমরমা ব্যবসা করে ফেলেছেন তারা স্বস্তির ঢেকুর তুলছেন। কী অদ্ভুত এক ক্রান্তিকালে আমরা বিচরণ করছি!

‘স্বাস্থ্যবিধি’ মেনে ঠিকই চলছি তবে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা কোনও চিন্তা কি করছি? কিছু কিছু স্বাস্থ্যবিধি যেমন শারীরিক দূরত্ব ও ঘন ঘন হাত ধৌত করা জাতিগতভাবে আমাদের যে শুচিবাই রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা ক’জনের চিন্তায় আছে?

পাশাপাশি একাকিত্বের জ্বালা যন্ত্রণা ক’দিনই বা সহ্য করা যায়? সারা বিশ্বে কত মানুষ যে সম্পূর্ণ একাকী মৃত্যুবরণ করছে তা চিন্তা করলে শরীরে  শিহরণ চলে আসে। ‘আমরাও কি একইভাবে মরবো’- প্রতিদিন কোনও না কোনও সময় প্রতিটি মানুষকে এই দুশ্চিন্তা গ্রাস করছে এবং তা এখন খুব স্বাভাবিক এ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা খুবই আশা করছিলাম যে ভ্যাকসিন বা টিকা কিছুটা হলেও নিরাপত্তা দেবে। তবে এখন আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি এর কার্যকারিতা কতটা সীমিত। করোনা সমস্যার বিহিত হোক আর নাই হোক- ভ্যাকসিন এসেও আমাদের শঙ্কামুক্ত করতে ব্যর্থ- ঘুরে ফিরে ‘যে লাউ সেই কদু’। তার ওপরে চলছে আরেক মানসিক চাপ- ভ্যাকসিনের ঘাটতি। যারা এক ডোজ নিয়েছেন তারা পড়েছেন বিপদে। এখন আলাপ হচ্ছে ভারতীয় এক ডোজ নেওয়ার পর রাশিয়ান বা চাইনিজ আরেক ডোজ নিলে কি কোনও সমস্যা হবে? এসব হাস্যকর প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য কোনও উত্তর কি কেউ দিতে পারবে?

কোভিড-১৯ খুব ঠাণ্ডা মাথায় তার হত্যাযজ্ঞের লক্ষ্য স্থির করেছে, যাকে বলা হয় ‘সিলেকটিভ এসাসিনেশন’। প্রথমে সে ৬০ বছর  ঊর্ধ্ব লোক বিশেষ করে যারা বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন তাদের মারার প্ল্যান করলো। এর কারণ, বৃদ্ধদের না সে সম্মান করে, না এদের বাঁচিয়ে রাখতে যে পরিমাণ খরচ হয় তা সে মনে করে যৌক্তিক। বৃদ্ধরা যে মানব জাতির অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, যা যেকোনও জাতিকে সমৃদ্ধ করে, তা তার কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন। পশ্চিমা দেশগুলোতে বৃদ্ধ লোকদের দেখাশোনা করা হয় ব্যয়বহুল বৃদ্ধাশ্রমে– কোনও বাসায় নয়। কোভিড-১৯ খুব ভালো জানে, এরা মারা গেলে কারও তেমন কোনও দুঃখ-কষ্ট থাকার কথা নয়। এটাই পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি। তাই মারা গেলে যাক... এরপর আমরা দেখলাম কত দ্রুত সে নতুন টার্গেট ফিক্স করলো। ৪০ বছর ঊর্ধ্ব কয়েক লক্ষ লোক খতম করে সে বিশ্রামে চলে গেলো।

এবার তার নজর ১৮ বছর বা তার ঊর্ধ্বে  যাদের বয়সসীমা। তারুণ্য যারা যেকোনও জাতির ভবিষ্যৎ, কোভিড-১৯-কে জিইয়ে রাখার জন্য খুব সাংঘাতিক হুমকি। এর কারণ, তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ নাগরিক এই বয়সের কোঠায়। বিশ্বের যেকোনও উন্নত দেশের মতো তাদের আছে প্রতিভা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্পৃহা, দক্ষতা এবং অর্থনীতিকে বেগবান রাখতে এরা এক বৃহৎ শক্তি। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়।

সমস্যা হলো বিশ্বের যেকোনও উন্নত দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, টেক্কা দিয়ে তাদের এগিয়ে যাওয়াটা কোভিড-১৯-এর জন্য বড় ধরনের হুমকি। এই নব্য তারুণ্যের সফলতা তাদের করেছে আজ ‘শিকার' এবং তারা তা নিজেই বেছে নিয়েছে... ‘ভিক্টিম অফ দেয়ার ওন সাকসেস’। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ ইতোমধ্যে অনেক টগবগে তরুণের তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

এরপর কি..... ?

শোনা যাচ্ছে দুধের শিশু থেকে শুরু করে ছোট বাচ্চাদের জন্য ভ্যাকসিন রেডি করা হচ্ছে- অর্থাৎ কেউ রেহাই পাচ্ছে না। এই অদৃশ্য ঘাতকের কত সুদূরপ্রসারী ও ভয়াবহ পরিকল্পনা- একটু ভেবে দেখবেন কি?

‘ভয় নয় সচেতনতাতেই জয়’- এসব নিরর্থক স্লোগান কি যথেষ্ট? শুধু ‘সচেতন’ থাকলেই কি এই যুদ্ধে আমরা তথা মানব জাতি বেঁচে যাবে?

লেখক: সংগীতশিল্পী