‘যে নালে উৎপত্তি সে নালেই বিনাশ’

প্রভাষ আমিনহঠাৎ করে রবিবার মধ্যরাতে ফেসবুকে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর ভিডিও বার্তায় দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তিনি একটি সংক্ষিপ্ত লিখিত বার্তা পড়ে শোনান। এক মিনিট ২৪ সেকেন্ডের ভিডিও বার্তায় হেফাজতের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। বার্তায় বলা হয়, ‘দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের পরামর্শক্রমে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হইলো।’ অবশ্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। বিলুপ্ত কমিটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরীই নতুন কমিটির আহ্বায়ক। প্রথমে তিন সদস্যের হলেও পরে আহ্বায়ক কমিটিতে আরও দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এটি শেষ পর্যন্ত একটি পারিবারিক কমিটির মর্যাদা পেয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বী তো দূরের কথা,পাঁচ সদস্যের কমিটির চার জনই বাবুনগরীর পরিবারের সদস্য।

হেফাজতের কমিটির বিলুপ্তির খবরে মধ্যরাতেই প্রগতিশীল এবং সত্যিকারের ইসলামপ্রেমী মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে স্বস্তি এবং উল্লাসের ঢেউ খেলে যায়। অনেকে কমিটির বিলুপ্তিকেই হেফাজতের বিলুপ্তি হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টি অত সরল নয়। গত সপ্তাহে এই কলামে লিখেছিলাম ‘হেফাজত জুজুর বিদায়’। অনেকে সেই লেখার ব্যাখ্যা করেছেন হেফাজতের বিদায় হিসেবে। কিন্তু হেফাজতের বিদায় অত সহজে হওয়ার নয়। তবে হেফাজত যে নিজেদের ভয়ংকর ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছিল, আপাতত তার বিদায় হয়েছে; এটাই স্বস্তির। হেফাজত যে একটা কাগুজে বাঘ, এটা বলা হচ্ছিল, অনেক দিন ধরেই।

সরকারের ভেতরের একটা অংশও সরকারকে এই বাঘের ভয় দেখাচ্ছিল। তবে হেফাজতের উত্থান থেকে পতন বিশ্লেষণ করলে তাদের এই বায়বীয় ভাবমূর্তি বাস্তবতাটা বোঝা সহজ হবে। জন্ম ২০১০ সালে হলেও তাদের উত্থানটা ২০১৩ সালের ৫ মে। কিন্তু সেই উত্থানেই লুকিয়ে ছিল পতনের সূত্র। শাপলা চত্বরে ৫ লাখ বা ১০ লাখ লোকের সমাবেশ দেখিয়ে যারা সরকারকে ভয় দেখিয়েছিল, তখনই তাদের মুখের ওপর বলে দেওয়া যেতো, তোমাদের এই বিশাল সমাবেশ এক রাতের অপারেশনেই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। ৫ মে’র বিশাল সমাবেশ হেফাজতের মধ্যে সরকার পতনের ফাঁকা আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছিল। মাঝের ৮ বছর সরকারের লাই পেয়ে পেয়ে তাদের সেই আত্মবিশ্বাস আরও প্রবল হয়। দেশি-বিদেশি নানান অপশক্তির প্ররোচনায় তারা আবারও ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু সরকারের আরেক দফা কৌশলী অভিযানে তছনছ হয়ে যায় তাদের স্বপ্নের তাসের ঘর। শাপলা চত্বরে একবার প্রমাণ হয়েছিল হেফাজত হলো ‘শক্তের ভক্ত, নরমের যম’। ২০২১ সালে আবারও সেই বিশ্বাসের পুনরাবৃত্তি হলো।

একটা প্রবাদ আছে, ‘যে নালে উৎপত্তি সে নালেই বিনাশ’। হেফাজতেরও তা-ই হলো। তারা ভয় দেখিয়ে জয় করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকারের বুঝতে আট বছর সময় লাগলো যে, হেফাজতকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সময় একটি স্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, ‘যদি তুমি ভয় পাও তবেই তুমি শেষ, যদি তুমি ঘুরে দাঁড়াও, তবে তুমিই বাংলাদেশ।’ হেফাজত বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকার সময় মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ঘুরে দাঁড়ালেই এরা লেজ গুটিয়ে পালাবে।

কাগজে-কলমে মামুনুল হক ছিলেন হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব। কিন্তু গত কয়েক মাসে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন হেফাজতের সাইনবোর্ড। যেন তিনি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন, যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। মামুনুলের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে সুনামগঞ্জে সংখ্যালঘু গ্রাম ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

তার ইশারায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিকল্প প্রশাসন গড়ে তোলে হেফাজতি মাস্তানরা। মাঝে মাঝে তার কথা শুনলে মনে হতো দেশে বুঝি কোনও সরকার নেই। সর্বশেষ সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে কথিত স্ত্রী নিয়ে ধরা পড়ার পর হেফাজতিরা তাকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। তাতে মামুনুলের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকেন। ভেবেছিলেন তাকে ধরার ক্ষমতা বুঝি কারোই নেই। হেফাজতিরা এমন একটা ধারণা তৈরি করতে পেরেছিল, মামুনুলকে ধরলে সারা বাংলায় আগুন জ্বলবে। সোনারগাঁয়ের মতো বুঝি পুলিশের কাছ থেকে মামুনুলকে ছিনিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে মাত্র তিন জন পুলিশ গিয়ে যখন মোহাম্মদপুরের মাদ্রাসা থেকে মামুনুলকে নিয়ে এলেন, সারা বাংলাদেশে আগুন জ্বলা তো দূরের কথা, ঠিকঠাক মতো একটা প্রতিবাদ মিছিলও হয়নি। এখন সবার ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ অবস্থা। মামুনুল হেফাজতে এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন, তার ইসলামবিরোধী লাম্পট্যকেও সমর্থন দিয়েছিল তারা। যে মামুনুল হেফাজতকে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন, সেই মামুনুলই এখন হয়ে গেলেন হেফাজতের পতনের কারণ। মামুনুল উসকানি দিয়ে দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিলেন, তারই খেসারত দিতে হচ্ছে এখন হেফাজতকে। অন্তত রিসোর্ট কেলেঙ্কারির পরও যদি হেফাজত মামুনুলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতো, তাও কিছুটা শেষ রক্ষা হতে পারতো। হেফাজত যে ডুবছে, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছিল কদিন ধরেই। ডুবন্ত জাহাজ থেকে ইঁদুরের লাফিয়ে পড়ার মতো একের পর এক কেন্দ্রীয় নেতা হেফাজত থেকে পদত্যাগ করছিলেন। মামুনুল হককে গ্রেফতারের পর হেফাজত নেতারা সরকারের সঙ্গে আবার সমঝোতায় যেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে তারা বৈঠকও করেন। কিন্তু নিজেদের ওজন বুঝতে হেফাজত নেতাদের বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখন শত নাকে খত দিয়েও তারা আর সরকারের আনুকূল্য পাচ্ছেন না। শেষ চেষ্টা হিসেবে বাবুনগরী কমিটিই বিলুপ্ত করে দিলেন।

২০১৩ সালে আল্লামা শফীর পাশে থেকে মূল উসকানিটা দিয়েছিলেন বাবুনগরী। তখনও তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। আর ২০২১ সালে বাবুনগরীর পাশে থেকে উসকানি দিচ্ছিলেন মামুনুল হক। এবারও শেষ রক্ষা হলো না। এটাকেই বলে, যে নালে উৎপত্তি, সে নালেই বিনাশ। বেলুন বেশি ফোলালে ফুটে যায়। বাবুনগরী-মামুনুলরা হেফাজতের আত্মবিশ্বাসের বেলুনে বেশি বাতাস দিয়েছিলেন। তাই সেটা ফেটেই গেল। এখন সতর্ক থাকতে হবে, আর যেন বাংলার মাটিতে হেফাজতের উত্থান না ঘটে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ